মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২৫, ১২:২০:৫৪

ভর্তির টাকা যোগাতে পারছেন না মেডিকেলে চান্স পাওয়া জুবায়ের

ভর্তির টাকা যোগাতে পারছেন না মেডিকেলে চান্স পাওয়া জুবায়ের

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : বাবা রং মিস্ত্রী, মা গৃহিনী। দরিদ্র এই পরিবারের সন্তান জুবায়ের হোসেন। এবছর এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পেয়েছেন মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজে। অদম্য জুবায়েরের সাফল্যে আনন্দিত পরিবারসহ গ্রামবাসী। ডাক্তার হয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চান ফরিদপুরের জুবায়ের।

পরিবারের সবার চোখেমুখে আনন্দ থাকলেও আড়ালে দেখা দিয়েছে দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তা। ভর্তির টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে তার পরিবার। অর্থের অভাবে মেধাবী এই তরুণের স্বপ্নপূরণে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

গল্পটা একজন অদম্য মেধাবীর, যিনি জয় করেছেন দারিদ্রতা। ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজে। ফরিদপুর সদর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের তুলাগ্রামের কবির শেখের বড় ছেলে জুবায়ের হোসেন। প্রতিনিয়ত করেছেন অভাবের সাথে লড়াই, তবে হার মানেননি জুবায়ের। সব বাধা পেরিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজে অধ্যায়নের।

জুবায়ের হোসেন বলেন, ‘আমার বাবা একজন রং মিস্ত্রী। ছোটবেলা থেকেই দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। অনেক কিছু মনে চাইলেই করতে পারেনি। তারপরও আমার বাবা আমার জন্য অনেক করেছে। আমার বাবার স্বপ্ন ছিল আমি ডাক্তার হবো। মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়ে সেই স্বপ্নের শুরু হয়েছে।’

জুবায়ের বলেন, ‘অর্থের অভাবে প্রাইভেট পড়তে পারিনি। খুব ভোরে চলে গেছি কোচিং করতে কোনো সময় খেয়ে কোনো সময় না খেয়ে। এমনও দিন গেছে ভোরে বের হয়ে কলেজ শেষ করে বিকেলে বাড়িতে এসে খেয়েছি। টিফিন করার মতো অর্থও থাকতো না পকেটে। মাঝে টিউশনি শুরু করেছিলাম, নিজের পড়ালেখার সমস্যা হওয়ায় তা বন্ধ করে দেই। আমার বাবা প্রতিদিন বেতন পান ৭শ’ টাকা। মাসের ১০দিন কাজ থাকে না। ওই টাকা দিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি আমার ও ছোট ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ চালানো বাবার অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তারপরও বাবা বলতেন আমার যত কষ্টই হোক তোকে ডাক্তার হতে হবে।’

বাবা-মায়ের সঙ্গে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাওয়া জুবায়ের। ছেলেকে কীভাবে কলেজে ভর্তি করবেন সেটা নিয়ে মা-বাবা দুজনই চিন্তিত। ছবি: সময় সংবাদ

জুবায়ের আরও বলেন, ‘এত দিন তো কোনোরকমে চলেছি। মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়েছি, খুবই ভালো লাগছে, তবে এখন দুশ্চিন্তা হচ্ছে মেডিকেলে পড়ার খরচ জোগাড় করবো কীভাবে। সংসারইতো ঠিকমতো চালাতে পারে না বাবা, এখনও ভর্তির টাকাও জোগাড় করতে পারিনি। আমার স্বপ্ন ডাক্তার হয়ে গরিব মানুষের সেবা করবো এবং দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থী যারা আছে তাদের পাশে দাঁড়াব।’

জুবায়েরের বাবা কবির শেখ একজন রং মিস্ত্রী, ছেলে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়ায় খুশি সকলেই। তবে চোখেমুখে আনন্দ থাকলেও আড়ালে দরিদ্র বাবা-মায়ের মনে জেকে বসেছে দুশ্চিন্তা, কীভাবে চলবে ছেলের পড়ালেখা।

জুবায়ের হোসেনের বাবা কবির শেখ বলেন, ‘আমার ছেলে ডাক্তার হবে স্বপ্ন দেখতাম, ছেলে মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়েছে খুব খুশি আমরা। তবে এখন দুশ্চিতায় পড়ে গেছি, কীভাবে ছেলের পড়ালেখার খরচ জোগাব।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি রং মিস্ত্রির কাজ করি। প্রতিদিন বেতন পাই ৭শ’ টাকা। ছেলের পড়ালেখা করানোর জন্য প্রতিদিন ডাবল ডিউটি করতে হয়েছে। ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করেছি। মাসের ১০দিন নানা কারণে কাজ বন্ধ থাকে। সংসার চালানোর পাশাপাশি দুই ছেলের পড়ালেখার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হয়েছে। এখনতো খরচ আরও বেড়ে গেল, কীভাবে এই টাকা জোগাড় করব। এখন পর্যন্ত ভর্তিও টাকাও জোগাড় করতে পারিনি।’

কবির শেখ বলেন, ‘সরকার এবং সমাজের বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানাই আমার ছেলের পড়ালেখার সহযোগিতা করলে সে ডাক্তার হয়ে উঠতে পারবে। আমার ছেলের ইচ্ছা সে গরিব মানুষের সেবা দেবে। সকলে সহযোগিতা করলে তার স্বপ্ন পূরণ হবে।’

জুবায়েরের মা বিউটি বেগম বলেন, ‘আমার ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই খুবই ভদ্র। কোনো দিন রান্না করে দিতে পেরেছি, কোনোদিন পারিনি। ওই ভাবেই না খেয়ে সকালে পড়তে বের হয়ে যেতো। কোনোদিন এসব নিয়ে ঝামেলা করেনি। পড়ালেখা ছাড়া আর কোনোকিছুই তার মাথায় থাকতো না। কোনো বন্ধু ছিল না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঠিকমতো বই কিনে দিতে পারিনি। প্রাইভেটও পড়াতে পারিনি। ভালো পোশাক কিনে দিতে পারিনি, তাতেও তার কোনো দুঃখ ছিল না। ওর বাবা রাতদিন কাজ করেছে যাতে ছেলের পড়ালেখাটা চালিয়ে যেতে পারে। আমি খুব খুশি, তবে দুশ্চিন্তাও হচ্ছে, কীভাবে ছেলের পড়ালেখা চালাব।’

জুবায়ের ছোট বেলা থেকেই মেধাবী ও ভদ্র। পিয়ারপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়, এরপর বনগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি ও সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করে। জুবায়ের মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পাওয়ায় খুশি গ্রামবাসী। প্রতিদিনই তার বাড়িতে আসছে গ্রামের লোকজন। দরিদ্র পরিবারের সন্তানের এমন সাফল্যে গর্বিত গ্রামবাসী।

জুবায়েরের প্রতিবেশী শাকিলা আক্তার বলেন, ‘খুবই ভদ্র ছেলে জুবায়ের। কোনোদিন কারো সাথে মাথা উচু করে কথা বলেনি। জুবায়েরের এমন সাফল্যে আমরা পুরো গ্রামবাসী গর্বিত। ওর বাবা অনেক কষ্ট করে ওর পড়ালেখা চালিয়েছে। আমাদের গ্রামে এই প্রথম কোনো ছেলে মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবে এটাই প্রত্যাশা করি।’

স্থানীয় বাসিন্দা আলতাফ হোসেন বলেন, ‘খবর পেয়ে মিষ্টি নিয়ে জুবায়েরের বাড়িতে এসেছি, খুবই ভালো লাগছে। গ্রামে একজন ডাক্তার হবে, শুনেই ভালো লাগছে। আমার মতো অনেকেই মিষ্টি নিয়ে এই বাড়িতে এসেছে। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে জুবায়েরকে, দারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে আজকের এই অবস্থানে এসেছে। দোয়া করি জুবায়ের একদিন অনেক বড় ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবে।’

সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর এস এম আবদুল হালিম বলেন, ‘জুবায়ের জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করে এই কলেজ থেকে। সে অত্যন্ত মেধাবী একজন ছাত্র। নানা প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে সে পড়ালেখা করেছে। কলেজের শিক্ষকরা তাকে সহযোগিতা করেছে। বই, প্রাইভেট পড়াসহ সব ধরনের সহায়তা করা হয়েছে। এমন সাফল্যে আমরা গর্বিত।’

তিনি আরও বলেন, শুধুমাত্র জুবায়ের নয়, দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার নানা সহযোগিতা কলেজের পক্ষ থেকে করা হয়ে থাকে। ভবিষ্যতেও এধারা অব্যাহত থাকবে। জুবায়েরের উত্তোরত্তর সাফল্য কামনা করি। সে একজন মানবিক ডাক্তার হয়ে দেশের অসহায় মানুষের সেবা করবে এটাই প্রত্যাশা করি।

এমবিবিএস শেষ করে গরিবের ডাক্তার হওয়ার পাশাপাশি মেধাবীদের পাশে দাঁড়াতে চান জুবায়ের হোসেন।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে