মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ : লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ হলো ঈমানের কলেমা। এই কলেমার কিছু দাবি বা শর্ত আছে। নিম্নে সেগুলো বর্ণনা করা হলো—
কলেমা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন : এ বিষয়ে জানা যে আল্লাহ ছাড়া সব উপাস্য অস্বীকার করে একমাত্র আল্লাহকে ইলাহ বলে স্বীকার করা এবং এ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান থাকা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর জেনে রেখো, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই।’ (সুরা : মুহাম্মাদ, আয়াত : ১৯)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মারা গেল যে জীবিত অবস্থায় সে জানত, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। অবশ্যই সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (সহিহ মুসলিম)
দৃঢ়বিশ্বাস পোষণ করা : কোনো ধরনের সন্দেহ ছাড়া ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর বিশ্বাস অন্তরে পূর্ণভাবে থাকতে হবে। কলেমাকে এমন পরিপূর্ণভাবে জানতে হবে, যাতে সংশয়-সন্দেহ না থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন, সত্যিকারের মুমিন তারাই, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ওপর ঈমান এনেছে এবং ঈমান আনার পর তাতে কোনো ধরনের সন্দেহ পোষণ করে না।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১৫)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, আমি তাঁর রাসুল। যে ব্যক্তি এতে কোনো ধরনের সন্দেহ পোষণ না করে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে, সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (সহিহ মুসলিম)
অন্তর ও মুখে স্বীকার করা : লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর দাবি হলো, এই কলেমা মুখে ও অন্তরে স্বীকার করা। মুশরিকদের অবস্থা বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের যখন বলা হতো, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তখন তারা অহংকার করত এবং বলত একজন পাগল কবির কথায় আমরা কি আমাদের উপাস্যগুলোকে পরিত্যাগ করব?’ (সুরা : সাফ্ফাত, আয়াত : ৩৫-৩৬)
এ আয়াতের তাফসিরে ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, মুমিনরা যেভাবে এ কলেমা মুখে উচ্চারণ করতেন, ঠিক তার বিপরীত কাফিররা তা বলতে অস্বীকার করত অহংকারের কারণে। কলেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মুখে উচ্চারণ করার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, “আমাকে আদেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত লোকেরা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ না বলবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। যখন কেউ তা মেনে নেবে ও মুখে উচ্চারণ করবে, তখন তার জীবন ও সম্পদ আমার কাছ থেকে নিরাপদ। তবে ইসলামের যে হক বা দায়িত্ব আছে, তা আদায় করতে হবে এবং তার হিসাব নেবেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা।” (বুখারি ও মুসলিম)
আত্মসমপর্ণ ও যথাযথ অনুসরণ করা : এই ঈমানের কলেমা জীবনের সব ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণ করার তাগিদ দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা তোমাদের রবের দিকে প্রত্যাবর্তন করো এবং তাঁর কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করো।’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ৫৪)
কলেমার দাবিতে সত্যবাদী হওয়া : এই কলেমা পাঠকারীর দায়িত্ব হলো অন্তরে সর্বান্তকরণে কলেমা উচ্চারণ করা এবং এই দাবিতে সত্যবাদী হওয়া। আল্লাহ তাআলা মানুষকে সাবধান করে বলেন, “আলিফ লাম-মিম। লোকেরা কি ভেবে নিয়েছে যে ‘আমরা ঈমান এনেছি’—এ কথা বললেই তারা নিরাপদ হয়ে যাবে আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদেরও পরীক্ষা করেছিলাম; অতএব আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নেবেন মিথ্যুকদের।” (সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ১-৩)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যদি কেউ খাঁটি অন্তরে সাক্ষ্য দেয় যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসুল, তাহলে আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেবেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ইখলাস : ইখলাস হচ্ছে নিয়ত বিশুদ্ধ করে যাবতীয় শিরক থেকে নিজেকে দূরে রেখে নেক আমল করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের আদেশ দেওয়া হয়েছে ইখলাসের সঙ্গে আল্লাহর আনুগত্যসহ ইবাদত করতে।’ (সুরা : বাইয়্যিনাহ, আয়াত : ৫)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “কিয়ামতের দিন আমার শাফায়াত পাওয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান হবে ওই ব্যক্তি, যে অন্তর থেকে ইখলাসের সঙ্গে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ স্বীকার করে।” (বুখারি)
রাসুল (সা.) আরো বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা ওই ব্যক্তির জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিয়েছেন, যে একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে।” (বুখারি)
কলেমা তায়্যিবার প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা : কলেমার দাবি হলো, যেসব মুমিন ঈমানের দাবি মানবে, মানুষ শুধু তাদেরই ভালোবাসবে এবং যারা তা মানবে না, তাদের ঘৃণা করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘মানুষের মাঝে এমন লোকও আছে যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে তাঁর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে যেমন ভালোবাসতে হয় তেমন তাদের ভালোবাসে। কিন্তু যারা প্রকৃত ঈমানদার, আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা আরো মজবুত।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৬৫)
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তিনটি জিনিস যার মধ্যে আছে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ সে-ই পাবে : এক. তার অন্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ভালোবাসা সবচেয়ে বেশি হবে। দুই. যেকোনো ব্যক্তির সঙ্গে শুধু আল্লাহর জন্যই ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে। তিন. ঈমানের পর কুফরির দিকে ফিরে যাওয়া তার কাছে এরূপ অপছন্দনীয়, যেরূপ আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া অপছন্দনীয়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
তাগুতের প্রতি কুফরি করা : তাগুত হলো ওই সব বাতিল উপাস্য, আল্লাহকে ছাড়া যাদের উপাসনা করা হয়। সুতরাং কলেমা পাঠকারী এগুলো বর্জন করবে, এটাই স্বাভাবিক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি তাগুতদের অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে, নিশ্চয়ই সে এমন এক শক্ত বন্ধনকে আঁকড়ে ধরল, যা ছুটবার নয়।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৫৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি অন্তর থেকে বলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং আল্লাহ ছাড়া যেসব উপাস্যে উপাসনা করা হয় তা অস্বীকার করে, তার জীবন ও সম্পদ (নষ্ট করা) অন্যের জন্য হারাম।” (সহিহ মুসলিম)
মহান আল্লাহ, ঈমানের দাবি মেনে জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন।