জামাল উদ্দিন: প্রথমে নেপাল ও পরে বিহারে। সেখান থেকে ভারতের বিভিন্ন পথ ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে গুলশানে জঙ্গিদের ব্যবহৃত একে-২২ রাইফেল। হামলায় অংশ নেওয়া জঙ্গি রোহানের কাঁধে যে অস্ত্রটি ঝুলতে দেখা যায় সেটিও ছিল একে-২২ রাইফেল। রাজধানীর কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শুরুর আগে একে-২২ নিয়ে পালিয়ে যায় এক জঙ্গি।
শনিবার নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শেষেও দেখা যায় জঙ্গিদের মৃতদেহের সঙ্গে একে-২২ রাইফেল। গুলশানসহ বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় পাওয়া জঙ্গিদের অস্ত্রের উৎস জানতে চাইলে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম এসব তথ্য জানান।
জঙ্গি দমনে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, জঙ্গিরা আগে অর্থ সংকটের কারণে ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারতো না। তখন তারা ধারালো ও কম দামি ছোট অস্ত্রের ব্যবহার করতো। সে কারণে অর্থ সংগ্রহের জন্য তারা আশুলিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যাংক ডাকাতি, ছিনতাই ও চুরি করেছিল। কিন্তু প্রায় দু’বছর আগে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী যুক্ত হওয়ার পর অর্থ ও অস্ত্র নিয়ে জঙ্গিদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তামিমের মাধ্যমে তারা বান্ডিল বান্ডিল টাকা পাওয়া শুরু করে। ফলে, নব্য জেএমবির উত্থান ঘটে।
এ প্রসঙ্গে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, এটা ঠিক যে তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে নব্য জেএমবি কাজ শুরুর পর তাদের আর অর্থ সংকট হয়নি। ব্যাংকিং চ্যানেল ছাড়াও বিভিন্ন পথে সে টাকা সংগ্রহ করতো। অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহে তার সক্ষমতা ছিল অনেক বেশি। এখন তার মৃত্যু হওয়াতে তারা আবার হোঁচট খাবে বলেও মনে করেন তিনি।
মনিরুল ইসলাম বলেন, যেভাবে নব্য জেএমবির উত্থান হয়েছিল, সেভাবেই তারা শেষ হয়ে যাবে। জঙ্গিদের দমন করতে পেরেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এখন তাদের কাজ হচ্ছে, জঙ্গিদের দমন করা।
জঙ্গি দমনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন সময় জঙ্গিদের কাছ থেকে ছোট-বড় অস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারপরও তাদের কাছে এখনও বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুদ রয়েছে বলে মনে করেন তারা। তাই সবার মনেও প্রশ্ন, কত অস্ত্র ও গোলাবারুদ রয়েছে জঙ্গিদের কাছে। জঙ্গিদের কাছে থাকা এসব অস্ত্র জব্দে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে বলেও জানান মনিরুল ইসলাম।
একই সঙ্গে এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদের উৎস ও যোগানদাতাদের ধরতে অনেক আগে থেকেই কাজ করছেন তারা। জানতে চেষ্টা করছেন, কীভাবে এবং কোন পথে জঙ্গিরা এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করছে।
গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির হামলায় ধারালো অস্ত্রের পাশাপাশি জঙ্গিরা ভারী অস্ত্র একে-২২ রাইফেল ব্যবহার করে। হামলায় অংশ নেওয়া ৫ জঙ্গির একজন ছিল রোহান ইবনে ইমতিয়াজ। পরে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতেও দেখা যায়, তার কাঁধে ঝুলছে একে-২২ রাইফেল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পর সেখান থেকে ৪টি নাইন এমএম পিস্তল, একটি ফোল্ডেট বাট একে-২২ রাইফেল, ৪টি অবিস্ফোরিত হাতে-তৈরি গ্রেনেডসহ (আইইডি) দেশীয় অস্ত্র জব্দ করা হয়। গুলশান হামলার কয়েকদিন পর ৭ জুলাই শোলাকিয়ার হামলাতেও জঙ্গিরা ধারালো অস্ত্রের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার অস্ত্রের উৎস ও যোগানদাতা কারা সেটা শনাক্তের চেষ্টার কথা জানান আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক। সম্প্রতি, মিরপুর পুলিশ স্টাফ কলেজে একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান।
আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, শোলাকিয়া ও গুলশানে ব্যবহৃত অস্ত্রের উৎসের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব হামলার নেপথ্যে কারা তাদের কয়েকজনকে শনাক্ত করতে পেরেছেন তারা। কয়েকজনকে গ্রেফতার ও অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, তদন্তের অংশ হিসেবেই তারা গুলশান হামলায় অস্ত্র ও অর্থের উৎস জানার চেষ্টা করছেন। জানার চেষ্টা করছেন, অস্ত্র উৎপাদনকারী কোন দেশ থেকে এসব অস্ত্র প্রথমে নেপালে ও পরে বিহারে যায়। সেখানে অস্ত্রের গায়ে কিছু ঘষামাজা করা হয়। এরপর সেখান থেকে ভারতের বিভিন্ন পথ দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসে। এসব অস্ত্র কখনও ভারত থেকে ওই চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশে পৌঁছে দেয়। কখনও এপার থেকে গিয়েও তারা নিয়ে আসে। তবে অস্ত্রের চেয়ে বিস্ফোরকই বেশি আসে বলে জানান তিনি।
একে-২২ নামের যে সেমি-অটোমেটিক রাইফেলটি গুলশানের হলি আর্টিজান থেকে জব্দ করা হয়েছিল, গত জানুয়ারিতে ঠিক একই ধরনের ৮টি একে-২২ রাইফেল চট্টগ্রামের হামজা ব্রিগেডের কাছ থেকে জব্দ করে র্যাব সদস্যরা। এর আগে আরেকটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে গত বছরের শেষের দিকে একই এলাকা থেকে ৯টি একে-২২, একটি একে-৪৭ এবং বিদেশি ৪৪টি রিভলবার জব্দ করেছিল র্যাব। এ বছরের শুরুর দিকে বগুড়ার দুটি জঙ্গি আস্তানা থেকেও একে-২২ রাইফেল, জার্মানির তৈরি এসএমজি, পিস্তল, হাতে-তৈরি গ্রেনেড ও বিপুল বিস্ফোরক জব্দ করে র্যাব।
র্যাবের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার পর ২০০৫ সাল থেকে ২০১৬ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে র্যাব জঙ্গিদের কাছ থেকে ৩৯৯টি গ্রেনেড, বোমা ও ককটেল জব্দ করেছে। গ্রেনেডের বডি জব্দ করেছে ৬২৪টি। বিভিন্ন ধরনের ডেটোনেটর জব্দ করা হয়েছে ৯ হাজার ১৮৮টি। ১০১টি ছোট-বড় অস্ত্র, ৫ হাজার ৭৩ রাউন্ড গুলি এবং বিভিন্ন ধরনের গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক জব্দ করা হয়েছে প্রায় দুই হাজার কেজি। এ সময়ে কেবল জেএমবি সদস্য আটক হয়েছে ৬৩০ জন। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও আনসার আল ইসলামসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের ১ হাজার ২০১ জন সদস্যকে আটক করে র্যাব।
জঙ্গিদের কাছ থেকে জব্দ করা এসব অস্ত্রের উৎস কোথায় জানতে চাইলে র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ বলেন, গুলশান হামলায় জঙ্গিরা একে ২২ নামের যে অস্ত্র ব্যবহার করেছে, ঠিক একই রকম অস্ত্র তারা চট্টগ্রামের হামজা ব্রিগেডসহ কয়েকটি জঙ্গি আস্তানা থেকে জব্দ করেছেন। কয়েকটি জঙ্গি আস্তানা থেকে জব্দ হওয়া অস্ত্রের উৎস জানতে তদন্ত চলছে বলেও জানান তিনি।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সারাদেশে বিভিন্ন অভিযানে পুলিশ বিপুল সংখ্যক অবৈধ অস্ত্র জব্দ করে। এর মধ্যে এলএমজি ২টি, এম ১৬ এ-১ রাইফেল ৩টি, চাইনিজ ও দেশীয় এসএমজি ৩টি, পয়েন্ট ২২ এবং ৩০৩ পয়েন্টের রাইফেল ১৩টি, কাটা রাইফেল ৯টি, ডিবিবিএল ২১টি, এসবিএল ৬৩টি, দেশি রিভলবার ৩৫টি, বিদেশি রিভলবার ৮০টি, দেশি পিস্তল ৪৯টি, বিদেশি পিস্তল ৫৩৬টি, বন্দুক ৯১টি, কাটা বন্দুক ১০টি, পাইপগান ১৫৩টি, শাটার গান ১০৪টি, এলজি ১৫০টি, এয়ারগান ৩০টি, ওয়ান শ্যুটার গান ৮০টি, গুলি প্রায় ৬ হাজার রাউন্ড ও কার্তুজ ১২৭৯ পিস।
জঙ্গিদের কাছ থেকে এত অস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দের পরও আর কত অস্ত্র ও গোলাবারুদ জঙ্গিদের কাছে রয়েছে জানতে চাইলে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন বলেন, জঙ্গিদের কাছে এখনও অনেক অস্ত্র মজুদ আছে। কারণ, জঙ্গিদের সর্বশেষ প্রস্তুতি গ্রহণের মাত্রা অনুসারে আমরা খুব কমই উদ্ধার করতে পেরেছি। তবে ব্যবহারকারীদের নিউট্রাল (নিষ্ক্রিয়) করতে পারায় সেগুলোর বহুবিধ ব্যবহার সীমিত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, জঙ্গিদের কাছে থাকা সেসব অস্ত্র জব্দেও আমরা বেশ সক্রিয় রয়েছি।
জঙ্গিদের অস্ত্রের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, যে প্রক্রিয়ায় ১০ ট্রাক অস্ত্র এসেছিল, সেই একই প্রক্রিয়াতেই জঙ্গিদের হাতে অস্ত্র আসছে। কালোবাজারিদের কাছ থেকেও জঙ্গিরা অস্ত্র সংগ্রহ করছে। একই সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইসহ কয়েকটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাও জঙ্গিদের অস্ত্র ও পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে।-বাংলা ট্রিবিউন
২৯ আগস্ট, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম