সোমবার, ০৪ এপ্রিল, ২০১৬, ০৯:৩০:৪৩

‘যিকিরের’ সঠিক অর্থ কোনটি?

‘যিকিরের’ সঠিক অর্থ কোনটি?

মুহাম্মদ আবু হুরায়রা : ইসলামী শরীয়ত মতে ‘যিকির’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। পবিত্র কোরআনুল কারীমের মধ্যে আল্লাহ তা’য়ালা বিভিন্ন আয়াতে সকাল -সন্ধ্যা যিকিরের কথা বলেছেন।  মহানবী (সা.) সদা সর্বদা যিকিরে মগ্ন থাকতেন এবং তিনি বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি জান্নাতে উচ্চ মাকাম কামনা করে, সে যেন বেশি বেশি যিকির করে’।  তিনি আরো বলেছেন: ‘তোমরা আমরণ যিকিরের মাধ্যমে তোমাদের জিহ্বাকে শিক্ত রাখ’।
 
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে ‘যিকির’-এর সঠিক অর্থ হারিয়ে ফেলেছে।  তথাকথিত ‘হক্কানী’ পীর সাহেবগণ জিকিরের হরেক রকম স্টাইল তৈরি করেছেন।  কোরআন ও হাদিসের দিক নির্দেশনার বাইরে গিয়ে যে যার ইচ্ছামত বিভিন্ন রকম জিকিরের প্রচলন করেছেন।  সাধারণ মানুষ কোনো উপায়ান্ত না পেয়ে ‘অন্ধের’ মত ‘হুজুর’ কে অনুসরণ করছেন।  অনেক মসজিদেই মাগরিবের নামজের পর ‘হালকায়ে জিকিরের’ মাহফিল হবে, আমরা সবাই বসি বহুত ফায়দা হবে শুনে থাকি।  কিন্তু এটা কি আদৌ যিকির কি না, আসুন কোরআনের আলোকে একটি বিশ্লেষণ দেখি।

পবিত্র কোরআনুল কারীমের মধ্যে যিকির শব্দটি মোট ২৬৮ বার এসেছে। এর মধ্যে ১৫৪ বার শব্দটি ফে’ল (ক্রিয়া) হিসেবে ব্যবহার হয়েছে আর ১১৪ বার ইসম (বিশেষ্য) হিসেবে।  মজার ব্যাপার হলো এই ‘যিকির’ শব্দটির এতই সুক্ষ্ম যে, শুধুমাত্র যের এর পরিবর্তে যাল অক্ষরের উপর যবর দিলেই উচ্চারণ হয় ‘যাকার’ এবং অর্থ দাঁড়ায় ‘পুরুষ’, যেমনটি সুরা আল ইমরানের ৩৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে: 'সেই কন্যার মত কোন পুরুষই যে নেই। আর আমি তার নাম রাখলাম মারইয়াম'।
 
এখানে আমরা পবিত্র কোরআনুল কারীমের মধ্যে ‘যিকির’ শব্দের বহুবিধ অর্থের মধ্য থেকে মাত্র কয়েকটি অর্থ দেখার চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ।

১।  যিকিরের এক নাম্বার অর্থ হলো : ‘আল কোরআন আল কারীম’।  এই অর্থের সমর্থনে অনেকগুলো কোরআনের আয়াত আছেঃ ‘আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ (আল কোরআন) অবতরণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক’ (১৫:৯) সুতরাং যিনি কোরআন তেলাওয়াত করছেন তিনি মূলত যিকির করছেন।  অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ ‘ অতএব, যে


আমার শাস্তিকে ভয় করে, তাকে কোরআনের মাধ্যমে উপদেশ দান করুন’।(৫০:৪৫) কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা কি কখনও তা মনে করি? আপনি যখন কোরআন তেলাওয়াত করেন, তখন যদি আপনাকে কেউ ফোন করে জিজ্ঞাস করে আপনি কি বলেন ‘আমি যিকির করছি’? হিফজখানার ছাত্ররা কি যিকির করছে না? এই আয়াত অনুযায়ী তাফসীরের মাহফিলে কি যিকির হচ্ছে না? যেটাকে আমরা হালাকায়ে যিকিরের নাম দিয়েছি তাতে কি কোরআনের দ্বারস্থ হয়? কোরানের আয়াত তেলাওয়াত করে ব্যাখ্যা করা হয়? যদি উত্তর ‘না’ হয়, তাহলে তো আমরা যিকিরকে ভুল অর্থেই ব্যবহার করলাম।

২।  যিকিরের দুই নাম্বার অর্থ হলো : ‘উপদেশ’/ নসিহাত করা। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন: ‘অতএব, যে আমার শাস্তিকে ভয় করে, তাকে কোরআনের মাধ্যমে উপদেশ দান করুন’। (৫০:৪৫) ‘এবং আপনি নসিহাত করতে থাকুন; কেননা, নসিহাত মুমিনদের উপকারে আসবে’ (৫১:৫৫)। সুতরাং প্রত্যেকটি ওয়াজ মাহফিল ই তো যিকিরের মাহফিল। আমার মনে হয়, খুব কম মানুষই আছে যারা যিকিরের এই অর্থ জানে বা মানে।

৩।  যিকিরের তিন নাম্বার অর্থ হলো : ‘নামাজ’।  আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ ‘মুমিনগণ, জুমার দিনে যখন নামাজের আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর যিকিরের (নামাজের) পানে ত্বরা কর এবং বেচাকেনা বন্ধ কর।  এটা তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বুঝ’(৬২:৯)।  অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ ‘তখন সে বলল: আমি তো আমার পরওয়ারদেগারের যিকির থেকে বিস্মৃত হয়ে (আসর নামাজ থেকে) সম্পদের মহব্বতে মুগ্ধ হয়ে পড়েছি-এমনকি সূর্য ডুবে গেছে’।(৩৮:৩২)

৪।  যিকিরের চার নাম্বার অর্থ হলো : ‘আল্লাহর বিধান’।  আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ ‘এবং যে আমার স্মরণ থেকে/ বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব’।(২০:১২৪)

৫।  যিকিরের পাঁচ নাম্বার অর্থ হলঃ ‘স্মরণ করা বা উল্লেখ করা: ‘আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ এই কিতাবে মারইয়ামের কথা বর্ণনা করুন, যখন সে তার পরিবারের লোকজন থেকে পৃথক হয়ে পূর্বদিকে এক স্থানে আশ্রয় নিল।(১৯:১৬)

৬।  যিকিরের আর এক অর্থ হলো ‘মর্যাদা’ :  আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ ‘আমি তোমাদের প্রতি একটি কিতাব অবর্তীর্ণ করেছি; এতে তোমাদের জন্য যিকির (মর্যাদা) রয়েছে।  তোমরা কি বোঝ না? (২১:১০), ‘এটা আপনার ও আপনার সম্প্রদায়ের জন্যে যিকির (মর্যাদা) হয়ে  থাকবে এবং শীঘ্রই আপনারা জিজ্ঞাসিত হবেন’।(৪৩:৪৪)

৭। যিকিরের আর এক অর্থ হলো : ‘আল্লাহকে ডাকা, স্মরণ করা, যিকির করা’।  আল্লাহ তা’য়ালা বলেন : ‘অতঃপর যখন তোমরা নামায সম্পন্ন কর, তখন দন্ডায়মান,উপবিষ্ট ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ কর।  অতঃপর যখন বিপদমুক্ত হয়ে যাও, তখন নামায ঠিক করে পড়।নিশ্চয় নামাজ মুসলমানদের উপর ফরজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে’।(৪:১০৩)‘মুমিনগণ তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর’।(৩৩:৪১)

এখানে যে অর্থগুলো উল্লেখ করা হয়েছে তা অধিকাংশ মুফাসসিরীণদের মতামত এবং এই অর্থ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোন দ্বিমত নেই।  প্রশ্ন হলো এই অর্থ গুলোর মধ্যে কোনটি এক নাম্বার? আমি বলব অবশ্যই প্রথমটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং এটিই নম্বার ওয়ান।  কারণ হিসেবে আমি মিসরের একজন বিখ্যাত গবেষক মোস্তফা ফাহমীর ওয়েব সাইট থেকে তথ্য উল্লেখ করছি।

তিনি বলেছেনঃ ‘কোরআনুল কারীমের মধ্যে প্রায় ১২টা সুরার মধ্যে প্রায় ৫০টি আয়াত আছে যেখানে এই ‘যিকির’ এর পরে নবী-রাসুল, অহী, পূর্ববর্তী কিতাব, উল্লেখ আছে এবং এর দ্বারা ওই কিতাব এর মাধ্যমে উপদেশের  কথা বলা হচ্ছে।  সুতরাং ‘যিকির’ মানে হরো ‘এমন উপদেশ যা কিতাবের মাধ্যমে দেয়া হয়, এমন নিয়মনীতি যা কিতাবে উল্লেখ আছে।  

সুতরাং যার সাথে কিতাবের সম্পর্ক আছে তাই যিকির, যা কিতাবের বাইরে তা যিকির নয়’।  তাঁর এই যুক্তির পক্ষে আরও একটি গবেষণা পাওয়া যায় যে, হুরুফুল মুকাত্তায়াত (বিচ্ছিন্ন আক্ষর) বলতে কি বোঝায়? অনেক উত্তরের মধ্যে আমার মনে হয় ওই উত্তরটাই অধিকতর সঠিক, যারা বলেছেন ‘এর দ্বারা কোরআনের মুজি’যা বোঝানো হয়েছে’।  কারণ হলো মোট ২৯টি সুরার মধ্যে ২৭টি সুরাতেই এই হুরুফুল মুকাত্তা’আত, এরপর ‘কোরআনের’ কথা উল্লেখ আছে।

(লেখক : আল আযহার ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েট ও ইমাম, মাসজিদ সেন্ট মেরিস, সিডনী। )
৪ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে