কাজী সিরাজ : একটি রাজনৈতিক দলের মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব এবং সাংগঠনিক নানাবিধ সংকটের নিরসন হয় জাতীয় কংগ্রেস বা জাতীয় কাউন্সিল বা জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে। চুলচেরা আলাপ-আলোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে দলের সর্বসম্মত রাজনৈতিক লাইন বা অবস্থান নির্ধারণ করা হয়। নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক ও আদর্শগত ব্যাপক মতপার্থক্য মীমাংসার অযোগ্য স্থানে চলে গেলে দল ভেঙেও যায়। রাজনৈতিক মতপার্থক্যগত কারণেই আমাদের ভূখণ্ডে রাজনৈতিক দলের ভাঙন আমরা দেখেছি বারবার।
ক্ষমতার লোভও কখনো কখনো রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে সম্বল করেছে। ১৯৪৯ সালে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে জন্ম নেওয়া আওয়ামী মুসলিম লীগকে পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী মুসলিম লীগের গর্ভজাত সন্তানই বলা যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ২২ মাস পর যখন বলা হতো মুসলিম লীগের বিরোধিতা করলে ‘ইসলাম বিপন্ন হবে’, ‘বৌ তালাক হয়ে যাবে’, সেই সময়ে অসীম সাহসী মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ ছিল এক বিস্ময় ও চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনা। সাম্প্রদায়িকতার নেতিবাচক পরিণতির কথা বিবেচনা করে ১৯৫৩ সালে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামে দলটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চরিত্রে রূপান্তরিত হয়। গণতন্ত্রের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার মৌলিক দ্বন্দ্ব ও বিরোধের স্বতঃসিদ্ধ বিষয়টিও দলের নাম পরিবর্তনের ব্যাপারে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়।
দলের ঘোষিত নীতির মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, পাকিস্তানের সব প্রদেশের (তখন পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তান ছাড়া আরও ৪টি প্রদেশ ছিল ১. পাঞ্জাব, ২. সিন্ধু, ৩. উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও ৪. বেলুচিস্তান) আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়, পূর্ব-পশ্চিমের বৈষম্যের অবসান এবং গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা ছিল মুখ্য বিষয়। জনগণের বিপুল সমর্থনে আওয়ামী লীগ প্রকৃত অর্থে জনগণের দলে পরিণত হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ বিরোধী যুক্তফ্রন্টে আওয়ামী লীগই ছিল প্রধান শক্তি। কিন্তু ৮ বছরের শেষ মাথায় জনগণের পক্ষে লড়াকু সে দল ভেঙে যায়। ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কাগমারি সম্মেলনেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আওয়ামী লীগ ভেঙে যাচ্ছে আদর্শগত কারণে। দলের অন্যতম নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন পাকিস্তানের ক্ষমতার শীর্ষে।
তিনি পাকিস্তানের সংহতির কথা বলে ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে দলীয় অবস্থান নাকচ করেন, পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, সিয়েটো-সেন্টো চুক্তি, বাগদাদ প্যাক্ট ইত্যাদির পক্ষে অবস্থান নেন— যা ছিল দলের ঘোষিত নীতির বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল গণতন্ত্রীরা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে একই বছর জুলাই মাসে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে এক সম্মেলনের মাধ্যমে গঠন করেন নতুন দল— ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। ন্যাপ গঠন খুব সহজে সম্পন্ন হয়নি। সম্মেলন ভাঙনের জন্য গুণ্ডা লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল, পল্টন ময়দানে দলের প্রথম জনসভায় হামলা চালিয়ে পণ্ড করে দেওয়া হয়। মওলানা ভাসানীও তার এককালীন শিষ্যদের কাছে লাঞ্ছনার হাত থেকে রেহাই পাননি। সে এক ভিন্ন ইতিহাস। সেই ন্যাপও আবার ভেঙেছে মস্কো-পিকিং বিরোধের সূত্র ধরে। ভেঙেছে কমিউনিস্ট পার্টিও। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও দল ভেঙেছে। ভাসানী ন্যাপও ভেঙেছে আবার। হয়েছে ইউপিপি।
স্বাধীনতার পর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের জন্ম ও উত্থান হয়েছিল অনেকটা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ২২ মাস পর আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরে আওয়ামী লীগ)-এর প্রতিষ্ঠা ও উত্থানের মতো। জাসদ জন্ম নিয়েছিল আরও কম সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ১৯ মাস ৫ দিন পর ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর। সেদিন জাসদের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের বিজয় দিবস ধরলে সময়টা ১০ মাসের একটু বেশি। সে জাসদও এখন ভেঙে টুকরা টুকরা। কমিউনিস্ট পার্টিগুলোও ভেঙে খান খান। তবে জাসদ এবং এককালের পিকিংপন্থিদের মধ্যেই ভাঙনটা বেশি। মস্কোপন্থিরা অধিকাংশই এখন আওয়ামী লীগে ‘শরণার্থী’।
কেউ কেউ চুটিয়ে মন্ত্রিত্ব করছেন। সাবেক পিকিংপন্থি রাশেদ খান মেননও এখন ‘কাস্তে-হাতুড়ি’ ফেলে দিয়ে নৌকার সওয়ার। লীগ সরকারের তিনি বিমানমন্ত্রী। মশিউর রহমান, আনোয়ার জাহিদ, কাজী জাফর আহমদ, মোস্তফা জামাল হায়দার, আবদুল মান্নান ভূঁইয়াসহ অনেক পিকিংপন্থি ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি নেতাও বিএনপি-জাতীয় পার্টির সরকারের মন্ত্রিত্বের স্বাদ নিয়েছেন। সরকারি দলে যোগদান ও মন্ত্রিত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে আদর্শবাদিতার কোনো স্থান ছিল না, নেই। নেতৃত্বের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব-বিরোধ, অবমূল্যায়ন ও হতাশাজনিত কারণে ক্ষমতার হাতছানিতেও দল ভেঙেছে। ভাঙে। বিএনপি ভেঙেছে, আওয়ামী লীগও (বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর) ফের ভেঙেছে। বিএনপি থেকে শামসুল হুদা চৌধুরী, ডা. এম এ মতিন, রিয়াজ উদ্দিন আহমদ ভোলা মিয়া, মওদুদ আহমদ, সুনীল গুপ্ত, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরী, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, নূর মোহাম্মদ খান প্রমুখ এরশাদ সরকারে যোগ দেন। আওয়ামী লীগ থেকে এরশাদ সরকারে যোগ দেন মিজানুর রহমান চৌধুরী, কোরবান আলী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের মতো প্রবীণ নেতারা।
আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে আসেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী, কে এম ওবায়দুর রহমান, ফজলুর রহমান পটল প্রমুখ। অধ্যাপক ইউসুফ আলী পরে এরশাদ সরকারেও যোগ দেন। জাসদ থেকে বিএনপিতে আসেন শাজাহান সিরাজ। ইউপিপি থেকে বিএনপিতে আসেন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, আবদুল্লাহ আল নোমান প্রমুখ। ইউপিপির মূল প্রতিষ্ঠাতা কাজী জাফর আহমদ জিয়া মন্ত্রিসভারও সদস্য ছিলেন। দলবদলের কারণ আগেই উল্লেখ করেছি। বিভিন্ন দল থেকে বিভিন্ন সরকারে যোগ দেওয়া নেতার সংখ্যা আরও বেশি। নীতি-আদর্শের চর্চা রাজনৈতিক দলে দিন দিন বিলীন হচ্ছে, ভোগবাদিতা আর ক্ষমতার রাজনীতি বড় বড় রাজনৈতিক দলে এখন মুখ্য বিষয়। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় কোনো একটি বড় দল যখন ক্ষমতার বাইরে থাকে তখন নানা প্রবণতা সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
১. রাজনৈতিকভাবে কমিটেড আদর্শবাদীরা সংগঠিত হয়ে দলকে নীতিহীন, আদর্শহীন, লুটেরা-দুর্বৃত্তদের কবলমুক্ত করে প্রকৃত অর্থে জনগণের রাজনৈতিক দলে পরিণত করতে চায়। ২. দলে যাদের ‘আমলনামা’ খারাপ তারা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে গোপন আঁতাত গড়ে দলের সরকারবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচিকে নানা কৌশলে ফ্রাসট্রেট করতে চায়। ৩. প্রতিক্রিয়াশীলরা প্রগতিমুখী গণতন্ত্রীদের কোণঠাসা কিংবা বিতাড়িত করে দলে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ৪. অর্থ, বিত্ত এবং নানামুখী কৌশলে দলের নিষ্ঠাবান, নিবেদিতপ্রাণ অংশকে অবজ্ঞা, অবহেলা, বঞ্চনা ও অবমূল্যায়নের শিকারে পরিণত করে এবং ৫. আদর্শবাদী, নিবেদিতপ্রাণ বঞ্চিত অবহেলিতরা যদি দলের ও নিজেদের কোনো ভবিষ্যৎ খুঁজে না পায় তখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। যারা ক্ষমতায় থাকে তারা বিরোধী দলের এমন সব দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে।
ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের সাড়ে ৪ মাস পর ৫৯২ জনের ঢাউস এক কমিটি করার পরও দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারেনি। শোনা যাচ্ছে আরও শ’তিনেক ব্যক্তিকে ঢুকিয়ে কমিটি সম্প্রসারণ করা হবে। তাতে ক্ষোভ, ক্রোধ প্রশমিত হবে বলে ভাবছেন দলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা। মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর দেখে তাই মনে হয়। কমিটির সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে কখনো কমিটি নিয়ে সৃষ্ট সংকট নিরসন হয় না, তাতে বরং সংকট আরও বাড়ে। অন্যদের মধ্যেও কমিটিতে ঢোকার আকাঙ্ক্ষা জন্মে এবং সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য নানা অনৈতিক প্রবণতার দিকে ঝোঁকে।
যে কোনো দলের কমিটি নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয় গঠন প্রক্রিয়া, যোগ্য লোকের যোগ্য স্থানে অন্তর্ভুক্তি, প্রত্যাশিতদের যথাযথ মূল্যায়ন এবং দলের রাজনীতি, আদর্শ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে বড় বড় পদাধিকারীর সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ইত্যাদি নিয়ে। এসব বিষয়ের প্রতি নজর দিয়ে কমিটি করলে আওয়ামী লীগ, বিএনপির ১০১ জনের কমিটিই যথেষ্ট। সবাই তখন কমিটিতে, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ পদে ঢোকার ‘যুদ্ধে’ লিপ্ত হতো না। ‘আমি মেজর জিয়া বলছি...’ একাত্তরের সেই সাহসী কণ্ঠের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি তার প্রতিষ্ঠাকালীন অঙ্গীকারের প্রতি অবিচল নেই। বিএনপি যেন ‘আধুনিক মুসলিম লীগে’ পরিণত হতে চাইছে। ঐতিহাসিক মুক্তিসংগ্রামের সোনালি ফসল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আমাদের পবিত্র আমানত এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকার।
প্রাণের চেয়ে প্রিয় মাতৃভূমির এই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা করাই আমাদের কালের প্রথম ও প্রধান দাবি— প্রতিষ্ঠাকালীন এ অঙ্গীকার থেকে দলটি সরে গেছে বলেই মনে হয়, যদিও দলের ঘোষণাপত্রের শুরুর এই দুটি বাক্য এখনো কাগজে-কলমে অক্ষত রাখা হয়েছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, যে কোনো সময়ে এই অঙ্গীকারের ‘শরীরে’ নতুন পোশাক পরানো হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধার গৌরব নিয়ে এ দলটির যত কথা বলার আছে, অন্য দলের থেকে তা কোনো ক্ষেত্রে কম নয়। অথচ এ অহঙ্কার নিয়ে বিএনপি এখন কথা বলতে যেন সংকোচ বোধ করে। এই আচরণের মধ্য দিয়ে বিএনপি যেন কারও ‘পিঠ-চাপড়াতে’ চাচ্ছে। খুশি রাখতে বা খুশি করতে চাচ্ছে। আর এই প্রশ্নেই বিএনপিতে একটা মতাদর্শগত লড়াই নীরবে-নিভৃতে চলছে বলে মনে করেন অনেক পর্যবেক্ষক। কেউ কেউ বলেন, এবার নবগঠিত কমিটিতে তার ছাপ আছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, প্রগতিশীল গণতন্ত্রীদের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ার অভিযোগের কথা ইতিমধ্যেই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে।
বিএনপির সামনে বড় চ্যালেঞ্জও হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। গত ২৬ জুলাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সভায় এখন থেকেই আগামী সংসদ নির্বাচনের কাজ শুরু করার জন্য দলীয় এমপিদের প্রতি যে নির্দেশ দিয়েছেন, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল তাকে তাত্পর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন। ধারণাটা এমন যে, প্রধানমন্ত্রী হয়তো আগাম নির্বাচনের চিন্তা-ভাবনা করছেন। যদি ২০১৭-তেই সেই নির্বাচন এসে যায় অথবা ২০১৮-এর শুরুতে, বিএনপি তখন কী করবে? তারেক রহমানকে দলের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার উত্তরসূরি করা হয়েছে। একটি মামলায় দণ্ডিত হয়ে তিনি নির্বাচন করার অধিকার হারিয়েছেন। দলের ‘ভোট কারেন্সি’ হিসেবে অন্য প্রার্থীদের প্রচারেও যেতে পারবেন না। বেগম খালেদা জিয়ার দুটি মামলার গতি-প্রকৃতি দেখে অভিজ্ঞজনরা বলছেন তিনিও বিপদে পড়ে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে সারা দেশের দলীয় নেতা-কর্মী ছাড়াও জনগণের কাছে পরিচিত, জাতীয় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে স্বীকৃত ক্যারিয়ার রাজনীতিবিদরা দলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মর্যাদার আসন পেলেন কই? দলে তেমন লোক না থাকলে প্রশ্নটা হয়তো আসত না এভাবে। কিন্তু আছে তো!
বেশ কিছু প্রভাবশালী জনপ্রিয় মুখকে ‘নেতা-এ খামাখা’ বানিয়ে রাখা হয়েছে। কবির হোসেন, লুত্ফুর রহমান খান আজাদ, আখতার হামিদ সিদ্দিকী, এ কে এম মোশাররফ হোসেন, আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, মশিউর রহমান, আবুল খায়ের ভূইয়া, জাফরুল হাসান, হাবিবুর রহমান হাবিব, আতাউর রহমান ঢালি, অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খোন্দকার, অ্যাডভোকেট কামরুল মনির, রোজি মনির, গোলাম আকবর খোন্দকার, সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী, জয়নুল আবদিন ফারুক, জয়নুল আবেদীন (ভিপি), মনিরুল হক চৌধুরী, সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম, কাজী আসাদ, ফজলুর রহমান, আবদুস সালাম— এরা সবাই চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কাউন্সিল দলীয় উপদেষ্টা কাউন্সিল। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এ পদের মূল্য আছে। বিএনপিতে এ পদ দলীয় কোনো পদ নয়। দলের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি, নির্বাহী কমিটির কোনো সভায় তারা থাকতে পারবেন না, বিশেষ দাওয়াতে এলেও কথা বলতে পারবেন না। মুখগুলো বিএনপির পরিচিত মুখ। অনেকে আন্দোলনের মাঠ কাঁপানো। কেউ চরম নির্যাতনের শিকার। কোন বিবেচনায় এদের সবাইকে ‘নেতা-এ খামাখা’ বানিয়ে রাখা হয়েছে বিএনপির কর্তারাই তা জানেন। দলের পদে থাকলে এরা দলের জন্য কিছু করতে পারতেন বলে মনে করেন অনেকে। নির্বাচনী রাজনীতিতে বারবার এমপি নির্বাচিত হওয়া নেতাদের গুরুত্ব আওয়ামী লীগও দেয়। সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপনকারীদেরও মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তারা সবাই এমপি হয়েছেন, কেউ কেউ মন্ত্রীও হয়েছেন। বিএনপি বোধহয় ভুলই করল এদের অবমূল্যায়ন করে। এমন কথাও বাইরে চাউর হয়েছে যে, যারা স্থায়ী কমিটিতে স্থান পাবেন বলে ধারণা করা হয়েছিল অথচ তা পাননি, যাদের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ‘গোডাউনে’ ‘ডাম্পিং’ করে রাখা হয়েছে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রেও তাদের অনেকের কপাল পুড়তে পারে।
একদিকে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চার সঙ্গে ডানঘেঁষা কর্তৃত্ববাদিতার রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিভেদ অপরদিকে অবহেলা, বঞ্চনা, অবমূল্যায়ন ও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ক্যারিয়ার ধ্বংসের আশঙ্কা অনেকের মধ্যেই নতুন ভাবান্তর জন্ম দিতে পারে। জাতীয় কাউন্সিল ও নতুন কমিটি সংকট বাড়িয়েই দিয়েছে বিএনপিতে।
শুধু ক্ষমতার লোভে, অর্থবিত্তের মোহে দলত্যাগে, দল ভাঙায় যে ক্ষতি হয় তা পুশিয়ে নেওয়া যায়, নিবেদিতপ্রাণরা সে শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলে। কিন্তু আদর্শগত রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কারণে মতপার্থক্য সৃষ্টি হলে তা মোকাবিলা করা সব সময় সম্ভব হয় না। আগাম একটি নির্বাচন যদি এসেই যায়, ক্ষমতা অটুট রাখার জন্য সরকারও নানা অঙ্ক কষতে পারে। বিএনপির দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা কি তা ভাবছেন?
বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান যদি দলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে না পারেন সে ক্ষেত্রে কী হবে? নতুন কমিটিতে হাল ধরার মতো যৌথ নেতৃত্ব কই? - বাংলাদেশ প্রতিদিন
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
২১ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস