সিরাজুল ইসলাম : গত ১ জুলাই রাতে রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে চালানো হয় সন্ত্রাসী হামলা। ভয়াবহ এ হামলার দুই মাস পূর্তি হলো বৃহস্পতিবার।
ইতোমধ্যে ঘটনার মাস্টারমাইন্ড তমিম চৌধুরীসহ কয়েকজন পুলিশের অভিযানে নিহত হলেও আরও ৪-৫ জনকে খুঁজছে পুলিশ।
এদিকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত আলামতের রাসায়নিক পরীক্ষার এখনও ফল হাতে পায়নি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এফবিআইয়ের পরীক্ষাগারে থাকা ওই আলামত থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কোনো ক্লু পাওয়া যেতে পারে বলে ধারণা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
মামলার অগ্রগতি জানতে চাইলে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, অর্থ সংকট দূর করতে গুলশান হামলার সঙ্গে জড়িতরা ফেক ইন্ডিয়ান কারেন্সি ব্যবহার করতো। একটি বিদেশী এজেন্সিকে (গোয়েন্দা সংস্থা) দিয়ে ওই কারেন্সি ছাপানো হতো। তাছাড়া দেশে ব্যক্তি পর্যায়েও কেউ কেউ তাদের অর্থায়ন করেছে।
তিনি বলেন, মামলার তদন্তে অনেক ক্লু বেরিয়ে আসছে। গত দুই মাসের তদন্তে পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরীসহ কয়েকজন কমান্ডারের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিল।
মনিরুল ইসলাম বলেন, জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা আপাতত চুপ থাকলেও তারা যেকোনো সময় সক্রিয় হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, গুলশানে হামলার আগেই গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল যে, বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা হবে। তবে হামলাটি কোথায় হবে সে বিষয়ে পরিষ্কার তথ্য ছিল না।
কাউন্টার টেরোরিজম প্রধান জানান, গুলশান হামলার পর জঙ্গিবিরোধী ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়েছে। ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ আরও কয়েকজনকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা এখন আত্মরক্ষায় মরিয়া। এ কারণে গত দুই মাসে তারা কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটায়নি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) সাইফুল ইসলাম বলেন, গুলশানের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। হামলার মূল পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরী নিহত হয়েছে।
তিনি জানান, গুলশান হামলার ঘটনায় নুরুল ইসলাম মারজানসহ অন্তত ৪-৫ জনের সন্ধান করা হচ্ছে। তাদের সাংগঠনিক নাম পাওয়া গেছে। যেসব সন্দেহভাজনদের সনাক্ত করা হয়েছে তাদের সবার নাম-পরিচয় এখনই প্রকাশ করা ঠিক হবে না। এমনকি তাদের সাংগঠনিক নামও প্রকাশ করা যাচ্ছে না।
এক প্রশ্নের জবাবে এডিসি সাইফুল ইসলাম বলেন, গ্রেফতারকৃত হাসনাত করিম ও তাহমিদের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের দেয়া তথ্যে কিছু গরমিল পাওয়া গেছে। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। এই দুইজনকে ফের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানানো হতে পারে।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, গুলশান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী নিহত হয়েছে। তবে তার কিছু সমর্থক এখনও রয়ে গেছে। তারা দুর্বল হলেও শেষ হয়ে যায়নি।
তিনি জানান, আত্মগোপনে থাকা কয়েক জঙ্গিকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। তাদের কয়েকজনের চেহারার বর্ণনা পাওয়া গেছে। আশা করা যাচ্ছে, দ্রুতই গ্রেফতার করা যাবে। তাদের ধরতে পর্যাপ্ত সোর্স নিয়োগ করা হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা জানান, গুলশান হামলার তদন্তের সূত্র ধরে অন্তত দেড় ডজন জঙ্গির খোঁজ পাওয়া গেছে। তারা মাঠ পর্যায়ের নেপথ্যে থেকে জঙ্গিদের নানা ধরনের সহযোগিতা করছে।
তিনি বলেন, বসুন্ধরার নর্থ সাউথের এক শিক্ষকের বাসায় বসে হত্যাযজ্ঞের ছক একে করে তামিম চৌধুরী। এ ঘটনায় গ্রেফতার নর্থ সাউথের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমের সম্পৃক্ততা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে তাকে দুদফা রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
ছানোয়ার হোসেন জানান, গুলশানে হামলার পরিকল্পনা করা হয় চলতি বছরের এপ্রিলে। জঙ্গিদের ব্যবহৃত অস্ত্র পার্শ্ববর্তী একটি দেশ থেকে অবৈধ পথে এসেছিল।
তিনি বলেন, তামিম চৌধুরী ২০১৩ সালে কানাডা থেকে দেশে ফেরার পর নব্য জেএমবিকে নতুনভাবে চাঙ্গা করার দায়িত্ব নেয়। নারায়ণগঞ্জের নিহত তওসিফ ছিলেন তামীম চৌধুরীর ব্যক্তিগত সহকারী। তার সঙ্গে ছিল গাইবান্ধার রাজীব নামের এক যুবক। গুলশানসহ বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনায় রাজীবের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, গুলশানের ঘটনার মূল প্রশিক্ষক রায়হান কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নিহত হয়। মাঠ পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে নিবরাস ইসলাম, রোহান ইমতিয়াজ, মীর সামীহ মুবাশীর, শরিফুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ, খায়রুল ইসলাম পায়েল, আবীর রহমান, শফিকুল ইমলামসহ কয়েকজনকে মগজধোলাই করে প্রশিক্ষণ দিতে ঝিনাইদহ ও গাইবান্ধায় নেয়া হয়। সেখানে প্রশিক্ষণ শেষে তাদের দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। একটি অংশকে দায়িত্ব দেয়া হয় গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা করতে, আরেকটি গ্রুপ অংশ নেয় শোলাকিয়ায়।
ভাড়াটিয়াদের তথ্য না রাখা ও তথ্য গোপন করার অভিযোগে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি গিয়াসউদ্দিন আহসানসহ চারজনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়। তবে তাদের জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া হলি আর্টিজান বেকারির আশপাশের সড়কে ঘটনার আগে অবস্থানরত এক নারীসহ চার সন্দেহভাজনের ভিডিও প্রকাশ করেছিল আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট অন্য এক কর্মকর্তা জানান, গুলশান হামলায় অপারেশন ইউনিটের প্রধান ছিল রোহান ইমতিয়াজ। তার দিক নির্দেশনায় ছয় জঙ্গি সেখানে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়।
একাধিক সূত্র জানায়, মোবাইল ফোনসেট ছাড়াই হামলাকারীরা গুলশানে যায়। এরপর তারা জিম্মিদের অন্তত পাঁচটি মোবাইল ফোনসেট ব্যবহার করে। এদের মধ্যে হাসনাত করিম ও তাহমিদের মোবাইল ফোনও ব্যবহার করা হয়। এই দুজনের মোবাইল ফোন দিয়ে জঙ্গিরা বিশেষ একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিহতদের ছবি নুরুল ইসলাম মারজানের কাছে পাঠায়।
তদন্তের সঙ্গে যুক্ত অন্য এক কর্মকর্তা জানান, গুলশানে হামলার ঘটনায় তারা কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন। এসব প্রশ্নের অন্যতম- জঙ্গিদের বিশেষ ধরনের কোনো উত্তেজক ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল কি না। এ ব্যাপারে জানতে দেশে জঙ্গিদের ভিসেরা প্রতিবেদনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে এফবিআই'র ল্যাবে আলামত পাঠানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই আলামত পেতে অন্তত তিন মাস লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গুলশানের ভয়াবহ জঙ্গি হামলা প্রতিহত করতে গিয়ে নিহত হন সাহসী দুই পুলিশ কর্মকর্তা। ওই রাতের বিভীষিকা কেড়ে নেয় ১৭ বিদেশী নাগরিকসহ ২০ জনের তাজা প্রাণ। কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় পাঁচ হামলাকারী ও এক সন্দেহভাজন। - যুগান্তর
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি