মানসুরা হোসাইন : ‘ঘর খালি খালি লাগে। রোজার ঈদে মেয়েটা কত আনন্দ করল। নিজে হাতে মেন্দি লাগাইল। আমার হাতে মেন্দি লাগাইয়া দিল। আর এবার ঈদে ঘরের মধ্যে আমার বাচ্চাটা নাই। ঘরের ওয়ালে প্লাস্টিকের প্রজাপতি লাগাইয়া রাখছিল। ওই প্রজাপতিটা আছে, খালি আমার প্রজাপতিটাই উইড়া গেল।’
কথাগুলো বলছিলেন সুরাইয়া আক্তারের (রিসা) মা তানিয়া হোসেন। রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রিসা গত ২৮ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
২৪ আগস্ট পরীক্ষা শেষে স্কুলের সামনের পদচারী-সেতু দিয়ে সড়কের ওপারে যাওয়ার সময় বৈশাখী টেইলার্সের কর্মচারী ওবায়দুল খান তাকে ছুরিকাঘাত করেন বলে অভিযোগ।
পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে রিসাদের বাসায় এবার ঈদের আয়োজন নেই। আছে শুধু হাহাকার। তানিয়া হোসেন বলেন, ‘আমার মেয়েটা ঈদের জন্য ক্রিম রঙের একটা গাউন কিনছিল। আরেকটা গজ কাপড় কিনছিল। জর্জেট কাপড় দিয়া গাউন বানাইতে চাইছিল। সব পইড়া রইছে। ঘরের মধ্যে কেমনে ঈদের আয়োজন করি?’
তানিয়া বলেন, ‘আমার মেয়েটা মিশুক আছিল। কোরবানির মাংস বিভিন্ন ফ্ল্যাটে খুশি মনে দিয়া আসত। আমি যতটুকু ভাগ করতাম, মেয়ে আবার তার চাইতে বেশি দিয়া প্যাকেট বানাইত। নিজেদের মাংস থেইক্যা গরিবদের দিয়া দিত। ও যা করত, আমি আর তাতে কোনো কথা বলতাম না।’
রিসার ছোট ভাই রবি হোসেন (১১) এবং বোন রোদেলা আক্তার (৮)। তাদের পরিবারে যে ঝড় বয়ে গেছে, তা যেন সেভাবে আঁচ করতে পারছে না। তাই রোদেলা মায়ের কাছে জানতে চায়, ঈদের দিন কী কী রান্না হবে?
রিসার বাবা কেব্ল অপারেটর ব্যবসায়ী রমজান হোসেন বলেন, ‘মেয়ে হারানোর বেদনা তো আর মন থেইক্যা যায় না। অন্যদিকে ছোট দুই বাচ্চার দিকে তাকাইলে কষ্ট হয়। ওরা তো কিছু বোঝে না। ঈদ আসতেছে, তাতেই তারা খুশি।’
রমজান হোসেন বলেন, ‘আমার মেয়েটা ঈদের জামা বানানোর জন্য কাপড় কিনছিল। আর ঈদের আগেই সাদা কাপড় গায়ে দিয়া চইল্যা গেল।’
বাবা রমজান হোসেন কথা বলার সময় একটু পরপর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিলেন।
রিসার বাবা ও মা জানালেন, দরিদ্রদের খাওয়ানোর জন্য এবার ঈদে গাজীপুরে গ্রামের বাড়িতে কোরবানি দেওয়া হবে।
স্ত্রীর অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মাত্র দুই মাস আগে ছোট ছেলেমেয়ের স্কুলে আসা-যাওয়ার জন্য ভ্যান ঠিক করেন রমজান হোসেন। আর রিসা ভ্যানে যাতায়াত করছিল ঘটনা ঘটার (২৪ আগস্ট) মাত্র ১০ দিন আগে থেকে। এর মধ্যে ভ্যানে করে যাতায়াত করে মাত্র চার দিন। আর এর মধ্যেই সব শেষ।
রিসার হত্যার ঘটনায় মা তানিয়া হোসেন রমনা থানায় এলিফ্যান্ট রোডের ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্সের দরজির দোকানের কর্মী ওবায়দুলকে আসামি করে মামলা করেন। গত ৩১ আগস্ট ওবায়দুল খানকে (২৯) পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
মা তানিয়া হোসেন বলেন, ‘হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আমার বাচ্চা খালি জানতে চাইয়া বলত “আমি কি বাঁচুম?”
আইসিইউতে মেয়ের কাছে ডাক্তাররা যাইতে দিত না। যদি যাইতে দিত তাইলে আমার ১৪ বছরের বাচ্চাটারে আর একটু জড়ায় ধরতে পারতাম। আমার বাচ্চাটা আমারে বইল্যা গেছে, টেইলার্সের কর্মচারী তার শরীরে ব্যথা দিছে। আসামি গ্রেপ্তার হইছে, এখন চাই আমার বাচ্চার হত্যাকারীর সুষ্ঠু বিচার হোক।’-প্রথম আলো
১১ সেপ্টেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম