মঙ্গলবার, ১০ মে, ২০১৬, ০৫:৫৩:৩৫

নামাজ মানুষের মনকে কোমল ও নমনীয় করে তোলে (১৬ তম পর্ব)

নামাজ মানুষের মনকে কোমল ও নমনীয় করে তোলে (১৬ তম পর্ব)

ইসলাম ডেস্ক : প্রিয় পাঠক! নামাজের বিশ্লেষণমূলক ধারাবাহিক এই আলোচনায় আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। নামাজ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায়-শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার এ আসরে শুরু করছি সেই মহান আল্লাহর নাম নিয়ে, সমস্ত প্রশংসা ও গৌরব যাঁর প্রাপ্য, যিনি সমস্ত পূর্ণতা ও সৌন্দর্য্যের উৎস, যিনি সর্ব বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী, যাঁর স্মরণই সবচেয়ে বড় সম্পদ এবং যাঁর স্মরণেই রয়েছে সমস্ত কষ্টের নিশ্চিত প্রতিকার ও মহাপ্রশান্তি, যিনি সব ধরনের কল্যাণ বা মঙ্গলের আধার ও সব ধরনের বিপদ-আপদের একমাত্র ভরসা বা রক্ষাস্থল। আর পাঠক-ভাইবোনদের জানাচ্ছি অশেষ দোয়া, কল্যাণকামীতা, ইসলামী ভ্রাতৃত্ব, ভালোবাসা ও সহমর্মীতায় পরিপূর্ণ অসংখ্য সালাম এবং অফুরন্ত উষ্ণ শুভেচ্ছা। আর সবার জন্য দয়াময় ও মহান আল্লাহর কাছে কামনা করছি রহমত ও বরকতের বেহেশতী সৌরভে সিক্ত পবিত্র রজব, শাবান এবং রমজান মাসের সমস্ত কল্যাণ। আশা করছি মহান আল্লাহ এইসব পবিত্র মাসে আমাদের সবার নামাজ-রোজা ও সৎকর্ম কবুল করবেন এবং আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি লাভের পথে এগিয়ে নেবেন।
 
মহান আল্লাহর অশেষ দয়া ও রহমতের কোলে আশ্রয় নেয়া মানুষের সৌভাগ্যের সবচেয়ে বড় পাথেয়। তাই আমাদের উচিত মহান আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী, তাঁর কাছে প্রার্থনা ও তাঁর প্রেমে মশগুল হয়ে অন্তরাত্মাকে পবিত্রতা, সজীবতা এবং সৌন্দর্যে বিভূষিত করা। আর নামাজ এই মহাপ্রেমের ও মহামুক্তির সোনা-রূপার জিয়ন-কাঠি। কবির ভাষায়-
খোদার প্রেমের অমৃত পান করবো নামাজ-সাগরে
মন-প্রাণ উজাড় করবো নামাজের অশেষ রহস্যের আধারে
দেখবো আল্লাহর নূরের দীপ্তি, চাইবো তাঁর মিলন ও একাত্মতা
সমস্ত কল্যাণের ফুল ফল হয়ে ঝরে নামাজের প্রান্তরে।

নামাজের সুন্দরতম রূপ বা আত্মিক আকর্ষণগুলো ফুটে উঠেছে মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ বান্দা ও ওলি-আওলিয়াদের মধ্যে। নামাজের নূরের আলোয় আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ)'র জীবন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র ভাষ্য অনুযায়, আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ) যখন নামাজে মশগুল হতেন তখন আল্লাহর প্রেমের চেতনা ছাড়া তার মধ্যে অন্য কোনো কিছুর চেতনা থাকতো না।
একবার সিফফিনের যুদ্ধে সংঘাত যখন চরম পর্যায়ে তিনি সে সময় যুদ্ধের ময়দানে থেকেই বার বার সূর্য ও আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন।

উদ্দেশ্য, জোহরের নামাজের সময় হয়েছে কিনা তা দেখা এবং নামাজ আদায় করা। এ সময় আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ)'র একজন সঙ্গী তাঁর এই তৎপরতার কারণ বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানার পর বললেন, এমন তীব্র সংঘাতের সময়ও নামাজ আদায় করা কি জরুরী? উত্তরে মুমিনগণের নেতা বললেন, আমরা তো কেবল নামাজের জন্যই তাদের সাথে যুদ্ধ করছি এবং আমরা নামাজ কায়েম করতে চাচ্ছি। এভাবে আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ) সমাজে নামাজের সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবীত করার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা ও সাধনায় নিয়োজিত হয়েছিলেন।

সিফফিনের যুদ্ধ চলার সময় আরো এক ঘটনায় দেখা গেছে, একটি তীর আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ)'র পায়ে বিদ্ধ হল। চিকিৎসকরা বহু চেষ্টা করেও ঐ তীর ইমাম আলী (আঃ) পা থেকে বের করতে পারলেন না। কারণ, ঐ তীর বের করতে গেলে তিনি অসহ্য ব্যাথা ও যন্ত্রণা পেতেন। তখন চিকিৎসকরা বিষয়টি হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (আঃ)'র কাছে উত্থাপন করলেন। তিনি বললেন, আমার বাবার নামাজে মশগুল হওয়া পর্যন্ত আপনারা অপেক্ষা করুন, কারণ, নামাজের সময় কোনো কিছুই তাঁকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত রাখতে পারে না। এ অবস্থায় নামাজের সময় হলে আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ) যখন নামাজে মশগুল হলেন তখন আল্লাহর স্মরণে একাকার তাঁর দেহ থেকে ঐ তীর তুলে নেয়া হয়। কিন্তু তিনি কিছুই টের পেলেন না।

নামাজ শেষ হবার পর তিনি বুঝতে পারলেন যে তাঁর পা থেকে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন করলেন, কি ব্যাপার? তখন তাঁকে বলা হল, আপনি যখন নামাজে ছিলেন তখন আপনার পা থেকে তীর বের করা হয়েছে।
আমরা অনেকেই এ কথাটি হয়তো শুনেছি যে, শৈশবে শিশুকে যা শেখানো হয় তা পাথরে আঁকা খোদাই-কর্মের মতই অম্লান ও অমলিন থাকে। তাই আদব-কায়দা বা যে কোনো শিক্ষা কিংবা শিক্ষনীয় বিষয় শেখানোর সবচেয়ে ভালো সময় হল শৈশব। শৈশবের শিক্ষা মানুষের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রকে দৃঢ়তর করার জন্যও জরুরী।

মনোস্তাত্ত্বিকদের মতে, মানুষের ব্যক্তিত্বের ভিত্তি গড়ে ওঠে এই শৈশবেই। তাই শিশুকে সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়া সামাজিক উন্নয়নের জন্যই জরুরী। তবে শিশুর মানসিক বিকাশ ও সুস্থতার জন্য সবচেয়ে বেশী জরুরী বিষয় হল শিশুকে ধার্মিক পরিবার এবং ধার্মিক পিতা-মাতার সাহচর্যে রাখা। এ ধরনের পরিবারেই শিশু আল্লাহর প্রতি ভালবাসার পরিবেশে জীবনের সঠিক পথ বা মুক্তির পথে চলার শিক্ষা অর্জন করে এবং তা ভবিষ্যতের জন্যে তার মনে বদ্ধমূল হয়ে থাকে। সৌভাগ্যের গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা বিধানকারী ধর্ম ইসলামের প্রতি ভালবাসা বদ্ধমূল করার জন্য শৈশবের শিক্ষাই সবচেয়ে বেশী উপযোগী। ইসলাম পিতা-মাতাকে শিশুর জন্য সুন্দর নাম নির্বাচন করতে বলে। কারণ, সুন্দর নাম শিশুর সুন্দর ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব রাখে। অন্যদিকে শিশুর জন্য অনুপযোগী বা অসুন্দর নাম রাখা হলে তা শিশুর ব্যক্তিত্বকে খাটো করার শামিল এবং এর ফলে এ ধরনের শিশুর ব্যক্তিত্ব নড়বড়ে হয়ে পড়ে।

ধার্মিক পরিবারে জন্ম-নেয়া শিশু জন্মের পর পরই আযান ও নামাজের একামাত শুনে। তার কোমল আত্মার জন্য সেটাই প্রশান্তিদায়ক প্রথম শিশুতোষ-সঙ্গীত। দোয়া ও আযান শিশুর আধ্যাত্মিক চাহিদার প্রথম প্রাপ্তি। অন্যদিকে খাদ্য ও মায়ের দুধ তাকে বিভিন্ন মানসিক এবং শারীরিক রোগ থেকে রক্ষা করে। শিশুকে শৈশব থেকেই নামাজ ও প্রার্থনার মধুর ধ্বনির সাথে পরিচিত করতে বলা হয়েছে ধর্মীয় বর্ণনায়। মায়ের ও অন্য আপনজনদের নামাজ ও দোয়ার দৃশ্য এবং শব্দ প্রত্যক্ষভাবে শিশুর মানসিক জগতে প্রভাব ফেলে, ফলে শিশুর মন ও শরীরে এসব সুন্দর গুণ বা কাজের প্রতি আকর্ষণ স্থায়ী স্বভাব বা অভ্যাসের মত বদ্ধমূল হয়। এ ধরনের পরিবেশে বেড়ে-ওঠা শিশু তার ভবিষ্যত জীবনে নামাজ এবং দোয়া ও অন্যান্য এবাদতকে জীবনের অপরিহার্য কর্মসূচীতে পরিণত করে।

শৈশব ও কৈশরে নামাজ আদায়ের ফলে আল্লাহ, ধর্ম, ধর্মীয় মূল্যবোধর মত মহৎ বিষয়গুলো শিশুর মনে স্থায়ীভাবে শ্রদ্ধার আসন লাভ করে। আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ)'র ভাষায় শিশুর মন উর্বর জমির মত। এখানে যে বীজই বপন করা হোক না কেন জমি তা গ্রহণ করে। তাই শিশুর মনে ঈমানের বীজ বপনের ফলে তার মধ্যে ধর্মের প্রতি ও অর্থ বা উদ্দেশ্যপূর্ণ জীবনের প্রতি আকর্ষণ প্রবল হয় এবং পরবর্তিকালে শিশু নিজেকে অসার ও আত্মপরিচয়হীন অবস্থা থেকে সহজেই নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে।

কৈশরও অনেকটা শৈশবের মতই। কৈশরে পা দেয়ার পর শিশু আরো নতুন ও বৈচিত্রময় জগতের মধ্যে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। সামাজিক পরিবেশ ও সঙ্গী-সাথীদের আচরণ এ সময় তাকে প্রভাবিত করে। মনোস্তাত্ত্বিকদের মতে কিশোর-কিশোরীরা সহজেই বন্ধুদের কথায় প্রভাবিত হয়। খুব দ্রুত আবেগপ্রবণ হওয়া বা উত্তেজনায় ভোগা এই বয়সের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এ সময় যদি কোমলমতি কিশোর-কিশোরীরা আল্লাহর সান্নিধ্যের ধারণা ও এবাদতের মাধুর্যের স্বাদ পায়, তাহলে তাদেরকে অনেকাংশে বিপদমুক্ত রাখা সম্ভব এবং ভবিষ্যৎ মুক্তির পথে চলাও তাদের জন্য সহজ হবে। মানুষের ওপর নামাজের এতসব প্রভাবের কারণেই মহান আল্লাহ বিশ্বনবী (সাঃ)কে সম্বোধন করে বলেছেন, তুমি তোমার পরিবারবর্গকে নামাজের জন্য আদেশ দাও এবং তাতে অবিচলিত থাক। (সূরা ত্বাহা-১৩২)
১০ মে, ২০১৬ এমটিনিউজ/জহির/মো:জই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে