বুধবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৬, ০৫:০০:৫৬

নামাজের মাধ্যমেই শুধুমাত্র আল্লাহর দিদার পাওয়া যায় (২য় পর্ব)

নামাজের মাধ্যমেই শুধুমাত্র আল্লাহর দিদার পাওয়া যায় (২য় পর্ব)

ইসলাম ডেস্ক : ইবাদাত করা মানুষের মৌলিক একটি প্রয়োজনীয়তা। এই প্রয়োজনীয়তা আভ্যন্তরীণ এবং ইবাদাতের মাধ্যমেই তার চাহিদাটা মেটানো হয়। আমরা আমাদের নিজেদের স্রষ্টার জন্যে নামাজ পড়ি, রুকুতে যাই, সিজদা করি এবং তাকে সকল দোষ-ত্রুটি আর দূষণ থেকে পবিত্র বলে মনে করি। তিনিই একমাত্র সকল প্রশংসার যোগ্য মহান স্রষ্টা। তাঁর কোনো শরীক নেই।

ইবাদাত ও প্রার্থনা আল্লাহর নবীদের মৌলিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। কোনো নবীর শিক্ষাই ইবাদাতবিহীন ছিল না। ইসলামী ইবাদাতের বৈশিষ্ট্য হলো মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও দর্শন ভিত্তিক এবং ইসলামী ইবাদাতগুলো জীবনার্থের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এদিক থেকে এ ধরনের ইবাদাতগুলো মানুষের অবস্থার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং এ ইবাদাত মানুষকে পূত-পবিত্রতায় পরিবর্তিত করে।

নামাজের মতো ইসলামের বহু ইবাদাত যৌথ বা সামষ্টিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। ইসলাম ব্যক্তিগত ইবাদাতগুলোকেও এমনভাবে বিন্যস্ত করেছে যে জীবনের কোনো কোনো দায়িত্ব বা করণীয় পালন করার সাথে ইবাদাতগুলো সংশ্লিষ্ট। যেমন নামাজের কথাই ধরা যাক। নামাজ বিশ্বের সৃষ্টিকর্তার সামনে মানুষের বন্দেগির বা গোলামির প্রকাশ। এই নামাজের রয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু আচরণমালা বা হুকুম-আহকাম। এমনকি মানুষ যখন একাকি নামাজ পড়ে, তখনো সে নৈতিক ও সামাজিক কিছু নীতিমালা মেনে চলে। যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা,সময়-সচেতনতা,অপরের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ইত্যাদি নীতিমালা মেনে চলে এবং আল্লাহর উপযুক্ত বান্দাদের সাথে সম্পৃক্ত হবার আকাঙ্ক্ষা ঘোষণা করে।
ইবাদাত করার মাধ্যমে আল্লাহর গুণগান করার পাশাপাশি মানুষের আত্মিক এবং মানসিক ভারসাম্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। নামাজ অন্তরাত্মাকে উদ্বেলিত করে এবং মানসিক প্রশান্তির একটি অন্যতম উপাদান। প্রকৃত ও যথার্থ নামাজের মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তর থেকে সকল প্রকার অপবিত্রতা ও কলুষতা দূর হয়ে যায়। এ কারণেই হয়তো ইমাম আলী (আ) বলেছেন-আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার পর নামাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। নবী করিম (সা) ও বলেছেন-নামাজ হলো একটা পানির ঝর্ণাধারার মতো যা মানুষের ঘরেই রয়েছে আর মানুষ প্রতিদিন পাঁচবার তাতে গোসল করে।

অবশ্য বিভিন্ন ধর্মাদর্শে ইবাদাত বন্দেগির রূপ বিভিন্ন রকম। কেউ খোদার ইবাদাত করে ভাষিক এবং শব্দগত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে। আবার কেউ করে রোযা রাখা,রুকু-সেজদা করার মতো কিছু আমলের মাধ্যমে। আবার কিছু কিছু ইবাদাত চিন্তাগত এবং আত্মিকও। চিন্তা হলো চেনা ও সচেতনতার মূল শেকড় এবং মানুষের পরিবর্তনের কারণ। সেজন্যে এই ইবাদাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সবার চেয়ে উত্তম বলে পরিগণিত। রাসূলে খোদা (সা) বলেছেন-এক ঘণ্টা চিন্তা করা সত্তুর বছরের ইবাদাতের চেয়ে উত্তম। সর্বোপরি ইসলামে সকল ভালো কাজই ইবাদাত বলে গণ্য। তাই লেখাপড়া করা, কাজ করা, সামাজিক ও পারিবারিক কাজকর্মও ইবাদাত।

ইবাদাত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো সচেতনতা এবং অন্তর দিয়ে চেনা। ইবাদাত যদি এই দেখা এবং জাগরণের সাথে না হয় অর্থাৎ সচেতনভাবে যদি ইবাদাত করা না হয়,তাহলে ঐ ইবাদাত ইবাদাতকারীকে গোঁড়ামি ও মূর্খতার দিকে নিয়ে যায়। ইমাম আলী (আ) এর সময় খাওয়ারেজ নামে গোঁড়া এবং মূর্খ একটি দল ছিল। অজ্ঞানতার কারণে ইসলাম সম্পর্কে তাদের ভ্রান্ত ধারণা ছিল। পার্থিব জগতের ব্যাপারে তারা ছিল উদাসীন। তারা ইবাদাতের মধ্য দিয়ে রাত কাটাতো কিন্তু ইসলামের সামগ্রিক শিক্ষা বা গভীর মর্ম তারা উপলব্ধি করতো না। তাদের ঐ ভুল ও বিকৃত চিন্তার ফলে ইসলামী উম্মাহর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

এরকম অন্ধ চিন্তা ও অনুর্বর মস্তিষ্কের অধিকারীদের একজন ছিল ইবনে মুলজেম। সে আলী (আ) এর মতো একজন ইনসানে কামেল ও খোদা প্রেমিককে শহীদ করেছিল। আলী (আ) এই মূর্খ গ্রুপটিকে হিংস্র,উন্নত চিন্তা ও উদার অনুভূতিশূণ্য শঠ বলে অভিহিত করে বলেছেন-সর্বপ্রথম এদেরকে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি,আচার-আচরণগুলো শেখানো উচিত। মহান মনীষী তথা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বগণের সদা উপদেশ ছিল ইবাদাতে চরমপন্থা বা উগ্রতা বর্জন করতে হবে যাতে মানুষের অন্তরে সবসময় ইবাদাতের প্রতি আগ্রহ উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়,যার ফলে জীবনের সকল ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়ে।
একদিন নবী করিম (সা) কে জানানো হলো যে,কতিপয় সাহাবী সবকিছু ছেড়ে দিয়ে কেবল ইবাদাতে মগ্ন হয়ে পড়েছে। রাসূল (সা) একথা শুনে অসন্তুষ্ট হয়ে মসজিদে গিয়ে বললেন-তোমাদের কোনো দলের হচ্ছেটা কী! শুনলাম এ..ই ধরনের কিছু লোক নাকি আমার উম্মাতের মধ্যে রয়েছে ! আমি তো তোমাদের নবী,আমি তো তা করি না,আমি কখনোই সকাল পর্যন্ত সারারাত ইবাদাত করি না,আমি রাতের একটা অংশে বিশ্রাম করি। আমি সকল দিন রোযা রাখি না,সংসারিক কাজে আত্মনিবেশ করি। যারা নিজেদের মতো করে কেবল ইবাদাত করাকে টার্গেট করে নিয়েছে তারা আমার সুন্নাতের বাইরে।

ইসলামের দৃষ্টিতে ইবাদাত হলো মানুষের জন্যে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা এবং আধ্যাত্মিক পূর্ণতা প্রাপ্তির বাহন। ইবাদাত জাগিয়ে তোলে এবং পথ দেখায়। ইবাদাত মানুষকে অলসতা থেকে মুক্তি দেয়। ইবাদাতের মাধ্যমে মানুষ নিজের অস্তিত্বের বাস্তবতায় উপনীত হয়। ইবাদাতের মধ্য দিয়ে যে সচেতনতা অর্জিত হয় তার ফলে মানুষ সত্য-সঠিক কাজ এবং নৈতিকতার শিক্ষা পায়। নামাজের মতো ইবাদাত হলো একধরনের মহৌষধ। তবে সেই নামাজ হতে হবে যথার্থ নামাজ। অর্থাৎ নামাজ আদায়কারী মনে মনে উপলব্ধি করবেন সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞানী সেই সামনে দাঁড়িয়েছি যে আল্লাহ সদা জাগ্রত। তাই আল্লাহর মহান সত্ত্বা ও শ্রেষ্ঠত্বকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করে নাামযে দাঁড়াতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাই পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন নামাজ পড়তে হবে সচেতনভাবে। সূরা নিসা'র ৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- "হে ঈমানদারগণ! তোমরা নেশায় বুঁদ থাকা অবস্থায় নামাজের ধারে-কাছেও যেয়ো না! যে পর্যন্ত না তোমরা বোঝো তোমরা কী বলছো!"

রাসূলে কারিম (সা) একদিন মসজিদে ঢুকলেন। দেখলেন মসজিদে দুটি গ্রুপ বৃত্তাকারে বসে কী কাজে যেন মনোনিবিষ্ট। তিনি দুটি গ্রুপকেই পর্যবেক্ষণ করলেন এবং খুশি হলেন। দুটি গ্রুপের একটি জিকির ও ইবাদাতে লিপ্ত ছিল,আর অপর গ্রুপটি জ্ঞান চর্চায় ব্যস্ত ছিল। পয়গাম্বর (সা) তাঁর সাথীদের দিকে তাকিয়ে বললেন-এই দুই গ্রুপই পূণ্য কাজ করছে। উভয়েই কল্যাণ ও সৌভাগ্যের পথে রয়েছে। কিন্তু আমাকে পাঠানো হয়েছে জ্ঞানী ও প্রশিক্ষিত করে তোলার জন্যে। এরপর তিনি জ্ঞান-অন্বেষীদের দলে গিয়ে বসলেন।

যে ব্যক্তি আন্তরিকতার সাথে ভালোবেসে ইবাদাত করে,সে তার মাধুর্য অনুভব করবে এবং বন্দেগি ও আনুগত্যের পর্যায়ে পৌঁছবে,আর এ অবস্থায় সে এক আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অনুসরণ করবে।
২০ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে