নিউজ ডেস্ক: ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ)। সামনেই এক ফালি করিডরে বিলাপ করছিলেন মিমি আক্তার। একমাত্র সন্তান তানভীরকে (৮) কোলে জড়িয়েই তাঁর ওই হাউমাউ কান্না। পাশে দাঁড়ানো মিমির বড় ভাই মিজানুর রহমান জানান, তাঁর ছোট বোনের স্বামী ইকবাল হোসেন মীর টঙ্গীতে কারখানায় বিস্ফোরণে মারাত্মক আহত হন। তাঁর শরীরের বিভিন্ন অংশে কাচ ঢুকে পড়ে। দ্রুত বের হতে গিয়ে মাথায় আঘাত পান। প্রথম দিন ছিলেন অজ্ঞান। দ্বিতীয় দিন গতকাল রবিবার জ্ঞান ফিরলেও এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।
মিজানুর রহমানের চোখে-মুখেও দুশ্চিন্তার ছায়া। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আইসিইউতে চিকিৎসা হচ্ছে ইকবালের। যখন হাসপাতালে নিয়ে আসি, ডাক্তাররা আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন।’ মাদারীপুর সদরে তাঁদের বাড়ি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, ঈদের আগেই ইকবালের বাড়িতে চলে আসার কথা ছিল। কিন্তু ছুটি পায়নি। যদি তখন ছুটি পেত, তাহলে এখন আইসিইউতে থাকতে হতো না।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ‘ক্যাজুয়ালটি’ বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন বাগেরহাটের জাকির হোসেন (৪৫)। গাজীপুরের টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরীর টাম্পাকো ফয়েলস নামের ওই প্যাকেজিং কারখানায় সহকারী অপারেটর হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। সেদিন সকালে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে ধসে পড়ে দেয়াল। সেই দেয়ালে মেরুদণ্ডে আঘাত পান জাকির। এ ছাড়া পা ও কোমরে আঘাত পান। ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে তিনি বললেন, ‘ভাই, আমি খুব গরিব মানুষ। আমার কিছু হলে পরিবারটা শেষ হয়ে যাবে।’
অবজারবেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন ফেরদৌস (৩২) নামের কারখানার আরেক কর্মী। তাঁর দুটি পা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘সকাল ৬টার সময় কারখানায় দ্বিতীয় শিফটের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। দ্বিতীয় শিফটের লোকজন আসছিল। শতাধিক কর্মচারী। আমার কাজও পড়ছিল ওই শিফটে। কারখানায় ঢোকার পাঁচ মিনিট পরই প্রচণ্ড শব্দ পাই।’ চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরণের পরপরই চারদিক থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়। ভবনটির দেয়াল ধসে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। কিভাবে যে বের হয়েছি, একমাত্র আল্লাহ তা বলতে পারবেন।’
গাজীপুরের কারখানায় বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ড ও ভবনধসে আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাঁরা চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাঁদের আর্তচিৎকারে এবং স্বজনদের আহাজারি ও বিলাপে ভারী হয়ে আছে হাসপাতাল চত্বর। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, তাঁর চিকিৎসার অর্থ কিভাবে জোগাবে—এমন ভাবনায় দিশাহারা আহতদের স্বজনরা। স্বজনরা দুই দিন ধরে হাসপাতালে ছুটছে এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে। কবে নাগাদ আহত ব্যক্তিরা সুস্থ হবেন—চিকিৎসকরা সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না। এ অবস্থায় পরিবারের অন্য সদস্যরা কিভাবে চলবে তার কোনো ঠিক নেই। ঈদের আগে এ ঘটনায় তাদের মন থেকে কেড়ে নিয়েছে সব আনন্দ। ঈদ এবার তাদের হাসপাতালেই করতে হবে।
আহতদের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কামরুল ইসলাম, শাহিন আকমল, মনোয়ার হোসেন জানান, পবিবারের একমাত্র উপার্জনকারী তাঁরা। তাঁদের কিছু হলে গোটা পরিবাররকে পথে নামতে হবে। হাসপাতালে ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে, ক্যাজুয়ালটি ইউনিটের পাশে, অবজারবেশন ইউনিটের সামনে আহতদের স্বজনদের ভিড় লেগেই আছে। সবার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া।
গত শনিবার সকালে টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীতে টাম্পাকো ফয়েলস নামের প্যাকেজিং কারখানায় বিস্ফোরণের পর আগুন ধরে যায়। এতে পাঁচ তলা কারখানা ভবনের কাঠামোও ধসে পড়ে। আগুনে দগ্ধ হয়ে এবং ভেঙে পড়া ভবনের নিচে চাপা পড়ে গতকাল রাত পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাড়িয়েছে ২৯-এ। আহত অন্তত ৩৫ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, টঙ্গী সরকারি হাসপাতাল ও উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ওই ঘটনায় আহত ১৫ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অগ্নিদগ্ধ তিনজনকে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। অগ্নিদগ্ধদের মধ্যে রিপন দাসের শরীরের অন্তত ৯০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত শনিবার রাতে তিনি মারা যান। আহতদের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৫ জন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আহতদের প্রত্যেকের অবস্থা প্রথম দিনের তুলনায় ভালো। চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। ঈদের ছুটি হলেও তাঁদের জন্য চিকিৎসা কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
গতকাল বিকেলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহতদের দেখতে এবং চিকিৎসার খোঁজ নিতে আসেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বিমান কুমার সাহা। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিজানুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা ঘুরে দেখেন টঙ্গীর ঘটনায় আহতদের।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বিমান কুমার সাহা বলেন, আহতদের সব ধরনের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ছুটির মধ্যে আহতরা চিকিৎসাসেবা পাবেন। এ বিষয়ে চিকিৎসকরা তৎপর রয়েছেন।-কালের কন্ঠ
১২ সেপ্টেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর