আল ফাতাহ মামুন : পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘প্রতিটি প্রজন্মের জন্যই অবকাশের একটি নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। যখন তা শেষ হয়ে যাবে, তখন অবকাশের জন্য আর একটি মুহূর্তও তারা পাবে না। আবার এক মুহূর্ত আগেও তাদের অবকাশকাল শেষ হবে না’ (সূরা আরাফ, আয়াত ৩৪)।
ভারতের খ্যাতনামা ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ‘মালিকিয়াও মিদদিন’-এর তাফসিরে লিখেন, পবিত্র কোরআনে আজাল শব্দটি একটি নির্দিষ্টকাল, যুগ বা সময় বোঝাতে ব্যবহার হয়েছে। ‘প্রতিটি প্রজন্মের জন্যই একটি আজাল রয়েছে’ কথাটির অর্থ হল- মহান আল্লাহ মানুষের জন্য একটি সময় ও সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যে সীমা টপকে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আল্লাহ বান্দাকে অবকাশ-সময় দিতে থাকেন।
যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা ওই সীমার মধ্যে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত টুকটাক গোনাহখাতা করলেও খোদায়ী আজাব তাকে স্পর্শ করে না। এটি ব্যক্তি এবং পুরো প্রজন্মের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর একটি সাধারণ আইন। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি ও প্রজন্ম খোদায়ী সীমার বাইরে না যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা ওই জাতিকে অবকাশ দিতেই থাকেন। পূর্ববর্তী প্রজন্মগুলোর ধ্বংসের কারণ বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায়, তারা আসলে খোদায়ী দেয়াল টপকে যাওয়ার কারণেই ধ্বংসের গর্তে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে।
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ লিখেন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপারেও আল্লাহতায়ালার একই নীতি। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো প্রজন্ম সহনীয় মাত্রায় জীবন ও প্রকৃতি ধ্বংস করতে থাকবে এবং পাশাপাশি গড়তে থাকবে- আর ভাঙার চেয়ে গড়ার পরিমাণ বেশি হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ ওই জাতিকে আজাব থেকে অবকাশ দেবেন।
পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, আমি যখনই কোনো প্রজন্মকে আজাবে ফেলার সিদ্ধান্ত নিই, তাদের জন্য পাপ ও ধ্বংসের কাজ সহজ করে দিই। এতে করে সহজেই তারা সীমালঙ্ঘন করে বসে। ফলে আমার আজাব তাদের চিরতরে ধ্বংস করে দেয়।
আজকের পৃথিবীর দিকে তাকালে সচেতন ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করবেন, আধুনিক বিজ্ঞান জীবনযাত্রা সহজ করার জন্য যেসব আবিষ্কার করেছে, মানুষ সেগুলোর এমনই সীমাতিরিক্ত ব্যবহার করছে, বিজ্ঞানীরাই আঁতকে উঠছেন; হতবাক হচ্ছেন এবং যন্ত্রের এ ভয়াবহ মোহ থেকে মানুষকে দূরে থাকার জোর পরামর্শ দিচ্ছেন। কথা ছিল, মানুষ যন্ত্র ব্যবহার করে জীবন সহজ করবে; কিন্তু ভয়ংকর সত্য হল, যন্ত্রই এখন মানুষকে ব্যবহার করছে।
যাত্রী যদি নেশায় বুঁদ হয়ে ঘোড়াকেই নিজের কাঁধে চড়িয়ে নেয়, সে যাত্রীর গন্তব্যে পৌঁছা যতটা অসম্ভব, তার চেয়ে বেশি অসম্ভব যন্ত্রসভ্যতার যন্ত্রাসক্ত মানুষের শান্তি-মুক্তি-সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপন করা। অতিরিক্ত যন্ত্রনির্ভরতার ফলে বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানব সমাজ এবং মানবদেহ ভেঙে পড়েছে। ফলে জীর্ণ পৃথিবী মেরামতের জন্য আল্লাহতায়ালা করোনা নামক মিস্ত্রিকে পাঠিয়েছেন আমাদের মাঝে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, করোনা খোদার আজাব; কিন্তু গভীর দৃষ্টিতে দেখলে বোঝা যাবে, খোদার করুণা হয়ে পৃথিবীবাসীর ওপর নাজিল হয়েছে করোনা। ‘আর-রাহমানির রাহিম’-এর তাফসিরে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ লিখেছেন, আল্লাহতায়ালার পুরো সত্তাটাই দয়া। তিনি যখন আজাব দেন, সেটিও দয়ারই আরেক রূপ। যেমন- পিতার শাসন সন্তানের জন্য মঙ্গল এবং করুণা হয়ে ঝরে পড়ে!
ভাবুন তো! করোনা এসে যদি আমাদের থমকে না দিত, মৃত্যু নিয়ে ভাবার অবসরটুকু কি আমরা পেতাম? চোখের সামনে ধনকুবেররা যদি বিনা চিকিৎসায় মারা না যেত, আমরা কি বুঝতাম দু’দিনের দুনিয়ায় অর্থবিত্ত কিছুই নয়। করোনাও যাদের খোদার পথে ফেরাতে পারেনি, চোখে যাদের আলো ফোটেনি- এদের দেখেও আমরা শিখতে পেরেছি আদ-সামুদ জাতি কেন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
আসলে আল্লাহ বারবার মানুষকে অবকাশ দিয়েছেন, মানুষ অবকাশকে সুবর্ণ সুযোগ ভেবে পাপের পথে, ধ্বংসের পথে আরও দুর্বার-দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে। আদ-সামুদ প্রজন্ম কিন্তু প্রযুক্তি শক্তিতে আমাদের চেয়ে এগিয়েছিল। তাদের প্রযুক্তির তুলনায় আমাদের প্রযুক্তি এখনও শিশুর হাতের খেলনামাত্র। অবকাশ শেষ হওয়া মাত্রই বড় করুণভাবে তারা পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে। অবশ্য তাদের প্রযুক্তি শক্তির এক-দুটো ক্ষুদ্র উদাহরণ আমাদের শিক্ষার জন্য আল্লাহ সংরক্ষণ করে রেখেছেন।
করোনাবর্ষের সূর্য আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে নতুন যে সূর্য উঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে, সে সূর্যে আমাদের জন্য সুখকর কোনো ঝলমলে আলো এখনও দেখা যাচ্ছে না। আমরা করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি- যুদ্ধ করতে হবে কারণ খোদার রাজ্যে মানুষই একমাত্র সৃষ্টি, যাকে তার পতন ঠেকানোর শক্তি ও কৌশল প্রভু নিজে শিখিয়ে দেন। করোনার ঢেউয়ে আমরা ভেসে যেতে পারি, আবার নতুন তরী ভাসিয়ে পৃথিবী ও মানবপ্রজন্মকে নতুন পথও দেখাতে পারি।
কিন্তু যে বিষয়টি ভুলে গেলে চলবে না, তা হল- মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ এবং কাতর কণ্ঠে ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া করোনামুক্তির সম্ভাবনা নেই। করোনারও একটি আজাল-মেয়াদ আছে। করোনার মেয়াদ শেষ হলে সে চলে যাবে, আসবে আরও বড় কোনো করোনা। যেমনটা পূর্ববর্তীদের ইতিহাসে দেখতে পাই।
তাই আসুন! মস্তিষ্ক দিয়ে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের পাশাপাশি হৃদয় দিয়ে প্রভুর কাছে ক্ষমা ও সাহায্য প্রার্থনা করি। প্রকৃতি-সমাজ ও দেহের ভারসাম্য বজায় রাখি। আশা করা যায়, আমাদের ব্রেনে করোনামুক্তির নির্ভুল ভ্যাকসিনের সূত্র দয়াময় প্রভু এলহাম করবেন।
মানুষ পরাজিত থাকুক, এমনটি কখনই আল্লাহর ইচ্ছা নয়। আবার মানুষ ঘুমিয়ে থাকুক, এটিও আল্লাহ চান না। বিশ্ববাসীকে জাগানোর জন্য করোনার এ ঢেউ আখেরে আমাদের জন্য মঙ্গল-শান্তি-কল্যাণই বয়ে আনবে। করোনায় যারা মারা গেছেন, সব বিশ্বাসী মানুষের পরকালীন জীবনের শান্তি ও মুক্তি মহান আল্লাহর কাছে কামনা করছি। আমিন।
লেখক : সাংবাদিক