শুক্রবার, ০২ অক্টোবর, ২০১৫, ০৫:২২:২৭

১০০ বছরেও শেষ হবে না ৩২ প্রকল্প

১০০ বছরেও শেষ হবে না ৩২ প্রকল্প

জাহাঙ্গীর শাহ : বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৩২টি প্রকল্প রয়েছে, যেগুলো শেষ হতে ১০০ বছরের বেশি সময় লাগবে। মূলত নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে বছরের পর বছর এই প্রকল্পগুলো বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, বরাদ্দের এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী ১০০ বছরেও এসব প্রকল্প শেষ হবে না।

বাংলাদেশের সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক এই হিসাবটি দিয়েছে। প্রতিবেদনে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের এডিপির প্রকল্পগুলোর অর্থ বরাদ্দের প্রবণতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, গত এডিপিতে ১ হাজার ৩৪টি প্রকল্প ছিল। যে ধারাবাহিকতায় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, তাতে ৩২টি প্রকল্প শেষ হতে ১০০ বছরের বেশি সময় লাগবে। আর এডিপিতে এমন ১০৬টি প্রকল্প রয়েছে, যেগুলো শেষ হতে ১১ থেকে ১০০ বছর সময় লাগবে। ১৫৪টি প্রকল্প ৬-১০ বছরে শেষ হবে। আর ৭২৫টি প্রকল্প শেষ হবে পাঁচ বছরের মধ্যেই। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে এসব প্রকল্পের নাম প্রকাশ করা হয়নি।

তবে এডিপি বই পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ সড়ক প্রশস্তকরণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্পটি ২০১১ সালে নেওয়া হয়েছে। ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা। গত তিন বছরে মাত্র এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এ ধারায় খরচ হলে প্রকল্পটি শেষ করতে ৫ হাজার ৪৩ বছর সময় লাগবে। তবে এবার এই প্রকল্পে পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

২০১১ সালে কুষ্টিয়া শহর বাইপাস সড়ক নির্মাণে ৭৮ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। গত তিন বছরে এই প্রকল্পেও মাত্র এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আবার বর্তমান এডিপিতে ১৩ শতাংশ প্রকল্প রয়েছে, যেগুলোর বয়স এক বছর পেরিয়ে গেলেও এক টাকাও খরচ হয়নি। কিন্তু নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্পগুলো বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপযোগিতা না থাকলে এ ধরনের প্রকল্প বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে তারা বলেছে, বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ উন্নয়ন প্রকল্প সময়মতো শেষ হয় না। আর ২৫ শতাংশ প্রকল্পের ব্যয় বাড়াতে হয়। সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণে প্রকল্প থেকে অর্থনৈতিক সুফল পেতে সরকারকে অপেক্ষাকৃত বেশি খরচ করতে হয়। এ ছাড়া ক্রমান্বয়ে মানব উন্নয়নে প্রকল্প নেওয়ার হারও কমছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মানব উন্নয়নে প্রকল্প ছিল ২৮ শতাংশ। আর গত অর্থবছরে তা কমে এসেছে ২০ শতাংশে। তবে একই সময়ে পরিবহন খাতে এডিপিতে প্রকল্পসংখ্যা ৯ শতাংশ বেড়ে ২৬ শতাংশ হয়েছে।

সংশোধিত এডিপিতে বিপুলসংখ্যক প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করাকে ‘দুর্বল পরিকল্পনা’ হিসেবে মনে করে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজেট পাস হওয়ার পরও খুব দ্রুত প্রকল্পসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বরাদ্দও সমন্বয় করা হয়। বাজেটের সময় জাতীয় সংসদে এডিপি দলিলাদি পাস হয়। কিন্তু বছরের মাঝখানে জাতীয় সংসদের অনুমোদন ছাড়াই সরকারের অগ্রাধিকার পরিবর্তন হয়, নতুন নতুন প্রকল্প সংশোধিত বাজেটে ঢুকে পড়ে। এর ফলে কিছু প্রকল্পে বরাদ্দ কমে যায়। এটা উৎকৃষ্ট বাজেট অনুশীলন নয়।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান প্রতিবেদককে বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নয়, অপ্রয়োজনীয়ভাবে অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনাই প্রাধান্য পায়। এ ছাড়া ব্যবস্থাপনা সমস্যার কারণে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় না। এতে ব্যয় বাড়ে।

সাবেক সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কমিশনের চেয়ারম্যান এম হাফিজউদ্দিন খান আরও বলেন, এমন প্রকল্পগুলো সরকার কখনো পর্যালোচনা করেনি। টাস্কফোর্স গঠন করে কেন প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন হয় না, ব্যয় কেন বাড়ে—এসব চিহ্নিত করা উচিত।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় সবচেয়ে কম রাজস্ব আদায় হয় বাংলাদেশে, আবার সবচেয়ে কম সরকারি ব্যয়ও হয় এ দেশে। তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সরকারকে কম ব্যয় করতে হয়। একটি উদাহরণ দিয়ে দাতাসংস্থাটি বলেছে, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের তুলনায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবায় কম ব্যয় করা হয়। ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় ৯৫ ডলার। মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় পার্শ্ববর্তী ভারতে ২১৫ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ৩০৬ ও পাকিস্তানে ১২৬ ডলার।

বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশই সরকারের পৌনঃপুনিক ব্যয় (রিকারেন্ট এক্সপেন্ডিচার)। বিশ্বব্যাংক বলছে, এ ধরনের ব্যয়ের ২৫ শতাংশের মতো সুদ বাবদ খরচ করতে হয়। এ কারণে জিডিপি অনুপাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের খরচ হার বাড়েনি, বরং কমেছে। সুদ বাবদ খরচ বাদে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে পৌনঃপুনিক ব্যয়ের ২২ শতাংশ খরচ হয়েছিল শিক্ষা খাতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ২০ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতে আগের মতোই ৭ শতাংশ খরচ হয়। সাধারণ রাষ্ট্রীয় সেবায় খরচ ১৬ শতাংশ থেকে কমে ১০ শতাংশ হয়েছে।

এমনকি গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণে স্থানীয় সরকার বিভাগের খরচ ৪ শতাংশ থেকে কমে ৩ শতাংশ হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে সরকারি ব্যয়-কাঠামো পুনর্গঠনের সুপারিশ করেছেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, কয়েক বছর ধরে সরকারকে সুদ বাবদ বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। দেখা গেছে, ব্যাংকঋণের মতো কম সুদে টাকা নেওয়ার চেয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে টাকা নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এ ছাড়া সরকারের রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেড়েছে। এসব কারণে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের মতো মানবকল্যাণে সরকারের ব্যয় হার কমছে।

এর আগে ২০১০ সালে বিশ্বব্যাংক সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এর ধারাবাহিকতায় এবার হালনাগাদ এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।-প্রথমআলো
২ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে