হাবিবুর রহমান খান : বড় ধরনের পরাজয়ের আশংকা থেকেই সরকার জেলা পরিষদ নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট নেয়া থেকে পিছিয়ে এসেছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশে জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে আসন্ন জেলা পরিষদ নির্বাচনে সরকারের ভরাডুবি হওয়ার আশংকা রয়েছে।
বিশেষ করে মেয়াদপূর্তির দু’বছর বাকি থাকতে এ নির্বাচনের ফলাফল জনমত জরিপের বড় ব্যারোমিটার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে পারত। কিন্তু সে সুযোগ থেকে সরকার শুধু জনগণকেই বঞ্চিত করেনি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ভোটের সংস্কৃতিতে কুঠারাঘাত করেছে। এতে প্রকারান্তরে অবশিষ্ট গণতন্ত্র আরও ক্ষতিগ্রস্ত হল।
জেলা পরিষদ নির্বাচনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভোটে চেয়ারম্যানসহ ২১ সদস্যের জেলা পরিষদ নির্বাচনের পদ্ধতি প্রবর্তনে সরকার আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়ায় বিএনপি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে যুগান্তরের কাছে এমন মন্তব্য করেন। তারা বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে প্রতিটি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ভোট কারচুপি করা হয়। যার ফলে বিজয়ী প্রার্থীদের বেশিরভাগ সরকারি দলের।
সঙ্গত কারণে এখন তাদের ভোটে জেলা পরিষদ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা সহজ জয় পেয়ে যাবেন। এ পদ্ধতির নির্বাচনের সঙ্গে সরকারের সিলেকশন ভোটের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যেমন বর্তমানে আছে। তবে তারা এও মনে করেন, এসব করে সরকারের প্রতি জনগণের ক্ষোভ-অসন্তোষ আরও বাড়ছে। অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার কারণে জনগণের এমন নীরব মেসেজ বুঝতে পারছে না।
তবে জাতীয় নির্বাচনের সময় সাধারণ জনগণের সব প্রতিক্রিয়া উন্মুক্ত হয়ে যাবে। সে সময় সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পদে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী থাকলেও নির্বাচনকালীন সরকারকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। সে সময় আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি কেউই এককভাবে সরকার ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারবে না। জনগণের চাপের মুখে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকেও কোমর সোজা করে ভূমিকা রাখতে হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, স্থানীয় সরকার সিস্টেমটাকেই ক্ষমতাসীনরা ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর আগে উপজেলা, পৌর ও ইউপি নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হওয়ায় নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রবল আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। মূলত জনগণের প্রতি সরকারের আস্থা কমে যাওয়ার কারণেই তারা জোর করে নির্বাচনে জেতার কৌশল নিয়েছে।
তিনি বলেন, স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জেলা পরিষদ। জনগণের সরাসরি ভোটে জেলা পরিষদ নির্বাচন না দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের ভোটে নির্বাচন দেয়ার পেছনে রহস্য রয়েছে। তিন পার্বত্য জেলা ছাড়া অবশিষ্ট ৬১টি জেলায় সরাসরি নির্বাচন হলে সরকারের জনপ্রিয়তার আসল মুখোশ উন্মোচন হতো। কিন্তু জনসমর্থন নিয়ে যথেষ্ট শংকা থাকায় সরাসরি ভোট না দিয়ে সরকার এমন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য শুভ লক্ষণ নয়। গণতন্ত্রের রীতিনীতি ধ্বংস করে দিয়ে আওয়ামী লীগ নতুন কৌশলে বাকশাল কায়েমের যে চেষ্টা চালাচ্ছে এটা তারই অংশ বলে মনে করেন ফখরুল।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিগত সময়ে সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরাসরি ভোট দিয়ে সরকার একটা ইতিবাচক ধারা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে জেলা পরিষদ নির্বাচনে সেই ধারা থেকে সরে আসায় রহস্যের জন্ম দিয়েছে। জনপ্রিয়তা নেই এমন আশংকা থেকেই সরকার জনগণের ভোট নেয়া থেকে সরে এসেছে। তিনি বলেন, এখন যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে সেটা অনেকটা পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের ‘বেসিক ডেমোক্রেসি’র মতো।
এদিকে জেলা পরিষদ নির্বাচনে সরকারের নেয়া উদ্যোগ স্বাগত জানিয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তবে তিনি এও বলেন, যে প্রক্রিয়ায় জেলা পরিষদ নির্বাচন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে এটি কার্যকর কোনো প্রতিষ্ঠান হবে না। বরং গণতান্ত্রিক চেতনার বিপরীতে অবস্থান নেবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, এমন জেলা পরিষদ চাই না যেখানে জনসাধারণের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা থাকবে না। বর্তমানে যে আইন হচ্ছে তাতে জনগণ নয়, সরকারি লোকদের ক্ষমতায়ন করা হচ্ছে। অনুমোদিত জেলা পরিষদ আইনটি সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আর তাই অধ্যাদেশ বা মূল আইন করার আগে সরকারের প্রতি আইনটি পুনরায় মূল্যায়ন করার দাবি জানাচ্ছি।
এক প্রশ্নের জবাবে বদিউল আলম বলেন, যারা এ আইনটি সংশোধন করেছেন তারা অনেক কিছুই বিবেচনায় নেননি। অনেকটা গোঁজামিলের আশ্রয় নিয়েছেন। দলীয়ভাবে সরাসরি নির্বাচনের বিধান না রাখার পেছনেও তাদের অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে।
জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে নির্বাচনের বিধান রাখার বিরোধিতা করে বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, বর্তমানে যেভাবে আইনটি সংশোধন করা হয়েছে তা সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী। এটা স্থানীয় সরকার শাসন হবে না, হবে স্থানীয় নেতাদের শাসন। শুধু এ সরকার নয়, প্রতিটি সরকারই ওই পদগুলোতে দলীয় ক্যাডার বসিয়েছে।
তিনি বলেন, ৪ বছরে কোনো উদ্যোগ না নিয়ে হঠাৎ তড়িঘড়ি করে সরকারের এ আইন সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েও জনমনে নানা প্রশ্ন ওঠেছে। তিনি মনে করেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজেদের লোক বসাতে পারলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অনেক সুবিধা হবে এমনটা ভেবে হয়তো এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ২৮ আগস্ট জেলা পরিষদ আইন-২০০০ (সংশোধিত) ২০১৬ মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিয়েছে।
এতে সরাসরি ভোটের বিধান না রেখে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচনের বিধান সংযুক্ত করা হয়। তবে আইনটি সংশোধনে পাস করার এর ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো যাচাই-বাছাইয়ের দাবি উঠেছে। সুজনের পক্ষ থেকে শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ নির্বাচন পদ্ধতির কঠোর সমালোচনা করে জেলা পরিষদ নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট দেয়ার দাবি জানানো হয়। - যুগান্তর
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি