মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৬, ০৬:২৭:১৬

‘ক্যালগ্যারি ক্লাস্টার’ জঙ্গি গ্রুপে যুক্ত ছিলেন তামিম

‘ক্যালগ্যারি ক্লাস্টার’ জঙ্গি গ্রুপে যুক্ত ছিলেন তামিম

নিউজ ডেস্ক : গুলশান হামলার অন্যতম ‘সমন্বয়কারী’ তামিম চৌধুরী কানাডায় থাকতেই কিছু জঙ্গি সদস্যের একটি গ্রুপে যুক্ত হন। ‘ক্যালগ্যারি ক্লাস্টার’ নামের এই গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা ও পাঠচক্রে অংশ নিতেন তিনি।

ক্যালগ্যারি শহরভিত্তিক ছোট অথচ ভয়ংকর এই গ্রুপকে দেশটির বাইরে বিভিন্ন হামলার ঘটনায় দায়ী করা হয়ে থাকে। এসব হামলায় ৭০ জনের বেশি প্রাণ হারান। কানাডার দৈনিক পত্রিকা দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইল এ তথ্য দিয়েছে।

গত শনিবার নারায়ণগঞ্জে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরী। জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নামে গত ১ জুলাই ঢাকার হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার তিনি মূল পরিকল্পনাকারী বলে দাবি করছে পুলিশ। ঢাকায় ইমিগ্রেশন পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী, কানাডীয় নাগরিক তামিম চৌধুরী দুবাই হয়ে ইতিহাদ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে বাংলাদেশে আসেন ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর।

কানাডার পত্রিকাটি লিখেছে, কানাডায় থাকাকালে স্থানীয় উগ্রবাদীদের সঙ্গে তামিমের যোগাযোগের ব্যাপারে খুব কম জানা যায়। ‘ক্যালগ্যারি ক্লাস্টার’ নামে পরিচিত ক্যালগ্যারি শহরভিত্তিক একটি ছোট জঙ্গি গ্রুপের সদস্যদের সময় দিতেন তিনি। গ্রুপটিকে অন্তত দুটি বড় সন্ত্রাসী হামলার জন্য দায়ী করা হয়।

গ্রুপটির সঙ্গে তামিমের এই যোগাযোগের খবর নিশ্চিত করেছেন ক্যালগ্যারি শহরে উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে কাজ করে চলা ইমাম নাভায়েদ আজিজ। এক দশক আগে তামিম সপরিবারে কানাডার উইন্ডসরে বসবাস শুরু করেন। সেখানে একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং পরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। ইতিমধ্যে হাতে গোনা কয়েকবার বাংলাদেশেও এসেছেন তিনি।

২০০৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব উইন্ডসরে পাঠ্যক্রমবহির্ভূত দুই সপ্তাহের একটি ইসলাম শিক্ষার ক্লাসে অংশ নেন তামিম। ক্লাসটি নিতেন ইমাম নাভায়েদ আজিজ। তামিমকে তিনি বেশ ভালোভাবে চিনতেন জানিয়ে আজিজ বলেন, তিনি খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। তার মধ্যে উগ্রপন্থার কোনো লক্ষণ দেখেননি। সন্ত্রাসী সংগঠনের একজন নেতা হিসেবে একদিন তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ‘মানুষ শিকারি’ হয়ে উঠবেন, তা কখনো কল্পনা করেননি আজিজ।

এই ইমাম পত্রিকাটিকে আরও বলেন, তামিমকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কোনো ব্যক্তি বলে মনে হতো না। ভালো ছাত্র হলেও ক্লাসে সামনের সারিতে না বসে সব সময় পেছনের আসনে বসতেই পছন্দ করতেন। ২০১২ সালে ইমাম নাভায়েদ আজিজ তার কর্মস্থল ছেড়ে ক্যালগ্যারির ইসলামিক তথ্যকেন্দ্রে যোগ দেন। এ কেন্দ্রে তার প্রথম জুমার খুতবা দেওয়া শেষে তামিমকে দেখে তিনি দারুণভাবে বিস্মিত হন। তামিমও একটি তেল বা প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে ওই সময় আলবার্টায় (ক্যালগ্যারি আলবার্টার একটি শহর) চলে আসেন।

আজিজ আরও বলেন, ওই সাক্ষাতে তামিম তাকে না দেখার ভান করেন। তামিম তখন ইসলাম ধর্মে নতুন দীক্ষিত হওয়া দামিয়ান ক্লেয়ারমন্ট নামে এক ব্যক্তির পাশে ছিলেন। ক্লেয়ারমন্ট পরে কানাডার একজন সুপরিচিত সন্ত্রাসী হয়ে ওঠেন এবং বিদেশে লড়াই করতে গিয়ে নিহত হন।

আজিজ জানান, ক্যালগ্যারির শহরতলির এক স্থানে একটি পাঠচক্রে নিয়মিত অংশ নিতেন কানাডার অন্তত ছয়জন; যারা উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর হয়ে লড়াই করেছেন। তামিম ও ক্লেয়ারমন্টও এ পাঠচক্রে অংশ নিতেন। ‘ক্যালগ্যারি ক্লাস্টার’ গ্রুপের আরেক সদস্য সালমান আশরাফি ইরাকে আত্মঘাতী হামলায় নিজেকে উড়িয়ে দেন। এতে নিহত হন ৪৬ জন।

২০১৪ সালে সিরিয়া থেকে সম্প্রচারিত এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ওই গ্রুপের অপর এক সদস্য ফারাহ মোহামেদ শিরডন নিজেকে আইএসের যোদ্ধা হিসেবে দাবি করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে হুঁশিয়ার করে বলেন, আইএস হোয়াইট হাউসের মাটিতে তাদের কালো পতাকা উড়িয়ে ছাড়বে। এ বক্তব্য দেওয়ার পর তিনি তাঁর কানাডীয় পাসপোর্ট আগুনে ছুড়ে মারেন।

ক্যালগ্যারি ক্লাস্টারের কথিত সদস্যদের মধ্যে ছিলেন দুই ভাই কলিন ও গ্রেগরি গর্ডন। দুজনই ২০১৪ সালে আইএসের হয়ে লড়াই করতে গিয়ে নিহত হন।

ইমাম আজিজ ২০১৩ সালে কানাডায় উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখা শুরু করলেও তা অনেক দেরি হয়ে গেছে বলে জানান তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কানাডার যেসব তরুণ উগ্রপন্থায় ঝুঁকে পড়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগ এর আগে সিরিয়া ও ইরাকের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন। উগ্রপন্থা দমনে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি পুলিশের কাজে সহায়তাকারী আজিজ বলেন, ওই তরুণেরা খুব বিপজ্জনক বিষয়ের চর্চা শুরু করেছিলেন ২০১১ সালেই। আর সেটা তাঁদের নজরে আসে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে। অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থে তাঁরা দুই বছর পিছিয়ে ছিলেন।

তামিমকে নিয়ে নাভায়েদ আজিজের এই বক্তব্য ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলুর অধ্যাপক অমরনাথ অমরাসিঙ্গামের কথার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অমরনাথ বলেন, তার ধারণা, তামিম ২০১৪ সালে আবু দুজানা আল-মুহাজির নামে ব্লগে বেশ কিছু লেখা লিখেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে লড়াইকালে ক্লেয়ারমন্ট ও আশরাফি নিহত হওয়ার পর এসব লেখায় তাদের প্রশংসা করা হয়েছে।

পত্রিকাটি বলেছে, লন্ডনে সম্ভাব্য আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী সন্দেহে এক ব্যক্তিকে কানাডার পুলিশ গুলি করে হত্যার দুই সপ্তাহ পর নারায়ণগঞ্জে জঙ্গিবিরোধী পুলিশের অভিযানে তামিম নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটল। অনলাইনে ওই ব্যক্তির উগ্রবাদী তৎপরতার বিষয়টি ফুটে উঠলেও ক্যালগ্যারি ক্লাস্টার গ্রুপের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য জানা যায়নি।

অমরনাথ বলেন, তিনি মনে করেন, আইএস ও আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাবাত আল-নুসরার মতো বিভিন্ন গোষ্ঠীর হয়ে বিদেশে ৯০ জনের বেশি কানাডীয় বর্তমানে লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছেন।

এদিকে ক্যালগ্যারি ক্লাস্টার গ্রুপের নিহত সদস্য ক্লেয়ারমন্টের মা ক্রিস্টিয়ানা বুদরিউ বলেন, জঙ্গিবাদ দমনে উগ্রপন্থায় জড়িত সন্দেহে ব্যক্তিবিশেষকে না ধরে বরং তাঁর পরিবার ও কমিউনিটির সঙ্গে কাজ করাটা বেশি প্রয়োজন। তা না করলে তাঁর আশঙ্কা, জঙ্গিবাদের প্রক্রিয়া উল্টো গতিশীল হবে।

সরকারের সমালোচনা করে ক্রিস্টিয়ানা যুক্তি দেন, তিনি ও তার পরিবার তাদের ছেলের ব্যাপারে কিছু করার সুযোগ পাননি। কর্তৃপক্ষ তাঁদের ছেলের ওপর দুই বছর ধরে শুধু নজরই রেখেছিল। এই সময়ে তারা ইতিবাচক কিছু করেনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বলছে জঙ্গিরা সব দেশজ (হোমগ্রোন)। কিন্তু তামিম তো দেশজ জঙ্গি না। তামিমের বিষয়টাতেই প্রমাণিত হয়, এদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগও রয়েছে। তামিম কানাডা থেকেই উগ্রপন্থার দীক্ষা নিয়ে সিরিয়া গিয়েছিলেন বলে সেখানকার পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সিরিয়া থেকে আবার কানাডা ফিরে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। ধরে নেওয়া যায় কানাডায় দীক্ষা নিয়ে, সিরিয়ায় প্রশিক্ষণ শেষে সাংগঠনিক একটা সিদ্ধান্তেই তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন।

এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, তামিমের সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে তাতে মনে হয়েছে, তিনি মাঠের একজন সমন্বয়ক, যিনি সিদ্ধান্তগুলোকে বাস্তবায়নের পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাত্ত্বিক পর্যায়ের নেতা নন। তাদের তাত্ত্বিক নেতা নিশ্চয়ই কেউ আছেন। যিনি হয় বাংলাদেশে বা সিরিয়ায় বা অন্য কোনো জায়গায় আছেন। তাত্ত্বিক বিষয়টি তাদের কাছ থেকে আসছে। - প্রথম আলো
৩০ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস‌‌‌‌

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে