মাসরুফ হোসেন : আমার লিস্টে থাকা সানি সানওয়ার স্যারকে আপনারা অনেকেই চেনেন। স্যারের সাথে প্রথম পরিচয় দুহাজার বারো সালে, ডিএমপিতে ওরিয়েন্টেশনের সময়। স্যার তখন ডিবির বম্ব ডিসপোজাল ইউনিটে ছিলেন। আমাদের তখনও গা থেকে ট্রেনিং এর ছাপ যায়নি, একেবারেই নবীন ছিলাম। সদাহাস্য এই মানুষটি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁর কাজ সম্পর্কে। বম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের পোশাক পরিহিত অবস্থায় তাঁর ছবি দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, স্যার, এই পোশাকে কতটুকু সেইফ থাকেন?
"ভাই, এই পোশাক পরার কারণ হল, যদি বোমা ফাটে তাহলে শরীরের টুকরাগুলো যেন একটু বড়সড় হয়, খুঁজে পাওয়া যায়"
পাশে আসাদ স্যার ছিলেন, সম্ভবত তিনি যোগ করেছিলেন-
"শুনো ভাই, এই গোটাদশেক দেশে বম্ব ডিসপোজাল ট্রেনিং করে একটা জিনিস শিখসি। তুমি চাইলে শিখায়ে দিতে পারি"।
খুব আগ্রহ নিয়ে বললাম, স্যার আমি আগ্রহী, প্লিজ বলেন।
দুইজনই হাসতে হাসতে বললেন,
"সব সময় মনে রাখবা, বোমা খুউব খারাপ জিনিস। হাত দিতে নাই। ফাইটা গেলেই সর্বনাশ, শরীরের টুকরাগুলা স্যুট পরা থাকলে হবে এইটুকু, আর পরা না থাকলে হবে এই এতটুকু"
উনাদের কথাবার্তা শুনে আমার অজ্ঞান হয়ে যাবার মত অবস্থা!
এই একটু আগে সানোয়ার স্যার অপারেশন হিট স্ট্রর্ম টুয়েন্টি সেভেন শেষ করে ফিরলেন। গুলশান হামলার মূল হোতা যে কুৎসিৎ প্রাণীটি, এই অভিযানে সে তার দুই সহযোগী সহ অক্কা পেয়েছে।
স্যার এরকম কতগুলো অপারেশন করেছেন এটা আমরাও জানিনা। অতি গোপনীয় হওয়ায় এ সম্পর্কিত তথ্য বাইরের কাউকে জানানোও হয়না। মিরপুরে কয়েক বাক্স গ্রেনেড সহ জঙ্গী ধরা পড়ল মনে আছে? সেটির নেতৃত্বও দিয়েছিলেন ইনি, সাথে ছিলেন আমার ব্যাচমেট রহমতুল্লাহ ভাই।
এই অপারেশনগুলো কি পরিমান বিপজ্জনক তা বলে বোঝানোর অবকাশ নেই। কোন পুলিশ সদস্য যখন এই অপারেশনগুলোতে যায়, ফিরতে না-ও পারে এটা জেনেই যায়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ পুলিশ জঙ্গী দমনে যেসব সাফল্য অর্জন করেছে, তা বিশ্বের স্ট্যান্ডার্ডেই অনন্য সাধারণ।
গরীব দেশ, দুর্নীতি, অভাব আর অনিয়মে আচ্ছন্ন। এর মাঝেও প্রাণ হাতে নিয়ে জঙ্গীদের বিরূদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়ে যাচ্ছে আপনাদেরই এই "ভাঙাচোরা" পুলিশ।
ঘুষ আর অত্যাচারের শিকার হয়ে যে পুলিশকে গালি দেন সঙ্গত কারনেই, তাদের এই দিকটাও মনে হয় মাঝে মধ্যে অনুধাবন করার চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
জঙ্গী দমন আর হাডুডু খেলা এক না। এইটা কল অফ ডিউটি ব্ল্যাক অপস গেইমও না। এইখানে কোন সেকেন্ড লাইফ নাই, আহত হবার পর সরাসরি রিচার্জ অপশন নাই।
এত বড় একটা অপারেশন সাফল্যের সাথে শেষ করার ঠিক পর পরই আপনারা যারা "ওদেরকে না ধরে মেরে ফেলা হল কাদের আড়াল করতে" বলে কন্সপাইরেসি থিওরি প্রসব করেন, আপনারা কি নিশ্চিত যে এই অপারেশন করতে গিয়ে আসলে কাউকে আড়াল করতে এতগুলো পুলিশ প্রাণের ঝুঁকি নিচ্ছে?
যদি সুস্পষ্ট, স্পেসিফিক প্রমাণ থাকে এ ধরণের দাবীর পেছনে তবে তা প্রকাশ করুন।
আর যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে সামান্য একটু সংবেদনশীলতা কি এই অফিসারগুলো আশা করতে পারেনা?
আমাদের আমেরিকার মত আধুনিক ইকুইপমেন্টস নেই, গরীব দেশে তা সম্ভবও না সব সময়। তবুও বোকা পুলিশ যে কারণে বুলেট প্রুফ ভেস্ট ছাড়াই বিনা দ্বিধায় এগিয়ে যায় শয়তানের মুখোমুখি হতে, তার কারণ হচ্ছে নিখাঁদ দেশপ্রেম এবং অনুপ্রেরণা। আর এই অনুপ্রেরণা হচ্ছেন আপনি, ওর দেশের মানুষ, ওর ভাই।
এই অফিসারটা যখন দেখবে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে করা তার অপারেশনকে আপনি বিনা তথ্য প্রমানে স্রেফ আন্দাজে একটা ফেইক কভার আপের কাতারে ফেলে দিচ্ছেন, কেমন লাগবে তার?
পরের অপারেশনে এটা কি সামান্য হলেও তার মোটিভেশনে আঘাত হানবে না? যদি এরকম হয়, তাহলে কার নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলুন তো?
জ্বি, আপনার।
কাজেই, বিনা প্রমাণে মনের মাধুরী মিশিয়ে কন্সপাইরেসি থিওরি দেয়া বন্ধ করুন, নিজের স্বার্থেই।
সবশেষে একটা প্রশ্ন: ওসামা বিন লাদেনকে জীবিত ধরলে তো আল কায়েদার নাড়ী নক্ষত্র চিরজনমের তরে পেয়ে যেত আমেরিকানরা। বলুন তো, অপারেশনে সে তাহলে মারা গেল কেন?
লেখক : পুলিশ কর্মকর্তা
২৮ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস