সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৬, ১১:৪৯:০০

বঙ্গবন্ধুর শরীরে ২৮টি বুলেটের ক্ষত ছিল

বঙ্গবন্ধুর শরীরে ২৮টি বুলেটের ক্ষত ছিল

ফখরে আলম : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর জন্মভূমি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামের মানুষ তাদের প্রিয় দাদা ভাই শেখ মুজিবুর রহমানকে মাটিচাপা দিতে বাধা দিয়েছে। বন্দুকের গুলির ভয় অগ্রাহ্য করে ৫৭০ সাবান, রিলিফের শাড়ি ও তিন বালতি পানি দিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী সমাধিস্থ করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনকারী আব্দুল মান্নাফ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। রোগব্যাধি শোক নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন পঁচাত্তরের ১৬ আগস্টের সাক্ষী রজব আলী ও আব্দুল হাই।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ১৬ আগস্ট সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারযোগে তাঁর লাশ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যায়। তার আগে পুলিশ কারফিউ জারি করে গ্রাম ফাঁকা করে দেয়।

কয়েকজনকে রাখা হয় কবর খোঁড়ার জন্য। এরপর জানাজা ও কাফন ছাড়াই লাশ দাফনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু বাদসাধে বঙ্গবন্ধুর খেলার সাথী প্রতিবেশীরা। বঙ্গবন্ধুর নিকটতম প্রতিবেশী রজব আলী (৮৬)। পঁচাত্তরে তিনি রেডক্রস অফিসে পিয়নের চাকরি করতেন।

রজব আলী বললেন, ‘১৬ আগস্ট হেলিকপ্টারে মিয়া ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) টুঙ্গিপাড়ায় আনা হয়। কবর খোঁড়া, লাশ দাফনের জন্য লোকের প্রয়োজন হয়। আমি এগিয়ে যাই। কবর খুঁড়ি। লাশের সঙ্গে আসা মিলিটারিরা মিয়া ভাইকে মাটিচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। আমি প্রতিবাদ জানাই। তাদের বলি, মিয়া ভাইকে ইসলামী বিধিবিধান মতো দাফন-কাফন করতে হবে। তৈয়ব মাতুব্বরের দোকান থেকে ৫৭০ সাবান কিনে আনি। সেই সাবান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গোসল করানো হয়।’

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ২৯ নম্বর সাক্ষী আব্দুল হাই (৬২)। তিনি ১৫ বছর স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি মেম্বর ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সমাহিত করার ব্যাপারে আব্দুল হাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

আব্দুল হাই বললেন, ‘হেলিকপ্টারের শব্দ শুনে আমি শেখবাড়ীর দিকে এগিয়ে যাই। আততায়ীরা বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে এসেছে। কাফন ছাড়া ওরা বঙ্গবন্ধুকে সমাহিত করতে চায়। আমি বাধা দিই। এরপর আমি দৌড়ে রেডক্রস অফিসে যাই। বঙ্গবন্ধু গরিব মানুষের জন্য যে শাড়ি ত্রাণ হিসেবে দিয়েছিলেন, সেখান থেকে তিনটি শাড়ি নিয়ে আসি। সেই তিনটি সাদা ধুতি শাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কাফন পরিয়ে ইসলামী শরিয়ত মতো সমাধিস্থ করি।’

বঙ্গবন্ধুর খেলার সাথী, নিকটতম প্রতিবেশী কৃষক আব্দুল মান্নাফ বঙ্গবন্ধুকে গোসল করিয়ে ইসলামী বিধিবিধান মতো সমাধিস্থ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ২০০৩ সালের ২৫ এপ্রিল ৮৪ বছর বয়সে তিনি শ্বাসকষ্টজনিত রোগে মারা যান।

মৃত্যুর আগে তিনি এই প্রতিবেদককে ১৬ আগস্টের স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘মিলিটারিরা হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় আসে। এর আগে পুলিশ গ্রাম ফাঁকা করে দেয়। সিআই সাহেবের কাছে গিয়ে বলি, লাশের দাফন কাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিনা জানাজায় আমার দাদাকে দাফন করা যাবে না। দাদা আমার ছেলেবেলার খেলার সাথী। তাঁর রক্তাক্ত শরীর দেখে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। মিলিটারি পুলিশ রাজি হলে ইমানউদ্দিন, নুরুল হক, গেদু মিয়া, কেরামত হাজি, রজব আলী, আব্দুল হাই, নজির মোল্লা, আব্দুল হালিম মৌলভী, তোতা মিয়া, ইদ্রিস কাজী, ইলিয়াস হোসেন, কাশেম হাজি, জহুর মুন্সীসহ আমরা সবাই মিলে কবর খুঁড়ে মিয়া ভাইকে গোসল করিয়ে জানাজা পড়িয়ে সমাহিত করি। রজব আলী ৫৭০ সাবান এনে দিয়েছে। আব্দুল হাই রেডক্রসের কাপড় এনে দিয়েছে। মাওলানা আব্দুল হালিম জানাজা পড়িয়েছে। আমি দাদাকে গোসল করিয়েছি। আমার সাথীর শরীর উল্টেপাল্টে দেখেছি। চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছেন। হাসিমাখা মুখ। শরীরে ২৮টি বুলেটের ক্ষত চিহ্ন। ২৪টি বুলেট বুক ঝাঝরা করে দিয়েছে। পায়ের গোড়ালিতেও বুলেটের ক্ষত। একটি আঙুল নেই। তিনি যে আঙুল দিয়ে নির্দেশ দিতেন বুলেটের আঘাতে সেই আঙুলটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।’

আব্দুল মান্নাফের ১০ ছেলেমেয়ে। এর মধ্যে ছেলে হুসাইনুর রহমান ঢাকায় একটি টেক্সটাইল মিলের বড় কর্মকর্তা। তিনি বললেন, ‘বাবা আমাদের গর্ব। আমার বাবা বঙ্গবন্ধুকে গোসল করিয়ে তাঁর লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, গেঞ্জি ও চশমা সংগ্রহ করে খুলনায় শেখ নাসেরের বাড়িতে দিয়ে এসেছেন। বঙ্গবন্ধুর সেই স্মৃতি এখন জাদুঘরে রাখা রয়েছে। আমার কষ্ট হচ্ছে, বাবা কোনো স্বীকৃতি পাননি। তাঁর খবর কেউ নেয়নি। তিনি মনে কষ্ট নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।’ -কালের কণ্ঠ
১৫ আগস্ট, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে