সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১১:২৬:১০

আযানের মধুর ধ্বনি শুনে মুসলমান হলেন এক খ্রিস্টান নারী

আযানের মধুর ধ্বনি শুনে মুসলমান হলেন এক খ্রিস্টান নারী

ইসলাম ডেস্ক: ইসলামের শান্তির বাণি শুনে মুগ্ধ হয়ে যুগে যুগে হাজার হাজার ইহুদি, খ্রিস্টান কিংবা অন্য ধর্মাবলম্বীরা ইসলামের ছায়াতলে এসেছেন। তারই একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন তাটিনা ফাতেমা নামের এক স্লোভাবিয়ার মহিয়ুষী নারী। যিনি আগে একজন খ্রিস্টান নারী ছিলেন। তবে আযানের মধুর ধ্বনি শুনে তিনি ইসলাম গ্রহণ না করে পারেন নি। তাই তো তিনি আজ শান্তির ধর্ম ইসলামের ছায়াতলে এসেছেন।

ইসলাম গ্রহন করা বিষয়ে তাটিনা ফাতিমা বলেন, আমি লক্ষ লক্ষ শব্দ ব্যবহার করেও আল্লাহর প্রতি আমার যথার্থ ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পারব না। ইসলামের পথে আমার যাত্রা শুরু হয় অনেকটা অগোচরে এবং সাদামাটাভাবে। শুরুর কথা মনে হলে আমার এখনো হাসি পায়।
আমি আমার পিতামাতার সঙ্গে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ  করতে পছন্দ করতাম। আমি আমার বাবা-মায়ের সাথে বিভিন্ন মুসলিম দেশে ভ্রমণ করেছি।
মিশর ছিল আমাদের ভ্রমণের সর্বশেষ একটি দেশ। মিশরের সবকিছু, বিশেষকরে তার সংস্কৃতি দারুণভাবে আমার মনযোগ আকর্ষণ করে। মিশরে গিয়ে প্রথমবারের মত আমি মসজিদের সান্নিধ্যে আসি। কিন্তু তখনো আমি মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করিনি। আমি কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলাম-একজন অমুসলিম হিসেবে আমি এর ভিতরে প্রবেশ করতে পারি কিনা না।
আমি মসজিদটি থেকে আজানের সুমধুর ধ্বনি শুনতে পেলাম। এটি শোনা মাত্রই আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে এবং আমি আবেগাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। আমি মিনার থেকে ভেসে আসা এ সুমধুর ধ্বনি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাইনি। আজান আমাকে পুরাপুরি বিমোহিত করে তোলে। মসজিদে জমায়েত হওয়া এবং একসঙ্গে নামায আদায়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে সংহতি আমি দেখেছি তা আমাকে বিমুগ্ধ করে এবং এই মধুর দৃশ্য আমার স্মৃতিতে চিরভাস্বর হয়ে আছে।
সেখান থেকে ফিরে আসার সময় আমার কাছে কেবলই মনে হয়েছে আমি আমার খুব ঘনিষ্ঠ কোনো কিছু রেখে যাচ্ছি। ওই সময় ইসলাম সম্পর্কে আমি সামান্য কিছু জানতাম। কিন্তু এখন যতটুকু জানি সে তুলনায় সেটি ছিল একেবারেই নগণ্য।
আরবি ভাষা আমাকে এতটাই আকর্ষণ করে যে, বাড়িতে ফিরে আসার পর আরবি শেখার জন্য আমার মনে ব্যাকুলতা শুরু হয়। এটিকে আমার কাছে মনে হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ভাষাগুলোর মধ্যে শ্রেয়।’ কিন্তু আমার শহরের স্কুল-কলেজগুলোতে আরবি ভাষা শিক্ষার কোনো কোর্স ছিল না। এখানে শুধু ইংরেজি এবং জার্মান কোর্স শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে।
যাই হোক, আমাদের এক শিক্ষক আরবি ভাষা শিক্ষা দেয়ার একটা ব্যবস্থা প্রায়ই সম্পন্ন করেছিল। কিন্তু তা শুরু হওয়ার পূর্বেই বাতিল হয়ে যায়। এটি ছিল রমজান মাস শুরু হওয়ার কিছু পূর্বে এবং আমাদের শিক্ষক তার বাড়ি  চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ফলে আরবি শেখার জন্য আমার ভিতর যে তীব্র উত্তেজনা কাজ করছিল নিমেষেই তা হতাশায় পরিণত হয়।

এভাবে কিছু সময়  অতিবাহিত হয় এবং আমি ধীরে ধীরে ইসলামের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করি।
আমি বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ইসলাম সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখা পড়তে শুরু করি। আমি ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের টিভি প্রোগ্রাম দেখতে থাকি। আমি ইন্টারনেটে মুসলিম মহিলাদের একটি আলোচনা ফোরাম অনুসরণ করি। আমি তাদের এই আলোচনা ফোরাম হতে অনেক কিছু শিখেছি।
সেখানে আলোচকদের মধ্যে কিছু স্লোভাক নারীও ছিল। স্লোভাকিয়ার কসিস থেকে এক বোন আমাকে জানান যে, সেখানে আরবি এবং কুরআন শেখার ব্যবস্থা আছে। তার নামটি আমার কাছে পরিচিত ছিল। এর এক মাস আগে একটি টকশোতে অন্যান্য মুসলিম নারীদের সাথে আমি তাকেও দেখেছি।
আমি এই পাঠগুলোতে উপস্থিত থাকতে চেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাকে একটি ইমেইল করি এবং এরপর তিনি তার জবাব দেন। আমরা এক সপ্তাহ পরে সাক্ষাৎ করি। তিনি ছিলেন মহৎ ও খুবই ভাল একজন নারী। তার প্রতি আমার অনুভূতি ছিল বিস্ময়কর। তার সান্নিধ্যে আমি প্রশান্তি এবং নিরাপদ অনুভব করি।

কাউকে নিয়ে কিংবা কোনো কিছুর ব্যাপারে আমার কোনো পক্ষপাত ছিল না। এ কারণে নতুন কিছু শেখাটা আমার জন্য কঠিন ছিল না। আমরা একসাথে আরবি এবং কুরআন পাঠের তালিম নেই এবং সেই সাথে আমি অন্যান্য মুসলিম মেয়ে এবং নারীদের সাথে পরিচিত হই।
আমি পাঠগুলোতে নিয়মিত উপস্থিত ছিলাম এবংএরিমধ্যে কুরআন পাঠ আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে এবং আমি কয়েকটি সুরাও শিখে ফেলি। সেখানে আমি একজন অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও, সবাই ছিল আমার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সহনশীল।


কয়েক মাস পর আমাদের আরবির পাঠ শেষ হয়। কিন্তু এরপরেও আমরা সবাই একত্রিত হয়েছি। আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ আলোচনা করতাম। তাদের জীবনধারা প্রত্যক্ষ করার উদ্দেশ্যেই আমি বেশি বেশি তাদের সাথে মিশতে চাইতাম।


আমি একজন মুসলিম হতে পেরেছি কিনা তা আমার কাছে পরিষ্কার ছিল না। আমি আমার বিশ্বাস পরিবর্তন করাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করতাম না। আমার কাছে যে জিনিসটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেটি হলো আল্লাহ সম্পর্কে জানা এবং তাকে ভালোবাসা।


আমি আমার মুসলিম বোনদের কাছে  জানতে চাইলাম- কিভাবে আমি আল্লাহর ইঙ্গিত পেতে পারি। তারা সবসময়  আমাকে বলত, ‘তোমার বিশ্বাস অবশ্যই তোমাকে এক দিন আল্লাহর ইঙ্গিত দেখাতে সহায়তা করবে। আর সেটি হবে নির্দিষ্ট একটি অনুভূতি যাকে কোনো কিছু দ্বারা বিভ্রান্ত করা যাবে না। ’
আমিও তাই অপেক্ষায় থাকি ..।


আমার পরিবার খ্রিস্টান হলেও ধর্মের ব্যাপারে আমাকে কেউ কোনো নির্দেশনা দেয়নি। আমার মা আমাকে বলত যে, আমি এই ক্ষেত্রে পুরাপুরি স্বাধীন। তিনি আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ব্যাপারে কখনো বাধ্য করতেন না। আমরা গির্জায় না গেলেও  সবাই ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু আমি সবসময় এটি অনুভব করতাম যে, আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের চেয়ে আমি আল্লাহর সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ।
এভাবে সময় অতিক্রম হতে থাকে এবং একসময় সবকিছু শান্ত হয়ে আসে। বলা যায়, এটি আগ্রহের একটি স্বল্পমেয়াদী ঘাটতি। যেন আমি আমার পূর্বের জীবনে ফিরে এসেছি। এ সময়ের মধ্যে কেবল একবারের জন্য মুসলিম নারীদের সাথে আমার দেখা হয়। এমনকি এ নিয়ে আমি বাসায় খুব বেশি পড়াশোনাও করিনি।


