সোমবার, ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:৫৩:২৩

তামিমের সঙ্গে কানাডায় পরিচয় মেজর জাহিদের

তামিমের সঙ্গে কানাডায় পরিচয় মেজর জাহিদের

আবুল খায়ের : শেওড়াপাড়ার বাসায় বসে হলি আর্টিজানের হামলা মনিটর করেন মেজর জাহিদ ও তামিম বিভিন্ন স্থানে হামলার জন্য গাইবান্ধায় ৭ জনকে প্রশিক্ষণ দেন মেজর জাহিদ উত্তরবঙ্গে হামলা বন্ধ করে ঢাকায় হামলার সিদ্ধান্ত হয় নাটোরে বসে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতৃত্বে বহু পরিবর্তনের পর এখন যারা দায়িত্বে আছে তারা প্রযুক্তিতে অত্যন্ত দক্ষ।

বলা হচ্ছে, পাঁচ ‘স্তম্ভের’ উপর ভর করে টিকে আছে এই সংগঠন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এটাকে বলছে ‘নব্য জেএমবি’। এদের সামরিক শাখা যেমন দক্ষ, তেমনি দক্ষ নেতাদের নেতৃত্বগুণও। নতুন নেতৃত্বের এই পাঁচ স্তম্ভের দুই জন ইতিমধ্যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছেন। তারা হলেন- তামিম আহমেদ চৌধুরী ও সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম। এর মধ্যে তামিম ছিলেন মাস্টারমাইন্ড আর জাহিদুল ছিলেন ছিলেন সামরিক কমান্ডার। এখন তিন জন আছেন পুলিশের ‘হিট লিস্টে’। তারা হলেন- নুরুল ইসলাম মারজান, মামুনুর রশীদ রিপন ও মানিক।

আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, গেল বছর সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার আগে জাহিদুল ইসলাম কানাডা যান। সেখানেই পরিচয় হয় তামিম আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে। সেখানেই জঙ্গিবাদে হাতিখড়ি হয় জাহিদুলের। সেখান থেকে সিরিয়া বা অন্য কোথাও তিনি গেছেন কি-না আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সেটা নিশ্চিত হতে পারেনি। অল্প দিনের মধ্যে নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে নব্য জেএমবির সামরিক শাখার দায়িত্বও পান। দেশে ফিরে এক বছর আগে তিনি অবসরে যান।

সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে মিরপুরের রূপনগরে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন জাহিদুল। তাকে সবাই জাহাঙ্গীর ওরফে মুরাদ বলেই চিনত। আর গত ২৭ আগস্ট নারায়নগঞ্জে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক অভিযান মারা যান তামিম। দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, তামিম ও জাহিদুলের অনুপস্থিতিতে অপর তিন জনের যে কারও সংগঠনের সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা আছে। মারজান, রিপন ও মানিক– এই তিন জনের যে কেউ এখন সর্বোচ্চ দায়িত্বে আসতে পারে। নাটোর বসেই প্রথম বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করে জঙ্গিরা। পরে তারা ঢাকায় আসে।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘মারজান, রিপন ও মানিককে গ্রেফতারের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। এরা ততটাই ভয়ঙ্কর, যতটা ছিল তামিম ও জাহিদুল। এদের নিয়মিত অবস্থান বদল করায় খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে। তবে কোনভাবেই এরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে থাকতে পারবে না। আমরা তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে জঙ্গিরা এখন আস্তানা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এই মুহুর্তে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর মতো শক্তি নেই। জনগন সহযোগিতা করলে জঙ্গিরা টিকতে পারবে না।’

পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, পলিয়ে থাকা তিন জনের মধ্যে রিপন পরিকল্পনা বৈঠকে অংশ নিতেন। গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার আগে মিরপুরের শেওড়াপাড়ার একটি বাসায় অবস্থান করছিলেন রিপন ও তামিম। আর হামলাকারীরা ছিল বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। মারজান তাদের হলি আর্টিজানে পৌঁছে দিলেও তামিম শেওড়াপাড়াতেই ছিল। হামলাকারীরা হলি আর্টিজান থেকে শেওড়াপাড়ায় তামিম ও জাহিদের সঙ্গে ইন্টারনেটে যোগাযোগ রাখে। আর সব বাসা ভাড়া নেয় জাহিদ। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় জাহিদ নিজে অবস্থান করছিল। আর পাইকপাড়ার বাসাটিও ভাড়া নেয় সে। সেখানে ছিল তামিম। মিরপুরের রূপনগর থেকে বাসা সরিয়ে ফতুল্লা যাওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল জাহিদ। কিন্তু তার আগেই রূপনগরেই মারা যায় সে। রিপন ও মানিক কোথায় আছে সেটি নিশ্চিত নয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।

এদিকে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেনে, শরীফুল ইসলাম ওরফে খালিদ নামে একজন উত্তরাঞ্চলে জেএমবির দায়িত্বে আছে। সেও ভয়ঙ্গর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম হত্যা মামলার আসামী সে। এই হত্যাকান্ডের দুই দিন পর চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। বর্তমানে সে ভারতে আছে বলেই ধারণা গোয়েন্দাদের। পাশাপশি এদের সঙ্গে আত্মঘাতি দুই জঙ্গি চকলেট ও গান্ধি আছে পুলিশের টার্গেটে। জঙ্গিদের কার্যক্রম তদন্তের দায়িত্বে আছেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, প্রথমে ৭ জন আত্মঘাতি দিয়ে কার্যক্রম শুরু করে তামিমরা। এদের মধ্যে চারজনকে সংগ্রহ করেন তামিম আর তিন জনকে সংগ্রহ করেন মারজান। এরপর ওই ৭ জনকে গাইবান্ধায় নিয়ে প্রশিক্ষন দেন জাহিদুল। এদের ৫ জন গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলায় অংশ নেয়।

কুমিল্লা সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়নের চাঁন্দপুর এলাকার বাসিন্দা পুলিশের সাবেক পরিদর্শক নুরুল ইসলামের ছেলে জাহিদুল ইসলাম। স্থানীয় একাধিক বয়ো:বৃদ্ধ জানান, গত রমজান মাসে জাহিদের বাবা নুরুল ইসলাম মসজিদে বলেছিলেন, জাহিদ সেনাবাহিনীর মেজরের চাকুরি ছেড়ে কানাডা চলে গেছে। এরপর আর কিছু তারা জানেন না।

আমাদের কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, গত শুক্রবার থেকেই ঢাকায় চিকিত্সার নাম করে বাড়ি ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছেন তার বাবা-মা। এলাকায় এ জাহিদুল ইসলাম মেজর জাহিদ হিসেবে পরিচিত। পত্রিকায় তার ছবি ও পরিচিতি প্রকাশ পাওয়ার পর গতকাল রবিবার সকাল থেকে চাঁনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সড়কের পাশের এই বাড়িটি ঘিরে রাখে আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। ওই বাড়িটি ঘিরে গতকাল দুপুর পর্যন্ত উত্সুক জনতার ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।

জানা যায়, কুমিল্লার সদর উপজেলার পশ্চিম চাঁনপুর গ্রামের চাঁনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সড়কের পাশে তার (জাহিদুল ইসলাম) বাবার ‘ড্রিমস্’ নামীয় একটি ৩ তলা বিশিষ্ট বাড়ি রয়েছে। এর ফটকে লাগানো নামফলকে লেখা রয়েছে ‘মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, ইন্সপেক্টর অব পুলিশ, অবসরপ্রাপ্ত আর.আই’। রবিবার সকাল থেকে ওই ৩ তলা ভবনটিকে ঘিরে রেখেছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ওই ভবনের নিচতলায় এবং তৃতীয় তলায় ২টি ভাড়াটিয়া পরিবার বসবাস করছেন। দ্বিতীয় তলায় অবসরপ্রাপ্ত ওই পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী জেবুন্নাহার ইসলাম ওরফে জামিলা ইসলামসহ পরিবারের সদস্যরা বসবাস করছিলেন। স্বপন দাস নামে ওই বাড়িসংলগ্ন স্থানীয় এক দোকানী জানান, বাড়ির মালিক নুরুল ইসলামের পৈত্রিক বাড়ি সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জে। তিনি চট্টগ্রামে পুলিশ বিভাগে চাকুরী করেছেন। প্রায় ৩০ বছর আগে ১৯৮৫ সালের দিকে তিনি জনৈক সেলিম মিয়ার বোন থেকে জায়গা কিনে ২ ইউনিটের ৩ তলা বিশিষ্ট এ বাড়িটি নির্মাণ করেন। তার ২ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে নিহত মেজর জাহিদুল ইসলাম সকলের বড়। এলাকায় সে মেজর জাহিদ নামেই বেশ পরিচিত। জাহিদুল ইসলাম বিবাহিত ও ২ কন্যা সন্তানের জনক।

জাহিদের অপর ভাই জহিরুল ইসলাম ঢাকায় একটি মোবাইল ফোন কোম্পানিতে চাকুরী করেন। বোন সানিয়া বিবাহিতা, তিনিও ঢাকায় থাকেন। গত শুক্রবার অসুস্থতার কথা বলে চিকিত্সার নাম করে তারা দু’জন (স্বামী-স্ত্রী) ঘরে তালা লাগিয়ে ঢাকায় চলে যান। নিচতলার ভাড়াটিয়া আইনজীবী সহকারী জয়নাল আবেদীনের কলেজপড়ুয়া ছেলে আরমান জানান, তারা প্রায় ৩ বছর যাবত এ বাড়িটিতে ভাড়া থাকেন। গত ৫-৬ মাস আগে মেজর জাহিদ এ বাড়িতে এসেছিলেন। এরপর আর দেখিনি। স্থানীয় এলাকার লোকজন জানান, জাহিদ জঙ্গি কাজে জড়িত কি-না তা তারা জানেন না। গতকাল সকালে সংবাদ মাধ্যমে তারা তার (জাহিদ) সম্পর্কে জেনেছেন।

কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো. শাহ আবিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, প্রতিবেশিদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জাহিদুল ইসলাম সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তার বাবা ও মাকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন বিভিন্ন স্থানে জাহিদ ও তার পরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের জন্য খোঁজ-খবর নিচ্ছে। -ইত্তেফাক
৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে