নিউজ ডেস্ক: গাজীপুরের টঙ্গীতে টাম্পাকো কারখানায় বিস্ফোরণের পর আগুনের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। গতকাল রোববার বিকেলে ধসে পড়া একটি ভবনের ভেতর থেকে আরও চারজনের মরদেহ উদ্ধার করেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এ নিয়ে এ দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯-এ। মৃত ব্যক্তির সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ১০ জন এখনো নিখোঁজ বলে জানা গেছে।
এদিকে কারখানার আগুন গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত নেভানো সম্ভব হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছেন, আগুন নেভাতে আরও সময় লাগবে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম আলম প্রথম আলোকে জানান, কারখানার মূল ভবনের পূর্ব পাশে ধসে পড়া একটি ভবনের ভেতর থেকে চারটি মৃতদেহ উদ্ধার করেছেন দমকল বাহিনীর সদস্যরা। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
গত শনিবার সকালে টাম্পাকো ফয়লস লিমিটেড নামের কারখানাটিতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ওই কারখানার তিনটি ভবন ধসে পড়ে। দুর্ঘটনার দিনই ২৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। ওই দিন দিবাগত রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিপন দাস (৩৫) নামে আরও একজনের মৃত্যু হয়।
স্বজনেরা বলছেন, এখনো নিখোঁজ রয়েছেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক। গতকাল সকাল থেকে কারখানার সামনে অবস্থান করতে দেখা যায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের। হাতে ছবি নিয়ে অনেকে আহাজারি করছিলেন। কারখানার সামনে নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত ১০ জন শ্রমিকের নিখোঁজের কথা জানানো হয় সেখান থেকে।
গতকাল দুপুরের পর কারখানার চারটি ভবনের মধ্যে একটির আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। গতকাল বিকেল সাড়ে চারটায় ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশনের কর্মী ও পুলিশ সদস্যরা ওই ভবনে উদ্ধারকাজ শুরু করেন। এক ঘণ্টা পর ভবনটির ছাদের নিচ থেকে চাপাপড়া দগ্ধ চারটি লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। লাশগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। কারখানার পূর্ব দিকে একটি ভবনে গতকাল রোববার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত আগুন জ্বলতে দেখা যায়।
উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়ার জন্য গতকাল রাতে সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলে হাজির হয়।
প্রথম আলোদুর্ঘটনার দুই দিন হয়ে গেলেও গতকাল রাত আটটা পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। টঙ্গী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, মৃত ব্যক্তিদের স্বজনদের কেউ মামলা করলে তা নেওয়া হবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (উন্নয়ন ও প্রশাসন) লে. কর্নেল মোশারফ হোসেন বিকেল চারটার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, আগুন এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। কারখানার কিছু অংশের আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে অনেক জায়গায় এখনো আগুন জ্বলছে। আগুন নেভাতে আরও সময় লাগবে।
তিনি জানান, একটি ভবন এখনো ফেটে কাত হয়ে রয়েছে। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ। তদন্ত ছাড়া আগুন লাগার সঠিক কারণ বলা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার সময় কতজন শ্রমিক ভেতরে ছিলেন, তা তাঁরা জানতে পারেননি। মালিকপক্ষও সে বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়নি। তাই দুর্ঘটনায় কতজনের মৃত্যু হয়েছে, সে বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত নন।
ভবনটির কোথাও কোথাও গতকালও আগুন জ্বলতে ও ধোঁয়া বের দেখা যায় l প্রথম আলো১০ শ্রমিক নিখোঁজ: গাজীপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবুল হাসেম প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার পর থেকে ১০টি পরিবার তাদের স্বজনের নিখোঁজের বিষয়ে তাঁদের কাছে তথ্য দিয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের ছবি, কারখানার পরিচয়পত্র তাঁরা জমা দিয়েছেন।
নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্য অনুযায়ী, নিখোঁজ ব্যক্তিরা হলেন কারখানার সিনিয়র অপারেটর নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী (৪৫), প্রিন্টিং অপারেটর মাসুম আহমেদ (৩০), ফ্লোর হেলপার মো. রফিকুল ইসলাম (৪০), সহকারী অপারেটর আজিমুদ্দিন (৩৬), সহকারী অপারেটর জহিরুল ইসলাম (৩৭), পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাজেশ বাবু (২২), হেলপার রিয়াদ হোসেন মুরাদ, প্রিন্টিং অপারেটর মো. ইসমাইল হোসেন (৪৫) এবং স্কুটিং অপারেটর আনিছুর রহমান (৩০) ও চুন্নু মোল্লা (২২)।
কারখানার পুব পাশের ধসে পড়া একটি ভবন থেকে গতকাল বিকেলে চারটি মরদেহ উদ্ধার করেন উদ্ধারকর্মীরা l প্রথম আলোস্বজনদের আহাজারি: ‘বাবা আজ আর নাশতা পাঠিয়ো না। কারখানা ছুটি দেবে আজ। আমি কারখানাতেই খেয়ে নেব।’ বাড়ির কলপাড়ে বাবা দীলিপ ডোমকে কথাগুলো বলে কারখানার উদ্দেশে বের হয়েছিলেন টাম্পাকো কারখানার পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাজেশ বাবু। রাজেশ আর নাশতা খেয়েছিলেন কি না, তা জানে না তাঁর পরিবার। দুর্ঘটনার পর থেকেই তিনি নিখোঁজ।
রাজেশের মা মিনা রানী দে ছেলের দুটো ছবি হাতে নিয়ে কারখানার পাশ দিয়ে যাওয়া আহসানউল্লাহ মাস্টার উড়ালসেতুর নিচে বসে আহাজারি করছিলেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মাত্র আট মাস আগে তিনি ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। রাজেশের বউ বন্যা রানী দে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। দুর্ঘটনার পর থেকে শুধুই বিলাপ করছেন।
মিনা রানী বলেন, ‘আমাগোরে ঘুমে রাইখাই বাড়ি থেকে বাইর হইছিল পোলাডা। খালি বাপের লগে দেখা হইছিল। আমার পোলাডারে কী আর দেখতে পারুম না?’
কারখানার জ্যেষ্ঠ মেশিন অপারেটর ছিলেন নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী (৪৫)। ২০ বছর ধরে কারখানাটিতে চাকরি করতেন তিনি। তিন সন্তানের জনক নাসির ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ।
নাসিরের ভাই হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, নাইট শিফটে কাজে গিয়েছিলেন নাসির। ভোর ছয়টায় তাঁর কাজ শেষ করে কারখানা থেকে বের হওয়ার কথা ছিল। রাতে স্ত্রীকে ফোন করে বলেছিলেন, আজ (গতকাল রোববার) কারখানা ছুটি হলে বাড়ি যাবেন তিনি।
দুর্ঘটনার দায়: দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে শিল্পমন্ত্রী আমীর হোসেন আমু বলেন, টঙ্গীর আগুনের ঘটনায় যাদেরই গাফিলতি থাকবে, তারা যে প্রতিষ্ঠানের বা সংস্থার হোক না কেন, তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। শিল্প মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে দেখা হবে কেন এ ঘটনা ঘটল। শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে সমস্ত শিল্প নগরীতে তদন্ত করে কোথাও কোনো ত্রুটি আছে কি না তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঘটনা তদন্তে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. দাবিরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটি প্রতিবেদন জমা দেবে।
এ ছাড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বিকেল চারটার দিকে কারখানাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘কারখানার মালিক কোনোভাবেই এ দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না। দায়িত্ব তাঁকে নিতেই হবে। ৪৫ বছর আগে ব্যবসা শুরু করে তিনি ব্যবসার পরিধি বাড়িয়েছেন। অথচ এর সঙ্গে অন্য শর্তগুলো তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি। এখানে যাঁরা আছেন বা স্থানীয় কেউ যদি মালিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও করেন, তবে তাঁর সঙ্গে মানবাধিকার কমিশন থাকবে।’
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, দুর্ঘটনা তদন্তে যেসব কমিটি সরকারিভাবে বা স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হয়েছে, তারা ঠিকভাবে তদন্ত করছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা হবে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, যাদের গাফিলতির কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তিনি বলেন, রানা প্লাজার ঘটনা সারা বিশ্ব দেখেছে। এ ঘটনাও দেশ-বিদেশের মানুষ দেখবে। এ ধরনের ঘটনা দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়।-প্রথম আলো
১২ সেপ্টেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর