ইসলাম ডেস্ক : শরীরের সুস্থতার জন্য পরিশ্রম তথা কাজের গুরুত্ব অনেক বেশি। নবী করিম (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার পরিবারের জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে শ্রম দেয়, কষ্ট করে, সে ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদকারী মুজাহিদের মতো।”
অন্যদিকে, ইমাম জাফর সাদেক (আ.) মানুষের আত্মার ওপরে কাজের ইতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে বলেছেন, ‘মানুষের সকল প্রয়োজনীয়তা যদি কোনোরকম কাজকর্ম ছাড়াই পূরণ হয়ে যেত তাহলে কক্ষণো তাদের জীবন স্বাস্থ্যকর হতো না এবং জীবন উপভোগ্য হয়ে উঠত না।’
‘সভ্যতার ইতিহাস' নামক গ্রন্থের লেখক বিল ডুরান্ট বলেছেন, ‘সুস্থতা কাজের মাঝে নিহিত। মানব জীবনের সুখ সমৃদ্ধি আর সন্তুষ্টির মূল রহস্যগুলোর একটি হলো কাজ।'
বিখ্যাত ফরাসি লেখক ও কবি ফ্রাঁসোয়া ভলতেয়ার বলেছেন, ‘যখনি অনুভব করি কষ্ট, ক্লান্তি আর রোগব্যাধি আমাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে তখন কাজের আশ্রয় নিই, কেননা আমার ভেতরের যন্ত্রণার সবচেয়ে উত্তম প্রতিষেধক হচ্ছে কাজ।'
মূলত জীবনকে সুন্দর করার জন্যই ইসলাম ধর্মে কাজের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং অলসতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যে নিজ হাতে রোজগার করে জীবিকা নির্বাহ করে, সেই হাতকে বলা হয়েছে শ্রেষ্ঠ। আর অলস মস্তিষ্ককে বলা হয়েছে 'শয়তানের আখড়া'।
পরিশ্রম যেমন সাফল্য আনে তেমনি অলসতা মানুষের ধ্বংস ডেকে আনে। অলস মানুষরা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর মানুষ অলসতা করে।
বন্ধুরা, আজকের আসরে আমরা এক অলস যুবকের গুপ্তধন খোঁজা সম্পর্কে একটি গল্প শোনাব। তাহলে গল্পটি শোনা যাক।
পুরনো দিনের কথা। একটা গরীব লোক ছিল সাংঘাতিক অলস। মূলত যারা অলস কিংবা বেকার সময় কাটাতে অভ্যস্ত তারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গরীব হয়। এই লোকটাও ছিল সেরকম। তরতাজা যুবক হবার পরও সে একেবারেই কোনো কাজকাম করত না। ঘরে বসে থাকত। দিন নেই রাত নেই খালি ইবাদাত করত, দোয়া করত আর আল্লাহর কাছে খাবার চাইত, রুটি রুজি চাইত। সে আল্লাহর কাছে চাইত কোনোরকম কষ্ট বা পরিশ্রম ছাড়া হালাল রুজি যেন তার নসিবে হয়। দিনের পর সপ্তাহ, সপ্তা শেষে মাস যায় বছর যায় আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য কোনো সম্পদই এল না। যখনই তার খিদে লাগত ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে মানুষের কাছ থেকে ভিক্ষুকের মতো হাত পেতে চেয়ে নিয়ে খেত।
হঠাৎ একদিন ঘটে গেল অদ্ভুত এক ঘটনা। এক রাতে সে যথারীতি নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে রুটি-রুজি চেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমে ভেতর স্বপ্নে দেখে এক লোক তাকে বলছে: “হে অলস যুবক! তোমাকে একটা গুপ্তধনের সন্ধান দিচ্ছি। তবে এজন্য একটু চেষ্টা তদবির করতে হবে। অলসতা দূর করতে হবে। নৈলে এই গুপ্তধন পাবে না।"
অলস যুবক জিজ্ঞেস করল: গুপ্তধনের মাঝে কী আছে।
ওই লোক বলল: তোমার প্রতিবেশির দোকানে ফেলে দেওয়া কাগজগুলোর মাঝে একটা ছেঁড়া কাগজের টুকরো আছে। ওই টুকরোটা খুঁজে নিতে হবে। ওই টুকরো কাগজটা আসলে গুপ্তধনের ম্যাপ। ওই কাগজের টুকরোটা খুঁজে বের করতে পারলেই গুপ্তধন কীভাবে খুঁজে পাবে কিংবা সেগুলো নিয়ে কী করে ফিরে আসবে সব নির্দেশনা পেয়ে যাবে।
মনে রাখবে- এই গুপ্তধন শুধুই তোমার জন্য, অন্য কারও হাতে যদি এই গাঞ্জনামা বা গুপ্তধনের ম্যাপ পড়েও সে কাজে লাগাতে পারবে না। তবুও তুমি চেষ্টা করবে গোপনে চুপিচুপি কাজটা করতে, কেউ যাতে বিষয়টা টের না পায়। কাগজের টুকরো খুঁজে পেলে একটা নিরিবিলি আর ফাঁকা জায়গায় গিয়ে নকশাটা দেখবে, এ কাজে কাউকেই তোমার সাথে রাখবে না।”
এরপর অলস আর গরিব যুবকের ঘুম ভেঙে গেল। ভীষণ আনন্দিত সে। পরদিন রাতের বেলা অলস যুবক গেল প্রতিবেশির দোকানে। গভীর মনোযোগের সাথে স্বপ্নে দেখা সেই পুরনো ছেঁড়া কাগজ খুঁজতে লাগল। দোকানদারকে হাসি-ঠাট্টায় মগ্ন রেখে সে গাঞ্জনামা খুঁজে পেল। জামার ভেতর লুকিয়ে ফেলল তা। পরে শহরের বাইরে একটা খোলা জায়গায় গিয়ে খুলল।
গাঞ্জনামায় লেখা ছিল: শহরের বাইরে প্রাচীন একটা কেল্লা আছে, অনেকটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। ওই কেল্লার পেছনে একটা গম্বুজ আছে। সেখানে গিয়ে কেল্লার দিকে পিঠ দিয়ে কেবলামুখি হয়ে দাঁড়াবে। এরপর ধনুকে একটা তীর লাগিয়ে ছুঁড়বে। তীরটা যেখানে গিয়ে বিঁধবে সেখানে খনন করবে। যত বেশি গুপ্তধন চাইবে তত বেশি তীর ছুঁড়বে।
অলস যুবক ঠিকঠাকমতো সব করল এবং যেখানে তীর এসে পড়ল খনন করল। অনেক মাটি খুঁড়েও কোনো গুপ্তধনের সন্ধান পেল না। সে মনে মনে ভাবলো হয়তো তীর মারতে ভুল হয়েছে। এই ভেবে সে আবারও তীর মারল। এবারও তীর যেখানে পড়ল খুঁড়ল। কিন্তু কোনো কাজ হল না। যুবক হাল ছাড়ছে না।
প্রতিদিনই সে ওখানে যায়, তীর ছোঁড়ে এবং মাটি খোঁড়ে। কিন্তু গুপ্তধন মেলে না। যুবক কিন্তু হাল ছাড়ে না। হতাশ হয় না। ভাবে, তীর ছোঁড়ার মাঝে নিশ্চয়ই কোনো ভুল হচ্ছে। কিন্তু প্রতিদিন যুবকের একাজ এবং মাটি খোঁড়ার ব্যাপারটা মানুষের চোখে পড়ে গেল।
জনগণ তাকে ফলো করতে শুরু করল। লুকিয়ে লুকিয়ে তার কাজকর্ম দেখে লোকজন বুঝে ফেলল যুবক কোনো গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে। এই খবর হাওয়ার বেগে পৌঁছে গেল বাদশার কানে। বাদশা আদেশ দিল যুবককে তার সামনে হাজির করতে। তাই করা হল। বাদশা যুবককে জিজ্ঞেস করল: ‘ঘটনা কী বল! শুনলাম গাঞ্জনামা পেয়েছ। ওই গাঞ্জনামা আর মাটি খুঁড়ে যেসব গুপ্তধন পেয়েছ সেগুলো দাও, তাহলে তোমাকে মুক্তি দেব’।
যুবক ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। সে পুরো ঘটনা বাদশাকে খুলে বলল। গাঞ্জনামা বাদশার হাতে দিয়ে কসম করে বলল: এখন পর্যন্ত একটা কানাকড়িও পাই নি। এই গাঞ্জনামাটা আসলে ভুয়া। বাদশা ভেবেছিল যুবক মিথ্যা বলছে। আদেশ দিল যুবকের ঘর তল্লাশি করতে এবং গুপ্তধনের কোনো সন্ধান পেলে তার কাছে জমা দিতে। সেপাইরা যুবকের ঘর তল্লাশি করলো কিন্তু কিছুই পেল না। বাদশা এবার যুবককে ছেড়ে দিতে আদেশ দিল।
তারপর আদেশ দিল উন্নত মানের তীর কামান হাজির করতে। দলবল নিয়ে বাদশা নিজেই সেখানে গেলেন। তীর মারলেন এবং তীর যেখানে পড়ল সেখানে খুঁড়তে বললেন। খোঁড়া হলো কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না।
লোভী বাদশা একে একে ছয় মাস গুপ্তধনের খোঁজে তীর ছুড়লেন, মাটি খুঁড়লেন, কাজ হলো না। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে শত শত কূপ তৈরি হল। ওই এলাকায় চলাফেরা করাটাই কঠিন হয়ে পড়ল। বাদশা হতাশ হয়ে পড়ল। আদেশ দিল গর্তগুলো পূরণ করে ফেলতে এবং ওই যুবককে ডেকে আনতে। যুবক আসার পর তার ওপর বাদশার নজর পড়তেই গাঞ্জনামাটা তার দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল: নাও! এই হলো তোর ভুয়া গাঞ্জনামা! ছয় ছয়টা মাস আমার মূল্যবান সময় নষ্ট হলো এর পেছনে।
যুবক বলল: মহারাজ! আমি তো বলেছিলাম এটা একটা ভুয়া গাঞ্জনামা, আমাকেও প্রতারিত করেছে।
বাদশা বলল: তোর গাঞ্জনামা নিয়ে এখান থেকে ভাগ! যা, যদি গুপ্তধন পাস সেটা তোর, আমাকে দিতে হবে না। কিন্তু যদি না পাস হতাশ হবি না, আরেকটার সন্ধানে লেগে যা, যে গুপ্তধন কষ্ট ও শ্রমের মাধ্যমে অর্জিত হয়।
যুবক গাঞ্জনামাটা নিয়ে ঘরে ফিরে গেল। রাতের বেলা আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে তার চাওয়া-পাওয়ার কথা বলল: "হে খোদা! আমাকে ক্ষমা করো! আমি লোভ করেছি। বিনাশ্রমে তোমার কাছ থেকে গুপ্তধন চেয়েছি। এখন তোমার দরবারে তওবা করছি। আমার তওবা তুমি কবুল করো! আমাকে ক্ষমা করে দাও! এ ধরনের আশা আমি আর কখনোই করব না।"
এরপর কয়েকদিন কয়েক রাত কেটে গেল। হঠাৎ আরেক রাতে সে স্বপ্ন দেখলো। ওই আগের লোকটাই স্বপ্নে দেখা দিল। কেন সে গুপ্তধন খুঁজে পায়নি তার কারণ বুঝিয়ে দিল। বলল: গাঞ্জনামাতে যা লেখা ছিল সেগুলো ভুল বুঝেছ। গাঞ্জনামায় লেখা ছিল- কামানে তীর লাগিয়ে ফেলে দাও! ব্যস। এটুকুই। তোমাকে কে বলেছে তীর ছুঁড়ে মারতে? তাও আবার সর্বশক্তি দিয়ে?
তুমি আসলে গুপ্তধন পাবার জন্য তাড়াহুড়ো করেছো। সে জন্য গাঞ্জনামাটা ভালো করে পড়নি তাই বুঝতে পারনি কী করতে হবে। তোমাকে তো বলা হয় নি কামানের জ্যা-তে ধনুক ভালো করে টেনে লাগিয়ে ছুঁড়ে মারতে। তুমি তীরটাকে কামানে আলতো করে লাগাও যাতে তীর নিজে নিজেই মাটির ওপর পড়ে। তীর যেখানেই পড়বে সেখানেই খুঁড়বে।
যুবক ঘুম থেকে জেগে উঠে গাঞ্জনামাটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখল আবার। দেখলো স্বপ্নে দেখা লোকটার কথাই ঠিক। গাঞ্জনামায় কোত্থাও তীর ছুঁড়ে মারার কথা নেই। যুবক এবার ঠিকঠাকমতো আবারও গেল সেই পুরনো কেল্লার পেছনে। গাঞ্জনামার লেখা অনুযায়ী ধনুকে তীর রাখল এবং গাঞ্জনামার নির্দেশনা ঠিকঠাকমতো পালন করল। কিছুক্ষণ পর তীর তার পায়ের সামনে মাটিতে পড়ল। সেখানে ভালো করে খুঁড়ল এবং প্রচুর পরিমাণ গুপ্তধন পেল।
বন্ধুরা, অলস যুবকের গুপ্তধন পাওয়ার গল্পটি শুনলে। এ গল্প থেকে আমরা যে শিক্ষাটি নিতে পারি তা হল- "প্রতিটি মানুষের উচিত অন্যত্র নয়, নিজের ভেতরেই গুপ্তধন খুঁজে বের করা, কেননা প্রকৃত গুপ্তধন মানুষের নিজের ভেতরেই রয়েছে।”