এ কারণে আমি যতটা সম্ভব মন থেকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি এবং তার কাছে চেয়েছি তিনি যেন আমাকে তার নিদর্শন দেখান এবং তার ইচ্ছায় তিনি যেন আমাকে একজন মুসলিম হওয়ার সুযোগ দেন।
গ্রীষ্মের ছুটিতে আমি আমার নানুর সাথে কিছু সময় অতিবাহিত করি। নানুর বাড়ি হতে বাড়ি ফেরার পর আমার হৃদয়ে পালাবদল শুরু হয়। আমি এক বিশেষ অনুভূতি অনুভূত করতে পারি। এটি হঠাৎ করেই এবং অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই এসেছিল।


তখন আমি আমার মুসলিম বোনদের কথা স্মরণ করি। কেননা তারা আমাকে বলেছিল, ‘তুমি একদিন এটি অনূভব করতে পারবে। আল্লাহ তোমাকে তার নিদর্শন নিশ্চয় দেখাবে। ’
আমি এই অনুভূতির কথা কখনো ভুলতে পারব না। শিশুরা যেমন কোনো কিছু পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, এরপর আমিও অনেকটা শিশুদের মত হয়ে যাই। আমি মুসলিম হওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা অনুভব করি। আমি তখন অনুভব করতে পারি যে, আমার প্রতিটি চিন্তা, আমার প্রতিটি কাজের মধ্যে আল্লাহ রয়েছেন। আমি আল্লাহর সত্যকে এবং তার ক্ষমতায় বিশ্বাস করি, যা তিনি হযরত মুহাম্মদ সা. এর মাধ্যমে পাঠিয়েছেন।
হঠাৎ করেই আমার সব অবিশ্বাস দূর হয়ে যায়। আমি জানতাম আমার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল এবং আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন কেন? আমি এটির সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না। আপনি কেবল এটি জেনে রাখেন, আমি আমার সত্যকে খুঁজে পেয়েছি।


আমি আমার প্রিয় বন্ধু, আমার মুসলিম বোন যার সাথে আমি প্রথম সাক্ষাৎ করি এবং যিনি আমাকে অন্য সবার চেয়ে বেশি সহায়তা করেছে, তাকে বিষয়টি অবহিত করি। ওই একই দিনে আমি তার এবং অন্য মুসলিম মহিলার উপস্থিতিতে কালেমা শাহাদাত পাঠ করার ঘোষণা দেই।
আমার এই ঘোষণায় তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমার কাছে মনে হল যেন নতুন কোনো ব্যক্তি আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। যেন আমি আমার অতীতের সবকিছু ধুয়ে-মুছে, পূত-পবিত্র হয়ে পুনরায় নতুন করে জন্ম নিয়েছি এবং কুরআন ও নবীর সুন্নাহর আলোকে জীবন পরিচালিত করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে গেছি।
যদি কয়েক বছর আগে কেউ আমাকে এ সর্ম্পকে বলত, হয়ত আমি এটি বিশ্বাস করতাম না। একজন মুসলিম হিসেবে জীবন পরিচালনার কথা হয়ত কল্পনাও করতে পারতাম না। এখন আমি ইসলাম ছাড়া ভিন্ন কোনো জীবন ব্যবস্থার কথা এক মুহূর্তের জন্যও কল্পনা করতে পারি না।


ইসলাম গ্রহণের শুরুতে আমি অনুভব করলাম এখানে জানার মত অনেক কিছুই আছে যা আমি জানতাম না। আমি একজন অমুসলিম হিসাবে যখন মুসলমানদের জীবন পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করতাম, আমি তখন বুঝতে পারতাম না মুসলিমরা কতটা বেশি জানে। সম্ভবত এর কারণ ছিল আমি তাদের একটি সম্পূর্ণ দিক হিসেবে বিবেচনা করতাম।
ধর্মান্তরিত হওয়ার পর আমার মনে অনেক প্রশ্ন ছিল। আমি ইসলামের শুরু থেকে সবকিছু জানতে চেয়েছি। ইসলাম সর্ম্পকে অধ্যয়ন এবং এ সর্ম্পকে শেখার ব্যাপারে আমার তীব্র আকাক্সক্ষা রয়েছে। ইসলাম আমাকে জাগ্রত করেছে। ইসলাম আমার জীবনকে উদ্বুদ্ধ করেছে।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে