বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৬, ০৯:৪০:০৭

কোরআনের তাফসিরকারী প্রথম নারী হাফেজা জেবুন নেছার জীবনকথা

কোরআনের তাফসিরকারী প্রথম নারী  হাফেজা জেবুন নেছার জীবনকথা

ইসলাম ডেস্ক : ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্য নারী ব্যক্তিত্ব জেবুন নেছা। জিন্দা পীরখ্যাত সম্রাট আওরঙ্গজেবের মেয়ে। বাবা আওরঙ্গজেব আলমগীর ছিলেন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতাপশালী শাসকদের একজন। প্রতাপশালী হলেও তিনি ছিলেন বিনয়ী, খোদাভীরু, ন্যায়পরায়ণ এবং আমানতদার শাসক। এলম ও জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি প্রবল অনুরাগ ছিল তার। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাতা নিতেন না।

নিজ হাতে কোরআন কপি করে সংসারের খরচ নির্বাহ করতেন। তার কপিকৃত কোরআনের একটি পারা এখনও দারুল উলুম দেওবন্দে সংরক্ষিত আছে। এলম ও জ্ঞান বিস্তারে তার ভূমিকা ছিল প্রবাদতুল্য। বিশ্বখ্যাত ফাতাওয়ার গ্রন্থ ফাতাওয়া আলমগিরি বা ফাতাওয়া হিন্দিয়া তার তত্ত্বাবধানেই সঙ্কলিত হয়েছিল। এ মহান শাসকের ঘরে ১০৪৭ মতান্তরে ১০৪৮ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন ইতিহাসের অমর মুসলিম নারী জেবুন নেছা।

এলমে দ্বীনের প্রতি বাবার প্রবল অনুরাগ মেয়ে জেবুন নেছাকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। বাবার যোগ্য তত্ত্বাবধানে জেবুন নেছা হয়ে উঠেছিলেন একজন মস্তবড় আলেমা ও জ্ঞানসাধক।

অল্প বয়সেই কোরআনের হাফেজা হয়েছিলেন। এনায়েতুল্লাহ কাশ্মীরির মা মরিয়মের কাছে তিনি ত্রিশ পারা কোরআন মুখস্থ করেন। ত্রিশ পারা মুখস্থ শেষ হলে সম্রাট তাকে ত্রিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দেন। আরবি ও ফার্সি ভাষায় তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। ছিলেন সুদক্ষ লিপিকার। নাসখ, তালিক ও শাফিয়াসহ নানা হস্তলিপিতে হয়ে ওঠেন তিনি দক্ষ।

শায়খ আহমাদ বিন আবু সাঈদ আমহাওয়িসহ বিখ্যাত সব আলেমের কাছে তিনি সুদক্ষ আলেমা হন। শায়খ মুহাম্মদ সাঈদ মাজানদানির কাছে শেখেন কবিতা ও সাহিত্যের নানা দিক। এতসব শিক্ষার বদৌলতেই তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম নারী তাফসির সঙ্কলক হিসেবে অর্জন করেছেন অনন্য কীর্তি। তার সঙ্কলিত তাফসির গ্রন্থটির নাম জাইবুত তাফসির।

বলা হয়ে থাকে, 'ইতিহাসের প্রথম তাফসিরের কিতাব, যার সঙ্কলক একজন নারী।' মুহাম্মাদ খায়র ইউসুফ মুফাসসিরদের তালিকা ও জীবনী সঙ্কলন করতে গিয়ে বলেন, 'আমি বাদশা আলমগীরকন্যা জেবুন নেছা ব্যতীত অন্য কোনো নারীর তাফসির গ্রন্থ দেখিনি।'

তবে মহীয়সী এ নারী তাফসিরের চেয়ে বেশি খ্যাতি লাভ করেছিলেন কাব্যপ্রতিভার গুণে। কোরআন তাফসির, জ্ঞানসাধনা এবং কাব্যচর্চায় ব্যস্ত থাকতেন বলে সংসার গড়েননি এ নারী।

'জেওয়ারে জেবুন নেছা' গ্রন্থে বলা হয়েছে, 'যেহেতু জেবুন নেছা দিবানিশি কাব্যানুশীলন ও পুস্তক অধ্যয়নরত থাকতেন এবং বিয়ে হলে অধ্যয়নে বিঘ্ন ঘটবে, তাই তিনি বিয়ের ঝামেলায় জড়াননি।'

বিখ্যাত হিন্দু লেখক লক্ষ্মীনারায়ণ 'গুলেরানা হস্তলিপি' গ্রন্থে লিখেছেন, 'জেবুন নেছা তৈমুর বংশীয় উজ্জ্বলতর আলোকবর্তিকা। এযুগের নারীকুলের মুকুটমণি। তার অধ্যবসায়, আরাধনা, কাব্যসাধনা এবং ধর্মপ্রবণতা তাকে সুনামের অধিকারিণী করেছে।'

তার লিখিত কবিতাগুলো সংরক্ষিত আছে 'জেবুল মানশাআত' নামক গ্রন্থে। কিন্তু এত খ্যাতি পাওয়ার পরও তিনি ছিলেন নিভৃতচারী কবি ও সাধক। পর্দার বেষ্টনে নিজেকে বেঁধে রেখেছিলেন শক্তভাবে। একবার ইরানের বাদশা 'দুররে আবলাক কাসে কামদিদা মওজুদ' (সাদা-কালো মিশ্রিত রঙের মতির প্রত্যক্ষদর্শী বিরল) লিখে সেদেশের বিখ্যাত কবিদের এর সঙ্গে মিলিয়ে অর্থ, ছন্দ ও তাৎপর্যপূর্ণ আরেকটি ছত্র প্রস্তুত করার আহ্বান জানালেন। কিন্তু কেউই সফল হলেন না। অবশেষে ভারতে পাঠানো হলো কবিতার ওই ছত্র। জেবুন নেছা লেখে দিলেন, 'মাগার আশকে বুতানে সুরমা আলুদ' (কিন্তু সুরমা পরা চোখের অশ্রুতে এই মোতির প্রাচুর্য)। ব্যস, ইরানসহ বিশ্বে এ মহীয়সী নারীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। ইরানের তরফ থেকে তাকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেয়ার জন্য দাওয়াত দেয়া হলো এই বলে, 'তোরা অ্যায় মাহজুবি বে পরদা দিদান আরজু দারম' (হে চন্দ্রাপেক্ষা সুন্দরী! আমাদের ব্যবধান দূর হোক। পর্দার বাইরে আপনার দর্শনের আশা নিয়ে আপনার কাছে যেতে চাই)। উত্তরে জেবুন নেছা লিখলেন, 'বুয়ে গুলদার বারগে গুল পুশিদাহ আম, দর বুসুখন বিনাদ মোরা' (পুষ্পের সুঘ্রাণের মতো আমি পুষ্পেই লুকিয়ে আছি। আমায় যে কেউ দেখতে চায় সে আমাকে দেখুক আমারই লেখায়।)

বহুমুখী গুণ ও প্রতিভার অধিকারী এ মহীয়সী নারী ছিলেন পর্দার ক্ষেত্রে সাহাবি নারীদের অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একারণে প্রতিভার ঝলক ও উজ্জ্বলতা শুধু লেখাতেই প্রকাশ করতেন, কখনও নিজে প্রকাশিত হতেন না। এ মহীয়সী নারী ১১১৩ হিজরিতে দিল্লিতে ইন্তেকাল করেন। লাহোরে তার প্রিয় গুলিস্তান সংলগ্ন স্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
২১ জানুয়ারি ২০১৬/এমটি নিউজ২৪ডটকম/এসএম/ডিআরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে