বৃহস্পতিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৬, ০২:৩০:২৮

টার্গেটে র‌্যাব-পুলিশ : আতঙ্ক এখন নারী জঙ্গি নিয়ে

টার্গেটে র‌্যাব-পুলিশ : আতঙ্ক এখন নারী জঙ্গি নিয়ে

সাখাওয়াত কাওসার : ‘র‌্যাব-পুলিশরা কাফির। এরা ইসলামের শত্রু। একের পর এক আমাদের ভাইদের গ্রেফতার করে জেলে বন্দী করে নির্যাতন করছে। ইসলামের দাওয়াতি কাজ থেকে বিরত রাখছে। এখন আমাদের টার্গেটই হলো র‌্যাব-পুলিশ।’ মঙ্গলবার গাজীপুর থেকে গ্রেফতার মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আকলিমা রহমানের বরাত দিয়ে কথাগুলো বলছিলেন র‌্যাবের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, সম্প্রতি জঙ্গি কর্মকাণ্ডে নারীদের জড়িয়ে পড়ার হার অনেক বেড়েছে। তাদের অনেকে অস্ত্র-বিস্ফোরক ব্যবহারে পারদর্শী হয়ে উঠেছে এমন তথ্যও তাদের কাছে এসেছে। ২০০৯ সালের ১৫ মে রাজধানীর শেওড়াপাড়া উত্তর পীরেরবাগ এলাকায় একটি বাড়ি থেকে জামা’আতুল মুজাহিদীনের তৎকালীন সামরিক কমান্ডার জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজানকে গ্রেফতারের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উদ্দেশ করে তার স্ত্রী হালিমা বেগমের হুঙ্কারে অনেকটাই বিস্মিত হয়েছিলেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।

এই জঙ্গি দম্পতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করেছিল। জেএমবির সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, শায়খ আবদুর রহমান, আবদুল আউয়ালের স্ত্রীরা জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত ছিলেন। জঙ্গি নেতাদের ফাঁসি হওয়ার পর কিছুদিন সংগঠনটির নারী ইউনিট চুপচাপ ছিল। এখন নতুন করে আবার তৎপরতা শুরু হয়েছে। নূরজাহান, মারজিয়া, মিনা আক্তার, লতা, শারমিন, জ্যোত্স্না ও বিলকিসদের নিয়ে নতুন করে গঠন করা হয়েছে মহিলা ইউনিট। তাদের সঙ্গে জেএমবির পলাতক শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।

গোয়েন্দারা বলছেন, গত বছরের মাঝামাঝি থেকে নতুন করে তৎপরতা শুরু করে নারী জঙ্গিরা। উচ্চশিক্ষিত এই নারীরা প্রযুক্তি ব্যবহার করছে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য। এরই মধ্যে তাদের অনেকেই মানসিকতা ও কর্মকাণ্ডে রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। গোপনে নিচ্ছে অস্ত্র চালনা ও বিস্ফোরক তৈরির প্রশিক্ষণ। পুরুষদের চেয়ে নারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি অপেক্ষাকৃত কঠিন এমনটা ভেবেই শীর্ষস্থানীয় জঙ্গিরা নিজেদের দলে নারীদের ভেড়াতে বেশি আগ্রহী।

সূত্র বলছে, দল ভারী করতে অনেক পুরুষ জঙ্গি একাধিক বিয়ে করে থাকেন। বিয়ের পর স্ত্রীদের ধীরে ধীরে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করেন তারা। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা কারাবন্দী মুফতি জসীম উদ্দীন রাহ্মানির একাধিক স্ত্রীর একজন ছিলেন আয়েশা আক্তার। একপর্যায়ে নির্দেশ অনুসরণ না করার কারণে তাকে তালাক দেন রাহমানী। এর কিছুদিন পরই ২০১৩ সালের ২২ আগস্ট ৩১ সহযোগীসহ বরগুনা থেকে গ্রেফতার হন জসীম উদ্দীন রাহ্মানী।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম (সিটি) ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, বেশির ভাগ জঙ্গি তাদের স্ত্রীদের এ পথে নিয়ে যায়। অনেকে বিয়ের আগেই তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে। আবার অনেকে বিয়ের পর তাদের স্ত্রীদের জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়ানোর উদ্যোগ নেয়। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় তারা সফল হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সংগঠনের স্বার্থে শীর্ষস্থানীয় জঙ্গিরা তাদের মেয়ে কিংবা বোনদের অপর জঙ্গির সঙ্গে বিয়ে দিয়ে থাকে।

৪ জুলাই টাঙ্গাইলের কালিহাতীর রোজিনা বেগমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তারই তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেফতার হন সাজিদা আক্তার ও জান্নাতি ওরফে জেমি। সাজিদার স্বামী নজরুল ইসলাম ওরফে হাসান ওরফে বাইক নজরুল দুর্ধর্ষ জঙ্গি। এই নজরুল পঞ্চগড়ের পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর রায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী, রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কোনিও ও মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যাকাণ্ডে জড়িত। তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ।

জিজ্ঞাসাবাদে তিন নারীই স্বীকার করেছেন, তারা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির মহিলা শাখার সক্রিয় সদস্য। তাদের স্বামীরাও একই সংগঠন করেন। তারাই এদের এ পথে এনেছেন। অপরাধ-বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, জঙ্গি মানে জঙ্গিই। রাষ্ট্রের স্বার্থে জঙ্গিবাদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ আলাদা করলে চলবে না। তবে এই ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডে নারীরা কিছুটা সুবিধা পায়। পর্দা ব্যবহার করে তারা ইসলামের ক্ষতি করে যাচ্ছে। এজন্য গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

গোয়েন্দারা বলছেন, নারী জঙ্গি তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে হিযবুত তাহ্রীর। নিষিদ্ধ এ জঙ্গি সংগঠনের ছাত্রী মুক্তি সংস্থা নামে একটি শাখা আছে। এর বাইরে জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আল্লাহর দলসহ প্রতিটি জঙ্গি সংগঠনের আলাদা নারী ইউনিট রয়েছে।

এদিকে সর্বশেষ সোমবার রাজধানীর মিরপুরের জনতা হাউজিং এলাকা থেকে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের ছাত্রী খাদিজা পারভিন মেঘলা (২৩) গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্রী ইসরাত জাহান মৌ তাকে প্রথম খিলাফতের দাওয়াত দেন এবং তাকে কিছু ইসলামী বই দেন। পরে ইন্টারনেট ব্যবহার করে জঙ্গিবাদের দিকে আকৃষ্ট হন তিনি। একই দিন গ্রেফতার ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসক ইসতিসনা আক্তার ঐশী (২৩) চিকিৎসক দম্পতির সন্তান।

র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী জানান, ২০১৪ সালে প্রথমে তিনি টিভি নিউজ, বিবিসি, সিএনএনের মাধ্যমে জানতে পারেন, খিলাফত ঘোষিত হয়েছে। এর বাইরে ফেসবুকে তিনি যেসব ইসলামী পোস্ট পেতেন, সেগুলো পড়তেন। ২০১৩ সালে ফেসবুকে ‘ইসলাম ক্লাস ফর গার্লস’ পেজের মাধ্যমে ধানমন্ডি ৬ নম্বর সড়কে একটি বাসায় ইসলামী ক্লাসে ভর্তি হন তিনি। সেখানে প্রথমে ‘সাপুর’ নামের এক পাকিস্তানি মহিলা, পরবর্তী সময়ে আমিনা নামের এক বাংলাদেশি মহিলা তাদের ক্লাস নিতেন। ‘ইসলাম ক্লাস ফর গার্লস পেজ-৩’-তে তাদের গ্রুপে সদস্য প্রায় ২৫ জন। তার মেডিকেল-বন্ধুদের মধ্যে রাশেদা তানজুম হেনা, তাসনীম নিশাদ, প্রীতি, সুইটি (ঠিকানা অজ্ঞাত) ও মুন্নীসহ (ঠিকানা অজ্ঞাত) আরও অনেকেই ওই ক্লাসে উপস্থিত থাকতেন। প্রতি শুক্রবার বেলা পৌনে ১১টা থেকে পৌনে ১২টা পর্যন্ত, মাঝেমধ্যে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ক্লাস চলত।

ঐশী জানান, ২০১৫ সালের শুরুর দিকে আকলিমা নামে এক নারীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ধানমন্ডির পাশে একটি মসজিদে নামাজ পড়ার সময় আকলিমা তাকে খিলাফত, জিহাদ ইত্যাদি বিভিন্নভাবে বোঝাতেন। তিনিই তাকে জানান, বাংলাদেশেও আইএস আছে। তার পরিচিত একজন আইএসের সঙ্গে যুক্ত। আকলিমা তাকে আইএস থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন অডিও-ভিডিও চিত্র পেনড্রাইভের মাধ্যমে দিতেন এবং আইএসের প্রকাশনা ‘দাবিক’ পত্রিকা পড়তে বলতেন।

র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘পুরুষদের পাশাপাশি বেশ কিছুসংখ্যক মহিলা জঙ্গিবাদী কাজে যুক্ত হয়েছে। এরা একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজ করছে বলে তথ্য এসেছে। সম্প্রতি একটি গ্রুপের চার নারীকে গ্রেফতার করার পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা পেয়েছি। তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’ বিডি প্রতিদিন

১৮ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস‌‌‌‌

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে