টিপু সুলতান : ১৭ আগস্ট, ২০০৫। বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টা। দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে ৫০০ বোমা ফাটিয়ে অস্তিত্ব, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জানান দিয়েছিল জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। এরপর ছয় মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠাতা ও শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তার, পরের বছর ফাঁসি কার্যকর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার মুখে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জঙ্গি সংগঠনটি।
কিন্তু ১১ বছরের মাথায় সেই জেএমবি ভয়ংকররূপে আবির্ভূত হয়ে গত ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় হামলা ও হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে পুনরুত্থানের জানান দিয়েছে। তবে এই সংগঠন বা গোষ্ঠীটি নিজেদের আইএস (ইসলামিক স্টেট) দাবি করছে। আর পুলিশ বলছে, এরা ‘নব্য জেএমবি’। মূল জেএমবি থেকে বেরিয়ে এসে পৃথকভাবে সংগঠিত হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ‘নব্য জেএমবি’র বাইরে সংগঠনটির আরও দুই অংশ এরই মধ্যে এক হয়ে সম্প্রতি সংগঠনের নতুন নেতা নির্বাচন করেছে। এ অংশটি নিজেদের মূলধারার জেএমবি দাবি করে। জঙ্গিনিরোধ ও আন্তদেশীয় অপরাধ দমন-সংক্রান্ত বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, জেএমবির কথিত এই মূলধারার ভারপ্রাপ্ত আমির বা নতুন নেতা হয়েছেন সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহীন। ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে এই সালাহউদ্দিনকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন জঙ্গিরা। তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায়।
দীর্ঘদিন জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় কার্যকর বা সমন্বিত পদক্ষেপ ও নিরবচ্ছিন্ন গোয়েন্দা নজরদারির অভাবে ১১ বছরের মাথায় এত ভয়ংকররূপে আবির্ভূত হয়েছে জেএমবি। তিনি বলেন, বিপর্যস্ত জেএমবি আবার ঘুরে দাঁড়াবে, সেটা কেউ ধারণা করেনি। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থা জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করলেও নিরবচ্ছিন্ন গোয়েন্দা নজরদারি ছিল না। তেমনি কারাগারে থাকা জঙ্গিরা কে কখন সাজা শেষে বা জামিনে বের হচ্ছেন, সেটারও ভালো নজরদারি হয়নি।
এই কর্মকর্তার মতে, ২০০৭ সাল থেকেই জঙ্গিবাদবিরোধী বিশেষায়িত বাহিনী বা বিভাগ করে একই কেন্দ্র থেকে মামলার তদন্ত, জিজ্ঞাসাবাদ, নিরবচ্ছিন্ন গোয়েন্দা নজরদারিসহ সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল।
অবশ্য পর্যবেক্ষকদের মতে, ২০০৭ সালে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ফাঁসি ও নিযুক্ত আমির সাইদুর রহমানসহ বেশ কিছু জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আত্মতুষ্টিতে ভুগছিল। তারা ভেবেছিল জঙ্গিবাদ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কোনো মতাদর্শী উগ্র গোষ্ঠীকে এভাবে শেষ করা যায় না। যতক্ষণ না মতাদর্শ বিলুপ্ত হয়, ততক্ষণ এরা নতুন নতুনরূপে আবির্ভূত হবে। তার ওপর অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অনুকূল পরিবেশ থাকলে এটা নতুন মাত্রা পায়। যার বড় নজির গুলশান হামলা।
তবে জেএমবির এই পুনরুত্থানের বিষয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ যেভাবে বিস্তৃত হয়েছে, তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। ফলে এখানকার অনেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে, সংগঠিত হয়েছে। তবে এদের নিয়ন্ত্রণে আনার সক্ষমতা পুলিশের রয়েছে।
পুনঃসংগঠিত হওয়া শুরু : প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমানের পর জেএমবির দ্বিতীয় আমির মাওলানা সাইদুর রহমানসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। এরপর সংগঠনটির কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিছু সদস্য তখন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দিকেও ঝুঁকেছিলেন বলে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে। কিন্তু ২০১১ সাল থেকে বাইরে থাকা জেএমবির সদস্যরা আবার সংগঠিত হতে শুরু করেন। কারাগারে থেকে সাইদুরসহ অন্যান্য জঙ্গিনেতার নির্দেশনাও পাচ্ছিলেন বাইরের জঙ্গিরা, এমন খবর বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের বরাতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ২০১৩ সাল থেকে এই জঙ্গিরা খুলনা ও ঢাকায় কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটান। কিন্তু বিষয়টি তখন ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ভালুকায় প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে পুলিশ হত্যা করে জঙ্গি সালাহউদ্দিনসহ জেএমবির শীর্ষস্থানীয় তিন নেতাকে (অপর দুজন বোমা মিজান ও হাফেজ মাহমুদ) ছিনিয়ে নেওয়ার পর টনক নড়ে সরকারি বাহিনীগুলোর। এরপর জানাজানি হয় যে জেএমবি তিন ভাগে ভাগ হয়ে পৃথক নেতৃত্বে সংগঠিত হচ্ছে। এর একাংশের নেতৃত্বে থাকা কারাবন্দী সাইদুর রহমান তার ছেলে আবু তালহা মোহাম্মদ ফাহিমের (২০১৫ সালের ২৭ জুলাই ঢাকায় গ্রেপ্তার) মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের সদস্যদের সংগঠিত করছিলেন।
আরেকটি অংশ সংগঠিত হচ্ছিল প্রিজন ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সালাহউদ্দিন ও জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজানের নেতৃত্বে ভারতে বসে।
জঙ্গিদের তৎপরতা নজরদারি ও এ-সংক্রান্ত তদন্ত তদারক করেন এমন একাধিক কর্মকর্তা বলেন, জেএমবির এই অংশটি নিজেদের নতুন উপস্থিতির জানান দিতে ২০১৪ সালের শেষ দিকে দেশে বড় নাশকতা ঘটানোর পরিকল্পনা করছিল। কিন্তু তার আগে ওই বছরের ২ অক্টোবর ভারতের বর্ধমানের একটি আস্তানায় বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণের কারণে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
সম্প্রতি এ অংশটি মাওলানা সাইদুরের অংশের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছে। সাইদুরকে আমির পদে বহাল রেখে সালাহউদ্দিনকে ভারপ্রাপ্ত আমির করা হয়েছে। এ অংশটির তৎপরতা সীমান্তের ওপারে ভারতেও রয়েছে, সেখানে সংগঠনটির অনেকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তারও হয়েছেন।
জেএমবির অপর অংশটি মূলত আইএস মতাদর্শ অনুসরণ করে। নিজেদের আইএস দাবি করলেও বাংলাদেশ সরকার তা নাকচ করে দিয়ে বলে আসছে যে দেশে কোনো আইএস নেই। এরা জেএমবির একটি অংশ।
তবে এই ‘নব্য জেএমবি’র প্রধান বা শীর্ষ নেতা কে, তিনি দেশে না দেশের বাইরে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন—এ বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি। যদিও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম গতকাল বলেছেন, তামিম চৌধুরী ও মারজান ছাড়াও এই গোষ্ঠীর সাত-আটজন ‘মাস্টারমাইন্ডকে’ তারা শনাক্ত করতে পেরেছেন।
জানা গেছে, শনাক্ত হওয়াদের মধ্যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর দেশে আসেন এবং দেশীয় জঙ্গিদের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেন। যদিও তারও আগে উগ্রপন্থায় যুক্ত হওয়া যুক্তরাজ্যপ্রবাসীদের কেউ কেউ এখানে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন বলে বিভিন্ন সময়ে তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, রিপন ও রাজীব নামে ‘নব্য জেএমবি’র আরও দুজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকের নাম পাওয়া গেছে, যাদের বাড়ি উত্তরবঙ্গে এবং তারা মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব প্রবাসী বাঙালি সিরিয়া গিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের কারও কারও সঙ্গে এই নব্য জেএমবিদের যোগাযোগ আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শুরুর দিক থেকেই জেএমবির তৎপরতার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে আসছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নুর খান। তার মতে, এই কথিত নব্য জেএমবির সঙ্গে ১৯৯৮ সালে শায়খ আবদুর রহমানের প্রতিষ্ঠিত জেএমবির অনেক তফাত। আগের মতো দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত নয়, উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সন্তান ও আধুনিক শিক্ষিতরাও যুক্ত হয়েছেন নব্য জেএমবিতে। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, নাবিক—এমন নানা পেশাজীবীও আছেন। বিদেশে লেখাপড়া কিংবা বসবাস করেন, এমন ব্যক্তিরাও যুক্ত হয়েছেন। যাঁরা আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে এ দেশে এসে জঙ্গিদের সমন্বয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
ঢাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশি জঙ্গিদের মধ্যে ঘরছাড়া বা হিজরত করার ধারণা ঢুকিয়েছেন প্রবাসী বা প্রবাসফেরত জঙ্গিরা। মো. নুর খানের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এ কাজে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংস্থাগুলোর সদস্যদের বড় অংশের জঙ্গিগোষ্ঠী সম্পর্কে জানা-বোঝায় ঘাটতি ছিল এবং এখনো আছে। এ ছাড়া বিষয়টিকে কেবল আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসেবে দেখা হয়েছে। এর মতাদর্শিক দিক মোকাবিলা বা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
এই পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অনেকটা একমত জানিয়ে বলেন, এ ধরনের ধর্মভিত্তিক মতাদর্শিক গোষ্ঠীর মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি থাকতে হয়। যেটার ঘাটতি আছে।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, এখন পর্যন্ত দেশে জঙ্গিবাদ মোকাবিলার কোনো কর্মকৌশল ঠিক হয়নি। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় র্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং অন্যদের কার কী দায়িত্ব, কর্মপরিচালনার পদ্ধতি কী হবে, তা ঠিক করা হয়নি। তিনি বলেন, গুলশান হামলার পর সমাজে জঙ্গিবাদবিরোধী একটা সচেতনতা ও বোধশক্তি জাগ্রত হয়েছে। সরকারের উচিত সমাজের এই বোধশক্তিকে কাজে লাগানো এবং সবাইকে নিয়ে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া। - প্রথম আলো
১৭ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস