মঙ্গলবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৬, ০১:১৬:২৯

অবহেলা আর চরম অভাব এখন সঙ্গী তাদের

অবহেলা আর চরম অভাব এখন সঙ্গী তাদের

সাঈদুর রহমান রিমন : বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে গড়ে তোলা প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেওয়ার অপরাধে আট শতাধিক মানুষ আর দেশের মাটিতে ফিরতে পারেননি। তারা আসাম ও মেঘালয়ের গহিন পাহাড়ে মাটি খামচে পড়ে আছেন সীমাহীন অবহেলায়, চরম অভাবকে সঙ্গী করে। বিগত ৪১ বছরেও তাদের নির্বাসিত জীবনের মুক্তি মেলেনি। তাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়নি কোনো সরকার।

ইতিমধ্যে খুনিচক্রের সহযোগী সমর্থকরা দেশত্যাগী বীরযোদ্ধাদের ভিটেমাটি, সহায়-সম্পদ সর্বস্ব জবরদখল করে নিয়েছে। প্রতিরোধযোদ্ধাদের স্বজনদেরও বিতাড়িত করা হয়েছে সীমাহীন জিঘাংসায়, নিষ্ঠুর বর্বরতায়। দেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের গারো পাহাড়বেষ্টিত উপত্যকার অধিবাসীদের নানা বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার গল্পগাথা ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়কার ভয়ঙ্কর বিভীষিকা, হাজং বিদ্রোহ দমনে রাজকীয় বাহিনীর সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতন, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাসহ একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞেও গারো পাহাড়বাসীকে দেশত্যাগে বাধ্য করা যায়নি। অব্যাহত নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখেও তারা লাল মাটি খামচে ধরেছেন, আঁকড়ে থেকেছেন মাতৃভূমিতে। অথচ সেই লড়াকু মানুষজনই পঁচাত্তরের প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় বাপ-দাদার ভিটেমাটিতে টিকে থাকতে পারেননি।

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করায় তাদের ওপর নেমে আসে সীমাহীন প্রশাসনিক অত্যাচার। খুনিচক্রের দোসররাও মেতে ওঠে ঘৃণ্য জিঘাংসায়। তারা প্রতিরোধযোদ্ধাদের বাড়িঘরে হামলা চালায়। লুটে নেয় সর্বস্ব। তাদের নিরপরাধ স্বজন-পরিজনরা পর্যন্ত নির্মম অত্যাচার থেকে রেহাই পাননি। যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনায় আনন্দমিছিল করেছে, মিষ্টি বিলিয়েছে, তারাই রাতারাতি প্রতিরোধযোদ্ধাদের বাড়িঘর, ভিটেমাটি, ফসলি জমি সবকিছু জবরদখল করে নেয়। উপায়ান্তরহীন অবস্থায় প্রতিরোধযোদ্ধাদের পরিবারবর্গ, এমনকি অনেকের স্বজনরাও জীবন বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তারা গারো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে যান ভারতের আসাম কিংবা মেঘালয়ে।

সেখানেও তাদের নিশ্চিত আশ্রয় জোটেনি, মেলেনি দুই বেলা খাবারের নিশ্চয়তা। আজও তারা স্রোতের শ্যাওলার মতো ঘুরে বেড়ান এক স্থান থেকে অন্য স্থানে জীবিকার সন্ধানে, বেঁচে থাকার আশায়। গারো পাহাড়ের অদূরে সুনামগঞ্জের ধরমপাশা থানায় হাওরবেষ্টিত গ্রাম বাঙ্গালভিটা ছিল প্রতিরোধযোদ্ধাদের শক্তিশালী ঘাঁটি। গ্রামের ৬২টি আদিবাসী পরিবারই ছিল মুজিবভক্ত। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী বীরযোদ্ধাদের অবাধ বিচরণ, অবস্থান ছিল বাঙ্গালভিটায়।

প্রতিরোধযুদ্ধ শেষ হতেই গ্রামটির ওপর নিদারুণ আক্রোশ নেমে আসে। অব্যাহত নিপীড়ন-নির্যাতন, জবরদখল, লুটপাটের মুখে বাঙ্গালভিটার সব কটি আদিবাসী পরিবারকে উচ্ছেদ হতে হয়। দেশত্যাগে বাধ্য করা হয় তাদের। কাইতাকোনার এলিন সাংমা, বাঙ্গালভিটার সুদন হাজং, সুবোধ হাজংদের মতো বীরযোদ্ধারাও গ্রামে টিকে থাকতে পারেননি। পরিবার-পরিজন নিয়ে সীমান্তের ওপারে দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলেই তাদের ঠাঁই নিতে হয়েছে। বাংলাদেশে এদের একেকটি পরিবার বিঘার পর বিঘা জায়গাজমির মালিক হয়েও তাদের বেঁচে থাকতে হচ্ছে অন্যের জমিতে পাইট খেটে।

একইভাবে নেত্রকোনার কলমাকান্দা থানার বরুয়াকোনা গ্রামের প্রতিরোধযোদ্ধা সিলি নাফাক, আশুতোষ কুবি, ইনর নংমিনেরসহ ১৫টি পরিবারকে রাতের আঁধারে সব ফেলে সীমান্ত পেরিয়ে জীবন বাঁচাতে হয়েছে। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থানার সীমান্তবর্তী বারোমারী এলাকার অলিং ম্রং, বরুণ ম্রং, অনুকূল রেমাসহ ১১ জনকে বেছে নিতে হয়েছে নির্বাসিত জীবন। হালুয়াঘাটের গোবরাকুড়ায় প্রভাবশালী আদিবাসী পরিবার বলতে বরাবরই উঠে আসে প্রবোধ দিওর নাম। পঁচাত্তরে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে প্রতিরোধযুদ্ধের প্রথম ডিফেন্স ক্যাম্পটিও গড়ে ওঠে প্রবোধ দিওর টিলাবাড়িতেই।

সেখানে সেনাবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশের সঙ্গে প্রতিরোধযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। টানা তিন রাত তিন দিনের এ যুদ্ধে মুহুর্মুহু গুলি-বোমার বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। যুদ্ধে উভয় পক্ষের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ ভয়ানক যুদ্ধের খবর বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বিশ্ববাসী প্রথমবারের মতো জানতে পারে, জনতা প্রতিরোধ শুরু করেছে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের। সেই গৌরবদীপ্ত ইতিহাসের অংশীদার হয়েও প্রবোধ দিও দেশে টিকে থাকতে পারেননি। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে তাকেও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে মেঘালয়ের পাহাড়-বনে নির্বাসনের দুর্বিষহ যন্ত্রণা। শুধু প্রবোধ দিও একাই নন, তার গ্রাম গোবরাকুড়াসহ আশপাশ এলাকার ২৬ পরিবারের শতাধিক সদস্য সহায়-সম্পদ সব ফেলে রেখে ভারতে পাড়ি জমাতে বাধ্য হন।

প্রতিরোধযোদ্ধা দীপু সাংমারও ঠাঁই হয়নি বঙ্গবন্ধুর বাংলায়। সহযোদ্ধা সুনামগঞ্জের তাহেরপুর থানার শরীফপুরের অজিত তালুকদার, দেবল সরকারসহ নয়টি পরিবারের সদস্যরাও ৪০ বছর ধরে আসামের গৌহাটিতে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। দুর্গাপুরের আরেক প্রতিরোধযোদ্ধা দিবস ম্রং নির্ঝঞ্ঝাট বসবাসের আশায় পৈতৃক ভিটেমাটি ফেলে টিকরিখিলা এলাকায় বাড়ি বানিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও তাকে স্বাভাবিক জীবন যাপনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। দুর্বৃত্তশ্রেণির লোকেরা হামলা চালিয়ে তার টিকরিখিলার বাড়িঘর দখল করে সপরিবারে দিবসকে উচ্ছেদ করে দেয়।

নিরুপায় হয়ে তাকেও চলে যেতে হয়েছে মেঘালয়ের তুরা এলাকায়। এর আশপাশেই অস্থায়ী ডেরা তুলে অবজ্ঞা আর অবহেলায় চরম দুরবস্থাকে সঙ্গী করে বছরের পর বছর কাটছে ক্লেমেন, সুখাই, হেস্টিনসহ আরও অর্ধশতাধিক প্রতিরোধযোদ্ধার। তাদের মতো অন্তত ৮০০ বাংলাদেশি শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেই দেশছাড়া হয়েছেন। তারা চার দশক ধরে আসাম ও মেঘালয় রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করে চলেছেন। সেসব সহযোদ্ধাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন প্রতিরোধযোদ্ধারা। -বিডি প্রতিদিন
১৬ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস‌‌‌‌

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে