মঙ্গলবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৬, ০৩:০১:১৮

‘যারা আমার ছেলেকে জঙ্গি বানিয়েছে, আমি তাদেরও শাস্তি চাই’

‘যারা আমার ছেলেকে জঙ্গি বানিয়েছে, আমি তাদেরও শাস্তি চাই’

নিউজ ডেস্ক : ঢাকার গুলশান হামলার ‘অপারেশন কমান্ডার’ হিসেবে পুলিশ যে মারজানের নাম ও ছবি প্রকাশ করে সন্ধান চেয়েছে, তার বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া গেছে। তার নাম নুরুল ইসলাম, বাড়ি পাবনা সদর উপজেলার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের আফুরিয়া গ্রামে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের ছাত্র।

পরিবার বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিয়ে করেন নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান। এরপর বউ নিয়ে নিখোঁজ ছিলেন। বাড়ির কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না।

পুলিশ বলছে, ৭ আগস্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেওয়া সন্দেহভাজন নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের যে তালিকা দেওয়া হয়, তাতে নুরুল ইসলাম ওরফে মারজানের নাম ছিল না। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগসহ কয়েকটি বিভাগ নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের তালিকা না দেওয়ায় এ বিপত্তি হয়েছে।

মারজানের বিষয়ে তথ্য চেয়ে গত শুক্রবার পুলিশের তথ্য পাওয়ার বিশেষ অ্যাপ ‘হ্যালো সিটি’তে তার ছবি প্রকাশ করে। এর তিন দিনের মাথায় গতকাল তার পরিচয় পাওয়া গেল। ওই অ্যাপে তাকে গুলশান হামলার ‘অপারেশন কমান্ডার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তার বয়স ২২ বা ২৩ বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান। মারজান গোয়েন্দা জালে পড়েছেন বলে ঢাকায় একাধিক সংস্থা আভাস দিলেও কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলছে না। এখন পর্যন্ত গুলশান হামলায় নিহত জঙ্গিরা ছাড়া পরিকল্পনাকারী বা সমন্বয়কারী হিসেবে দুজনের নাম প্রকাশ করেছে পুলিশ। তারা হলেন মারজান ও কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরী। যাদের ‘নব্য জেএমবির’ নেতা বলছে পুলিশ।

ঢাকায় একটি গোয়েন্দা সূত্র বলছে, চলতি বছরের এপ্রিলে মারজান এই জঙ্গিগোষ্ঠীর বিভিন্ন হামলা সমন্বয় করার দায়িত্ব পান। তার সঙ্গে তামিম চৌধুরী ও অন্য জঙ্গিনেতাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বা রয়েছে।

আফুরিয়া গ্রামের গেঞ্জির কারিগর নিজামউদ্দীনের ১০ ছেলেমেয়ের মধ্যে মারজান দ্বিতীয়। গত শনিবার গণমাধ্যমে ছবি প্রকাশের পর প্রতিবেশী ও স্বজনেরা মারজানকে শনাক্ত করেন। এরপর এক কান দুই কান করে বিষয়টি শহরে ছড়ায়। এরই সূত্র ধরে খোঁজ মেলে মারজানের পরিবারের।

পাবনা শহর থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যেই আফুরিয়া গ্রাম। সোমবার বিকেলে গ্রামে গিয়ে জানা গেল, ইতিমধ্যে গ্রামবাসীর বেশির ভাগই মারজানের জঙ্গি হওয়ার তথ্য জেনে গেছে। গ্রামের মাঝামাঝি তাদের বাড়ি। বাড়ি বলতে পাশাপাশি টিনের তিনটি ঘরে। এই তিন ঘরের মধ্যে একটিতে মারজানের বাবা গেঞ্জি তৈরি করেন। বিকেলে বাড়িতে গণমাধ্যমকর্মীদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন মারজানের মা সালমা খাতুন।

মারজানের মা বলেন, স্থানীয় আফরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর মারজান পাবনা জেলা শহরের পুরাতন বাঁশবাজার আহলে হাদিস কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি পাবনা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে দাখিল ও আলিম পাস করেন। ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। গত জানুয়ারিতে শেষবার বাড়িতে আসেন এবং খালাতো বোন প্রিয়তিকে বিয়ে করেন। প্রিয়তিদের বাড়ি জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার দাপুনিয়া ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামে। মেয়েটির বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। বিয়ের পরেই স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ছাড়েন মারজান। এরপর প্রায় আট মাস ধরে পরিবারের কাছে তিনি নিখোঁজ। কোনো যোগাযোগ করেননি।

মারজানের বাবা নিজামউদ্দীন বলেন, তিনি বাড়িতে গেঞ্জি তৈরি করে দোকানে দোকানে সরবরাহ করেন। এ থেকে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চলে। আর্থিক টানাপোড়েন তার দীর্ঘদিনের। তাই সন্তানদের সব চাহিদা পূরণ করতে পারেন না। মারজান যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তখন তার কাছে পাঁচ হাজার টাকা চেয়েছিলেন। ধারকর্জ করে তিন হাজার টাকা দিতে পেরেছিলেন। এরপর মারজান আর টাকাপয়সা চাননি। তিনি বলেন, গত জানুয়ারির পর বাড়ির সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই তার। গত শনিবার পত্রিকায় ছবি প্রকাশের পর মারজানের জঙ্গি হওয়ার খবর জানতে পারেন বলে দাবি করেন বাবা।

নিজামউদ্দীন বলেন, ‘আমার ছেলে অপরাধ করলে তার যা শাস্তি হয় হবে। কিন্তু তাকে যারা জঙ্গি বানিয়েছে, আমি তাদেরও শাস্তি চাই।’

মারজানের মা সালমা খাতুনের দাবি, ‘আমার বেটা কুনু খারাপ কাজ করতে পারে, তা আমার ভাবনাতিও আসে নাই। কুনুদিন সে কোনো অন্যায় কাজ করে নাই। কেন যে বেটা এই পথে গেল, সিডাই আমার প্রশ্ন।’

প্রতিবেশীরা জানান, মারজান ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় ভালো ছিলেন। ধর্মকর্ম নিয়ে থাকতেন। পাড়া-মহল্লায় তাকে কখনো কোনো বাজে আড্ডায় দেখা যায়নি। তার বড় ভাই থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত। অভাবের কারণে অন্য ভাইবোনেরাও খুব বেশি পড়ালেখা করতে পারেনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গ্রামের এক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। নিজেকে আড়াল করতে শুরু করেন।

এ প্রসঙ্গে পাবনার পুলিশ সুপার আলমগীর কবির বলেন, ‘আমরাও জানতে পেরেছি যে মারজানের বাড়ি পাবনাতে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের তিনজন শিক্ষার্থী গতকাল রাতে বলেন, নুরুল ইসলাম ওরফে মারজানকে তারা ফাহাদ নামে চিনতেন। প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দেওয়ার পর তাকে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায়নি। তিনি আরবিতে কথা বলতে পারতেন। তিনি ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে তাদের ধারণা ছিল।

এদিকে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেওয়া সন্দেহভাজন ছয়জন নিখোঁজ শিক্ষার্থীর তালিকায় মারজানের নাম নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মোহাম্মদ আলী আজগর চৌধুরী বলেন, ‘নুরুল ইসলাম আমাদের শিক্ষার্থী কি না, আমরা এখনো নিশ্চিত নই। কাল (আজ) মঙ্গলবার এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। কয়েকটি বিভাগ এখনো অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের তালিকা জমা দেয়নি। এর মধ্যে আরবি বিভাগ একটি। আমরা যে কয়টি বিভাগের তালিকা পেয়েছিলাম, সে কয়টি বিভাগের তালিকা থানায় জমা দেওয়া হয়েছে।’

যোগাযোগ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সভাপতি মোহাম্মদ ইসমাইল চৌধুরী গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘আমি আপনার থেকে মাত্র বিষয়টি জানলাম। আমাদের বিভাগে অনেক শিক্ষার্থী আছে। এত শিক্ষার্থীর মধ্যে নুরুল ইসলাম নামে কেউ আছে কি না, আমি এ মুহূর্তে নিশ্চিত নই।’

তালিকায় মারজানের নাম না থাকা এবং আরবি বিভাগের তালিকা জমা না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী গত রাতে বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা গোয়েন্দা বাহিনী এ বিষয়ে আমাদের কোনো তথ্য দেয়নি। শুনেছি অসুস্থতার কারণে আরবি বিভাগের সভাপতি অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের তালিকা জমা দিতে পারেননি। যদি কেউ তথ্য গোপন করে থাকে, তবে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ - প্রথম আলো
১৬ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস‌‌‌‌

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে