শাহীন করিম : রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনায় গ্রেফতার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিম এখনো সন্দেহমুক্ত নন। তাই ওই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সন্দেহের বেড়াজালেই আলোচিত চরিত্র হাসনাত। কারণ ওই ঘটনায় তার যুক্ত থাকার বিষয়টি শতভাগ স্পষ্ট না হলেও রিমান্ডের জিজ্ঞাসাবাদে গুলশান হামলা প্রসঙ্গে পুলিশকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন তিনি। সন্দেহভাজন হাসনাতের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকে দ্বিতীয় দফা রিমান্ড শেষে গতকাল সোমবার কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। সেই সঙ্গে তার জামিন আবেদন শুনানির জন্য কাল বুধবার দিন ধার্য করেছেন আদালত। পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, পুলিশের পক্ষ থেকে হাসনাতকে নতুন করে রিমান্ড চাওয়া হয়নি। তবে জামিন পেয়ে যাতে পালিয়ে যেতে না পারে, সেজন্য মামলা শেষ না পর্যন্ত কারাগারে আটকে রাখার জন্য আদালতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। হাসনাতই গুলশান হত্যার ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেফতার একমাত্র আসামি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির আপাতত প্রয়োজনবোধ না করায় আসামি হাসনাত করিমকে গতকাল তৃতীয় দফায় রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করেননি। দুই দফায় ১৬ দিনের রিমান্ডে থাকাকালীন গুলশান হামলা সম্পর্কে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। ওই সময় পুলিশকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন তিনি। ওইসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। প্রয়োজনে ভবিষ্যতে আসামি হাসনাতকে আবারো রিমান্ডে আনা হতে পারে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পরও গুলশান হামলার ঘটনায় অন্যতম সন্দেহভাজন আসামি হাসনাতের জড়িত থাকা না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে হামলাকারী জঙ্গিদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ ছবি, জঙ্গিদের তার মোবাইল ফোন ব্যবহার, পরের দিন সকালে নির্বিঘ্নে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসা ও অতীতে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততাসহ নানা কারণে হাসনাতের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তা ছাড়া প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যে তার ভূমিকা নিয়ে গরমিল রয়েছে। এসব কারণে এখনো সন্দেহমুক্ত নন হাসনাত। ওই সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি পুরোপুরি স্পষ্ট হলে তদন্ত শেষে মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হবেন তিনি। আর সেটি না হলে তাকে সাক্ষী বানানো হতে পারে।
অপরদিকে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ থেকে ‘জিম্মিদশা থেকে মুক্ত’ আরেক সন্দেহভাজন কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাহমিদ হাসিব খানকে শনিবার কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। সূত্র জনায়, দ্বিতীয় দফার ছয়দিনের রিমান্ড শেষে ওই দিন তাহমিদকে নতুন করে রিমান্ড চায়নি পুলিশ। আপাতত এ মামলা থেকে সন্দেহমুক্ত হওয়ার কারণেই তদন্তকারীরা তার বিরুদ্ধে আদালতে কোনো অভিযোগও আনেনি বলে জানা গেছে। বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন ৫৪ ধারায় গ্রেফতার তাহমিদ।
এদিকে গতকাল দুপুরে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির হাসনাত করিমকে গুলশান থানার ১(৭) ১৬ নম্বর মামলায় আটদিনের রিমান্ড শেষে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশের আবেদনে বলা হয়, আসামি হাসনাতের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে, যা এখন যাচাই-বাছাই চলছে। এ মুহূর্তে জামিন পেলে পলাতক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই আসামিকে কারাগারে আটক রাখা আবশ্যক। অপরদিকে হাসনাত করিমের আইনজীবী জামিন চেয়ে আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মহানগর হাকিম আহসান হাবীব জামিন শুনানির জন্য মঙ্গলবার নির্ধারণ করে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে হাসনাতকে ২০১২ সালে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। হাসনাত বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের দ্বৈত নাগরিক। ব্রিটের নাগরিক হলেও সম্প্রতি তিনি দেশে ফিরে এসে বাবার আর্কিটেক্ট ফার্মে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ঘটনার রাতে মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে তিনি হলি আর্টিজান বেকারিতে পরিবার নিয়ে খেতে গিয়েছিলেন বলে পরিবারের দাবি। অপরদিকে ব্যবসায়ী শাহরিয়ার খানের ছেলে তাহমিদ কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। গুলশানের ঘটনার একদিন আগে দেশে ফিরে ইফতারের পর বন্ধুদের সঙ্গে তিনি ওই রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন বলে পরিবারের দাবি।
গুলশানে জঙ্গি হামলার পর থেকেই জড়িত সন্দেহে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসনাত করিম ও কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাহমিদ হাসিব খানকে নজরে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নানা গুঞ্জনের পর ৩ আগস্ট রাতে গুলশান ১ নম্বরের আড়ং শপিং মল সংলগ্ন এলাকা থেকে হাসনাত করিমকে ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাহমিদকে গ্রেফতারের দাবি করে পুলিশ। পরের দিন তাদের ৫৪ ধারায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার দেখিয়ে গুলশান হামলার ঘটনায় আটদিন করে রিমান্ডে নেয় তদন্ত সংস্থা কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।
১৩ আগস্ট হাসনাতকে আদালতে তুলে গুলশানের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ফের আটদিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। আর তাহমিদকে একইভাবে ৫৪ ধারায় ফের ৬ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গুলশান হামলা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখায়নি পুলিশ।
তদন্ত সংশিষ্ট সূত্র জানায়, গুলশান হামলা মামলায় এ যাবৎ ১১ জন আদালতে সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন। এরা হলেন হলি আর্টিজান বেকারির ক্যাশিয়ার আল-আমিন চৌধুরী সিজান, ওই রেস্তোরাঁর স্টাফ মিরাজ হোসেন, রাসেল মাসুদ, মেট্রোরেল প্রকল্পের চালক বাসেদ সরদার, ওই রেস্তোরাঁয় খেতে আসা ভারতীয় নাগরিক সত্য প্রকাশ, রেস্তোরাঁর বাবুর্চি মো. শাহিন, শাহরিয়ার, তুহিন, শিশির, ফায়রুজ মালিহা ও তাহানা তাসমিয়া।
প্রসঙ্গত, ১ জুলাই রাতে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় সশস্ত্র জঙ্গিরা। ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে নশংসভাবে হত্যা করে ওই জঙ্গিরা। জঙ্গিদের হামলায় নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তাও। পরদিন ভোরে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে অপারেশন ‘থান্ডারবোল্টে’ নিহত হয় হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি। জিম্মি অবস্থা থেকে ৩২ জনকে উদ্ধার করা হয়। আহতদের মধ্যে পরে হাসপাতালে শাওন নামের আরেকজন মারা যান। - মানবকণ্ঠ
২৩ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস