ইসলাম ডেস্ক: বর্তমান সময়ে বিদেশের মাটিতে হাজার হাজার বাঙালি হাফেজ কুরআনের সুরে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছেন। রমজানের বরকতময় রাতগুলো তাদের তেলাওয়াতে হয়ে উঠছে আবেগঘন ও আবেশময়। কেউ কুরআন খতম করছেন তারাবিতে, কেউ কিয়ামুল লাইলে। দেশ-বর্ণ-ভাষার বৈষম্য ঘুচিয়ে এসব বাঙালি হাফেজরা বিদেশের মসজিদে বরিত হচ্ছেন হৃদয়ের মধ্যমণি হিসাবে। এমন চারজন হাফেজের গল্প।
১। হাফেজ আহমাদ যুবায়ের, সৌদি- বরিশালের পাথরঘাটার এ হাফেজ গতবছর তারাবি পড়িয়েছেন সৌদির হায়েত শহরে। তিনি বর্তমানে পড়ছেন মদিনা ইউনিভার্সিটির কুরআন ডিপার্টমেন্টে। দেশে হাফেজ হয়েছেন এবং শিক্ষকতা করেছেন প্রখ্যাত কারি নাজমুল হাসান সাহেবের ‘তাহফিজুল কুরআন ওয়াস সুন্নাহ’ মাদ্রাসায়।
তিনি বলেন, ‘আমি যখন তারাবি পড়ানোর জন্য নির্বাচিত হই, শায়খ আমাকে বললেন, প্রতি রাকাতে এক পৃষ্ঠা পড়তে পারবে?’ আমি বললাম, ‘এক পৃষ্ঠা নয়, এক রাকাতে এক পারাও পড়তে পারব।’
তিনি খুশি হলেন। আট রাকাত তারাবিতে আমি এক পারা করে পড়তে শুরু করি। সৌদির কয়েকজন মুসল্লি বিরক্তি প্রকাশ করল। কিন্তু হায়েত শহরের সাবেক আমির আবু আলী আমাকে বললেন, ‘তুমি তোমার মতোই পড়।’ তারপর এক পারা করেই পড়েছি। গত বছর তারাবি পড়ালেও এবার তারাবি পড়াচ্ছেন না হাফেজ আহমাদ যুবায়ের। করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
২। এইচএম মনিরুজ্জামান, আমেরিকা- মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানায় তার জন্ম। কুরআন হিফজ করেছেন বিক্রমপুর রাড়িখাল মাদ্রাসায়। তিন বছর ধরে তারাবি পড়ান আমেরিকার ঝকঝকে রুদ্দুরমাখা নিউইয়র্ক সিটিতে। মুন্সীগঞ্জ থেকে নিউইয়র্ক যাওয়ার একটি গল্প আছে।
তিনি বলেন, ‘এক বন্ধুর পীড়াপীড়িতে আমেরিকান অ্যাম্বাসিতে ভিসার জন্য দাঁড়াই। আশ্চর্যজনকভাবে খুব সহজে ভিসা পেয়েও যাই। কিন্তু আমেরিকায় গিয়ে কী করব? ভাবলাম, ওখানে কুরআনের খেদমত করা যায়। তারপর থেকেই ওখানে তারাবি পড়ানো এবং কুরআন শিক্ষা দেওয়া শুরু করি।’
হাফেজ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ইয়ামেন, মিসর, পাকিস্তান, ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশসহ বহু দেশের মানুষ আমার পেছনে তারাবি পড়েন। অনুভূতিটা অন্য রকম, খুব উচ্ছ্বাসময়। এ প্রাপ্তির সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা চলে না।’
তার সঙ্গেই তারাবি পড়ান আরেক বাংলাদেশি হাফেজ মাওলানা ইয়াকুব। তার বাড়ি চাঁদপুরে? হাফেজ মনিরুজ্জামান জানালেন, সামগ্রিক যোগ্যতার ভিত্তিতে বাংলাদেশি হাফেজদের চাহিদা নিউইয়র্কে বাড়ছে। এটা খুবই আনন্দ ও গর্বের বিষয়। করোনার প্রকোপ থাকলেও যথারীতি এবারও তিনি তারাবিতে কুরআন তেলাওয়াত শোনাচ্ছেন নিউইয়র্ক সিটির বাফেলো এলাকার মুসুল্লিদের।
৩। হাফেজ কারি সাইফুল ইসলাম, কাতার- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নয়নপুর সদরে তার বাড়ি। হিফজ সমাপ্ত করেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত হাফেজ কারি আবদুল হক সাহেবের কাছে, বাইতুন নূর তাহফিজুল কুরআনিল কারিম মাদ্রাসায়। এরপর ২০১১ সালে দাওরায়ে হাদিস শেষ করে ভর্তি হন কাতার ইউনিভার্সিটিতে।
কাতার ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ই সেনাবাহিনীর মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর একদিন সৌভাগ্যের দ্বার খুলে যায় তার। ডাক আসে কাতার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে। সেখানে দীর্ঘ আড়াই বছর তিনি খতিবের দায়িত্ব আঞ্জাম দেন।
এখন তিনি একটি সরকারি মসজিদে ইমাম ও খতিব হিসাবে নিয়োজিত আছেন। তিনি বলেন, ‘রমজানে এখন আমি সরকারি মসজিদে তারাবি পড়াই। পাশাপাশি এক শায়খের মসজিদে কিয়ামুল লাইল পড়াই। কুরআন খতম করি।’
৪। হাফেজ মাহমুদুল হাসান, কাতার- নেত্রকোনা আটপাড়ার হাফেজ মাহমুদুল হাসান তারাবি পড়ান কাতারের দোহায়। সেখানে তিনি নিয়মিত ইমামও। কুরআন হেফজ করেছেন উত্তরা বাইতুস সালাম মাদ্রাসায়। আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগে, ২০০৭ সালে তিনি কাতারে সরকারি ইমাম হিসাবে নিয়োগ পান।
তিনি বলেন, ‘কাতারে আট রাকাত তারাবি পড়ে সবাই। আমি আরবদের আট রাকাত পড়িয়ে আরও বারো রাকাত পড়ি বাংলাদেশিদের নিয়ে। তারাবিতে খতম করি। পাশাপাশি কিয়ামুল লাইলেও খতম করি। আমার প্রতি রমজানের রুটিন এটাই।’