বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৫:৪২:০৩

লাশকাটা ঘরের অজানা কাহিনী

লাশকাটা ঘরের অজানা কাহিনী

আব্দুল আলীম  : শোনা গেল লাশকাটা ঘরে, নিয়ে গেছে তারে/ কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আঁধারে/ যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/ মরিবার হল তার সাধ। বধু শুয়েছিল পাশে, শিশুটিও ছিল; প্রেম ছিল, আশা ছিল/ জোছনায় তবু সে দেখিল কোন ভূত? ঘুম কেন ভেংগে গেল তার? অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল লাশ কাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার। বন্ধু হারানোর যন্ত্রণায় কাতর জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা।

লাশকাটা ঘর রয়েছে এই রাজধানীতেই।  ঢাকা মেডিক্যালের ২ নম্বর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই কোলাহলপূর্ণ কর্মব্যস্ত পরিবেশ।  কেউ রোগী নিয়ে ভেতরে ঢুকছে।  কেউ বের হচ্ছে।  কেউবা খাবার নিয়ে রোগীর কাছে যাচ্ছে। ডাক্তার, রোগী ও রোগীর স্বজনরা সবাই ব্যস্ত।

কেউ কারো দিকে তাকানোর ফুসরতটুকুও পাচ্ছে না।  সোজা ভেতরের দিকে মর্গ। এই এলাকা অনেকটা কোলাহলমুক্ত।  বামে মোড় নিয়ে মর্গ ভবনের কাছাকাছি যেতেই অন্যরকম পরিবেশ।  বাতাসে লাশের গন্ধ।  বাইরে স্বজনের চাপা আহাজারি। পরিবেশ একেবারে গুমোট ও ভারি। রাজধানীর চলার পথে অনেক উৎকট গন্ধ প্রায় প্রত্যেকেই পেয়েছেন।  এমন চাপা ও ভয়ঙ্কর গন্ধের সম্মুখীন হয়তো কখনো পড়তে হয়নি।

কোনো এক অদৃশ্য শক্তি যেন কেড়ে নিয়েছে এখানে অবস্থানরত মানুষের হাসি।  এখানে উচ্চস্বরে কথা বলাও যেন নিষেধ।  মর্গের পরিচালকের দপ্তরের সামনে কিছু লোকজনও দেখা যায়।  কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না।  সবাই কারো জন্য অপেক্ষমান।  উপস্থিতরা কেউ লাশের পিতা।  কেউ চাচা বা কাছের আত্মীয়।

স্বজনদের বসার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা নেই।  রাস্তার পাশে যে যার মতো মাটিতে বসে বা দাঁড়িয়ে রয়েছে।  এরই মধ্যে কিছুক্ষণ পর কাটার জন্য ৩ থেকে ৪টি লাশ জমা হয়েছে।  একে একে বের করে পোস্টমর্টেম রুমে নিয়ে যাওয়া হবে।  একটু পরেই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের উপস্থিতিতে ডোমরা পোস্টমর্টেম শুরু করবেন।

একটা একটা করে মানুষের পেট চিরে নাড়িভুঁড়ি উলটে-পালটে দেখা হবে। মাথার খুলি ফাটিয়ে মগজ বের করা হবে।  কোনো ইন্টার্নি ডাক্তার উপস্থিত থাকলে হয়তো ইচ্ছার বাইরেই নাক চেপে ধরে মানুষ কাটাকুটি দেখবে। আবার মৃত মানুষটির মারা যাওয়ার কারণ নিয়েও ভাববে।

তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার খুটে খুটে দেখবেন।  মারা যাওয়ার আলামতগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করবেন।  কারণ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট লেখার সময় এসব বিষয়গুলো লিখতে হবে।

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একপর্যায়ে বের করা হচ্ছে লাশগুলো।  প্রত্যেকটা লাশ কাপড় দিয়ে ঢেকে নেয়া হচ্ছে।  এর মধ্যে একটি যুবতীর লাশ বের করা হলো।  গায়ে থাকা ওড়না দিয়েই ঢাকা হয়েছে তাকে।  হঠাৎ বাতাসে কাপড় পড়ে গিয়ে মুখ খুলে গেছে।

মাথা থেকে গলা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।  তখনও মেয়েটির মুখে মৃত্যুর ছাপ স্পষ্ট হয়নি।  ফুটফুটে সুন্দর।  মুখটা কি লাবণ্য মায়া মাখা।  মাথাভরা কোমর পর্যন্ত কালো চুল।  যেন কোথাও বের হওয়ার জন্য কেবলই সাজ-গোজ করেছে। এরই মাঝে কারো অপেক্ষায় একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছে।

এমন হাসিমাখা মুখ দেখে কেউ প্রথমেই ভাবতে পারবে না সে মারা গেছে। মেয়েটির বয়স আনুমানিক ১৮-১৯।  ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গের পুরাতন ভবন থেকে কেবল বের করা হয়েছে।  বাইরে অপেক্ষমান স্বজনদের সামনে দিয়ে ট্রলিতে করে নেয়া হচ্ছে।  গন্তব্য পাশেই নতুন ভবনের লাশকাটা ঘর।

কিছুক্ষণ বাদেই ডাক্তার আসার পর লাশগুলো কেটে একে একে আবার বের করা হলো।  পুরাতন ভবনে নিয়ে সেই বোটকা দুর্গন্ধযুক্ত রুমে রাখা হলো। এখানে জনসাধারণের প্রবেশ একেবারেই নিষেধ।  কেউ এমন পরিবেশ দেখলে নিশ্চিত অসুস্থ হবে এটাই স্বাভাবিক।

কর্তব্যরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখান থেকে লাশকে প্রথমে একটি পলিথিনে, পরে মেডিক্যালের সাদা কাপড় দিয়ে মুড়ে হিমঘরে ফ্রিজের মধ্যে রাখা হবে।  স্বজনরা নিতে আসলে ওখান থেকে বের করে কফিন বক্সে ভরে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।  বেওয়ারিশ লাশগুলো ‘আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম’ নিয়ে যাবে দাফন করার জন্য।

মর্গের দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা জানালেন, ৩৫ বছর ধরে এখানে চাকরি করেন।  প্রতিদিন ৫ থেকে ১০টি লাশ আসে।  সেগুলো পোস্টমর্টেম করার পর তার তত্ত্বাবধানে থাকে।  তিনি বলেন, আগে ছেলেমেয়েরা ছোট ছিল।  তখন পত্রিকা/টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়েছি।

এখন ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।  আমি মর্গে চাকরি করি এটা প্রচার হলে তাদের ওপর প্রভাব পড়ে।  ছেলেমেয়ে এমনকি পরিবারের নিষেধের কারণে এখন আর সাক্ষাৎকার দিই না।  

পরে মর্গের পরিবেশ দেখার জন্য ১১টা থেকে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করছি। এমন অবস্থায় ওই কর্মকর্তা নিয়ে গেলেন লাশ কেটে এনে যেখানে রাখা হয় সেখানে।  ঘুটঘুটে অন্ধকার।  কোথাও কোনো মানুষ নেই।  সারি সারি অনেকগুরো রুম।  এর মধ্যে একটির দরজা খুলে বলেন দেখেন আমরা কেমন পরিবেশে কাজ করি।

দরজা খুলতেই মানুষ পচা একটা বোটকা গন্ধ সারা ঘরে জমে রয়েছে।  নাক মুখ আটকে আর দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই।  অন্ধকার ও নির্জনতা এতই গভীর ছিল, অজানা একটা ভয়ও কাজ করছিল।  যেন এখনই মরদেহগুলো জোট বেঁধে ধাওয়া দেবে আমাদের।  এছাড়া দুর্গন্ধে পেটের ভেতর থেকে নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসার উপক্রম।  দূরে জানালা দিয়ে কিছুটা আলো প্রবেশ করেছে। -এমজমিন
৩০ সেপ্টেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে