ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম (অব.) : আট বছরব্যাপী শাসনের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন দিগন্তের সূচনা করেছেন। সম্প্রতি ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপমহাদেশ সফর সামনে রেখে এ প্রশ্ন আমরা করতেই পারি, ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক কি নতুন মোড় নিচ্ছে? নাকি আমেরিকা ও ভারতের অভিন্ন স্বার্থের যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে, নির্ধারিত হয়েছে কমন শত্রু নিধনের কর্মপদ্ধতি- চলুন, তা অনুধাবনের চেষ্টা করি।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধারা, ভারত স্বাধীন হওয়ার পর (১৯৪৭ সাল) আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। ১৯৫৪ সালে আমেরিকা CENTO এর সদস্য হিসেবে পাকিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করে। পাক-আমেরিকান ওই সম্পর্কের জন্য ভারত তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ভারত পরবর্তীকালে NAM-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে NAM- প্রতিষ্ঠা করে এবং বিশ্বব্যাপী আগ্রাসন ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়; যা প্রকারান্তরে আমেরিকাবিরোধী জোটও বলা যেতে পারে।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ায়, প্রায় এক কোটির বেশি নাগরিকদের স্থান দেন, যুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করে- যাতে স্বল্প সময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি। শুধু তাই নয়, ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গেও বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদন করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। এতে ভারত-আমেরিকা দূরত্ব বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।
জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে শুরু থেকেই (২০০৪ সাল) ভারতের সঙ্গে বুশ প্রশাসন ভালো যোগাযোগ রক্ষা শুরু করেন। তার কারণগুলো হল- ভারত দ্রুত সম্প্রসারণশীল মুসলিম জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে (তাদের মতে) যথোপযুক্ত (!) ব্যবস্থা নেয়া ছাড়াও বুশকে আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রো-ইন্ডিয়ান প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিহিত করে। ২০০৪ সালের সুনামিতে আমেরিকা ভারতীয় নেভির ব্যাপক সহযোগিতা অর্জন করেছিল। ২০০৫ সালে ভারত-আমেরিকা সামরিক প্রশিক্ষণ চুক্তিতে (১০ বছরের) আবদ্ধ হয়, যাতে যৌথ প্রশিক্ষণ, উন্মুক্ত আকাশ নীতি, আমেরিকান যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি প্রাধান্য পায়।
এয়ার ইন্ডিয়া আমেরিকা থেকে ৬৮টি বোয়িং বিমানের ক্রয় আদেশ দেয়, যার মূল্য ছিল প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ থেকে ২০১০ সালে কেবল ১ লাখ ভারতীয় শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণের জন্য আমেরিকা যায়। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সরকারের সফল পরিচালন, কেন্দ্র ও প্রদেশগুলোর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও উন্নয়ন, ভারতের সুষ্ঠু নির্বাচন পদ্ধতি, যা গণতান্ত্রিক বিশ্বে সর্ববৃহৎ; ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকা(!) ও অন্য দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, ভারতের পার্লামেন্টের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ- এসবই ভারতকে পৃথিবীর বুকে দিন দিন ভালো ও উন্নত আসন লাভের পটভূমি তৈরি করেছে।
অবশ্য ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হিংস্র ও মানবতাবিরোধী একটি বিষয় আন্তর্জাতিক মহলে উঠে এসেছে। কাশ্মীর, আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল ইত্যাদি রাজ্যে বিছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষ ও পরবর্তী সামরিক অভিযানে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ, হত্যা, ধ্বংস ইত্যাদিতে ভারত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। গুজরাটে মোদি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে মুসলিম নিধন, মুসলমানদের সম্পদহানি ও মুসলমানদের দোকান ক্রয়-বিক্রয় বয়কট, সাবেক সংসদ সদস্য জাফরীকে টানাহিঁচড়ার ঘটনা মোদির জন্য কলংকজনক। এজন্য মোদির ভ্রমণ ভিসা নিষিদ্ধ করেছিল আমেরিকা।
ভারত ও আমেরিকা বহু আলোচনা ও দীর্ঘদিনের দূতিয়ালি শেষে Logistics Exchange Memorandum of Agreement (LEMOA) স্বাক্ষর করে। দুটি দেশই তাদের কার্যক্রম পরিচালনার সময় পানি, অস্থায়ী বাসস্থান, চলাচল, পেট্রোলিয়াম ও লুব্রিকেন্ট, পোশাক-পরিচ্ছদ, মেডিকেল সার্ভিস, ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ ও পার্টস, রিপেয়ার এবং মেইনটেন্যান্স, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি চুক্তির বিশেষ বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
তবে LEMOA কোনোমতেই ভারতে আমেরিকার বেস স্থাপনের বিষয় নয়। শুধু যৌথ অপারেশন, মানবিক সাহায্য প্রদানকালীন এবং রিলিফ অপারেশনে তারা একে অন্যের লজিস্টিক সুবিধা ভোগ করতে পারবে। এজন্য দুটি দেশই এসব অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনার সময় নিজেদের যথাসম্ভব হালকা থাকার ও দ্রুত অপারেশন পরিচালনার এবং লজিস্টিক সামগ্রী সঙ্গে নেয়ার ঝক্কি থেকে বেঁচে গেল। সন্দেহ নেই, এতে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বেড়ে গেল এবং পারস্পরিক বিশ্বাস স্থাপিত হল। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, এতে নৌবাহিনীর জাহাজগুলো পোর্ট ভিজিটের সময়, যৌথ সামরিক প্রশিক্ষণের সময়, মানবিক সাহায্য কার্যক্রম ও রিলিফ প্রদানকালীন (দুর্যোগের সময়) পারস্পরিক সহযোগিতা পাবে। এতে লাভবান হবে দুটি দেশই।
দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা লিখেছে, এটি ভারতের জন্য বিশেষভাবে তৈরি একটি চুক্তি; যা অন্য ৬০টি দেশের সঙ্গে আমেরিকা সম্পাদন করেছে। তবে ভারতের চুক্তিটি বিশেষভাবে তৈরি ও ভারতের স্বার্থের বিষয়টি বিশেষভাবে দেখা হয়েছে। চুক্তিটির ফলে দুটি দেশই একে অপরের সামরিক স্থাপনার সুযোগ-সুবিধাগুলো লাভ করবে। দুটি দেশই এখন চুক্তিটির সফল বাস্তবায়নের জন্য নিজস্ব ‘পয়েন্ট অব কন্ট্রাক্ট’ অথবা নোডাল পয়েন্ট নির্ধারণ করবেন। সংক্ষেপে বলা যায়, আমেরিকা ভারতের ‘বেস ও স্থাপনার’ সাহায্যে অনায়াসে যে কোনো স্থানে অপারেশন পরিচালনা করতে পারবে, তেমনি ভারত আমেরিকার বেস ও স্থাপনার পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে।
এরই মধ্যে মিডিয়ায় এসেছে, আমেরিকা তার নৌক্ষমতার ৬০ ভাগ ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় নিয়োজন ঘটাবে। গণমাধ্যমে বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বলা হয়েছে- ইরাক ও আফগানিস্তানে আমেরিকাকে যেভাবে শূন্য থেকে সব সুযোগ-সুবিধা স্থাপন করতে হয়েছিল, ভারত মহাসাগর এলাকায় তেমনটি করতে হবে না।
চুক্তি সম্পাদনের পরপরই ফোর্বস ম্যাগাজিন চীন-পাকিস্তানকে সতর্ক করে লিখেছে, সাবধান! ভারত-আমেরিকা ‘মেজর ওয়্যার প্যাক্ট’ সম্পাদন করেছে। আসলে কি চীন-পাক সম্পর্ক এতে বাধাগ্রস্ত বা দুর্বল হবে, অথবা চীন-পাক সম্পর্ক হোঁচট খাবে? দেখা যাক, চীন-পাকিস্তান মধুর সম্পর্কের কারণগুলো কী!
আসলে ভারত-আমেরিকা LEMOA প্যাক্ট নিয়ে চীন সামান্য হলেও চিন্তিত। চীন ভারতের দুর্বল ক্ষতগুলো এতদিনে চিনে ফেলেছে। চীন কারও অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক না গলিয়ে নিজ দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে গভীর মনোনিবেশ করেছে। চীন তার ব্যবসা-বাণিজ্য নিজ দেশের গণ্ডি থেকে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছে। চীনের কলকারখানা, রাস্তাঘাট পোর্ট-বন্দর, জাহাজ, রেল, বিমান সব ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। চীনকে এখন ‘বিশ্বের ফ্যাক্টরি’ বলা হয়। এমন দ্রব্য নেই, যা চীন তৈরি করে না। অন্যান্য দেশের তুলনায় পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের রয়েছে একটি Emotional সম্পর্ক, যা চীনের ভাষায় ইস্পাতের চেয়েও দৃঢ়। চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক বুঝতে হলে দেখতে হবে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুটি দেশ কী করছে-
১. পাকিস্তান ও চীনের জিয়ান শিং প্রদেশের সঙ্গে ৩৭২ মাইলের সীমান্ত এলাকায় চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ মিলিয়ন চীনা-মুসলিম অবস্থান করছে। সেখানে মুসলিম ‘উইঘুর’ সম্প্রদায় ও ‘হুন’ সম্প্রদায়ের মধ্যে কলহ লেগেই আছে। তবে পাকিস্তান মুসলিম ‘উইঘুর’ সম্প্রদায়ের পক্ষ না নিয়ে চীনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এর বিপরীতে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানে মুসলিম দমনে পাকিস্তানের পাশে রয়েছে চীন। সময়ের পরীক্ষায় এসব পরীক্ষিত।
২. গত বছর এপ্রিলে চীনের প্রেসিডেন্টের পাকিস্তান সফরের সময় ৪৬ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ও পেট্রোলিয়াম সরবরাহ চুক্তি পাকিস্তানের অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার করেছে।
৩. পাকিস্তান এবং কিউবা তিয়ানমিয়ান স্কোয়ারে চীনের দমননীতিকে অভ্যন্তরীণ বিষয় অভিহিত করে চীনের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
৪. পাকিস্তান চীনের কঠিন সময়ে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চীন ভ্রমণ নিশ্চিত করেছিল। আমেরিকা ও পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রগুলো নিরাপদ স্থানে সরিয়ে তা নিষ্ক্রিয় করতে চীনকে ব্যবহার করেছিল আমেরিকা।
৫. চীন-পাকিস্তান বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এখন বছরে অন্তত ১৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের দ্রব্যসামগ্রী আমদানি-রফতানি হয়।
৬. পাকিস্তান-চীন যৌথভাবে JF-17 Fighter Jet তৈরি করছে, যা পাকিস্তানের বিমান প্রতিরক্ষা ও বিমান হামলার মুখ্য হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
৭. পাকিস্তান ওয়ার্দার বন্দর চীনের জন্য উন্মুক্ত করেছে। এতে চীনের তেল-গ্যাস আমদানি- যা মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাভিত্তিক, তার সুরাহা হয়েছে। Strait of Hormuz দিয়ে বিশ্বের ২০ ভাগ তেল রফতানি হয়। ওয়ার্দার পোর্ট থেকে তা নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করে দিতে পারে চীন-পাকিস্তান। এতে হোঁচট কি খাবে ভারত-আমেরিকা?
৮. চীন বর্তমানে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সামরিক সরঞ্জামের বিক্রেতা, যা আগে ছিল আমেরিকা। চীন-পাকিস্তান সামরিক সহযোগিতার মধ্যে আছে যৌথ নির্মাণ, যৌথ প্রশিক্ষণ, একে অন্যের পোর্ট ভিজিট ও সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিদের আদান-প্রদান।
৯. চীন, কাশ্মীর সম্পর্কে পাকিস্তানের অবস্থান সমর্থন করে। তেমনি পাকিস্তান শিং জিয়ান, তিব্বত ও তাইওয়ান ইস্যুতে চীনকে সমর্থন করে। চীন আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। আমেরিকা ন্যাটো দেশগুলোকে যেভাবে সমর্থন করে, তেমনি চীন পাকিস্তানকে সমর্থন করে তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। অধিকন্তু চীন ও পাকিস্তান ভারতকে সন্দেহের চোখে দেখে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিখ্যাত উক্তি, ‘My enemeys enemy is my best fried’ চীন দারুণভাবে ধারণ করে আছে। চীন সর্বতোভাবে পাকিস্তানকে পারমাণবিক অস্ত্র ও পারমাণবিক ক্ষমতার মিসাইল তৈরিতে সাহায্য করছে।
আমরা এবার চোখ ফেরাব ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের দিকে। ভারত-রাশিয়া বন্ধুত্ব গভীরভাবে প্রোথিত এবং তা ঐতিহাসিক। এ প্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, LEMOA pact স্বাক্ষর কি পাকিস্তান-চীন ছাড়াও রাশিয়াকে ব্যথিত করেছে? পণ্ডিতরা বলেন, রাশিয়ার অবস্থান ভারতের মানুষের হৃদয়ে এবং তা সর্বত্র। এ প্যাক্টের কারণে তা দুর্ভাবনার কারণ হওয়ার কথা নয়। মোদি সরকার অস্ত্র ক্রয়ে রাশিয়া ছাড়াও আমেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশকে সুযোগ দিয়ে আসছে, যাতে অস্ত্র ক্রয়ে প্রতিযোগিতা বাড়ে এবং ভালো অস্ত্রটি ভারতের হাতে আসে। যদিও রাশিয়াই ভারতের অস্ত্র ভাণ্ডারের ভিত গড়ে দিয়েছিল।
ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার রয়েছে দ্বিপাক্ষিক অনেক চুক্তি। ভারত রাশিয়া ছাড়াও ইসরাইল এবং আমেরিকা থেকে টঅঠ এবং জেট ইঞ্জিন তৈরিতে সাহায্য-সহযোগিতা চাচ্ছে। ভারত এখনও রাশিয়া থেকে মিডিয়াম ট্রান্সপোর্ট হেলিকপ্টার ক্রয় করে যাচ্ছে। ভারত ৪২টি Su-30MKI ফাইটার বিমান ক্রয়ের আদেশ নিয়েছে। রাশিয়ান এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কিনতেও ভারত আগ্রহী। ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে একটি বিশেষ মিল হল, ভারত ক্রমাগত অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করছে এবং তার একটি সহায়ক ও উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর শ্রমশক্তি রয়েছে। রাশিয়ার রয়েছে উন্নত পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভার আর বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ। দুটি দেশেরই বিরাট ধরনের উন্নতির অবকাশ রয়েছে, যাতে একে অন্যের পরিপূরক হতে পারে।
এ বিশ্বাস দুটি দেশের মধ্যে বিরাজমান বলে বিশ্বাস করি। ভারত মিগ-২৯ ফাইটার বিমান, তলওয়ার ক্লাশ ফ্রিগেড এবং টি-৯০ মেইন ব্যাটল ট্যাংক ক্রয়ে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ভারতের দুটি ভালো পারমাণবিক ক্ষমতার সাবমেরিন রাশিয়া থেকে নেয়া। তৃতীয় পারমাণবিক সাবমেরিনটিও রাশিয়া থেকে আসছে। রাশিয়ার তৈরি INA-Vikramaditya এয়ারক্রাফট কেরিয়ার এখন ভারতীয় নৌবাহিনীর গর্ব। এমনকি একমাত্র ভারতই ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার অভিযান সমর্থন করে আসছে।
চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিশ্ব ফ্যাক্টরি উপাধি পাওয়া, চীনের রিজার্ভ, আফ্রিকাসহ অন্যত্র চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ, চীনের জনগণের উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ ইত্যাদি চীনকে বিশ্বে একটি বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। চীন এ পর্যন্ত কোনো দেশেরই অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেনি, বরং সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে। চীন অবশ্য চীনসাগরে টহলসহ অন্য ছোট দ্বীপগুলোয় নিজস্ব সৈন্যের অবস্থান নিশ্চিত করে তাতে সামরিক স্থাপনা নির্মাণ করছে। এতে ফিলিপিনস আন্তর্জাতিক জলসীমাবিষয়ক আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে এবং বেশকিছু দ্বীপ তাদের বলে রায় পেয়েছে, যা চীন অগ্রাহ্য করছে।
আমেরিকা এসব দ্বীপে চীনের সার্বভৌমত্ব মেনে নিচ্ছে না। তাই আমেরিকা এ অঞ্চলে তার প্রভাব বিস্তারে বন্ধু খুঁজছিল। অন্যদিকে ভারতের রয়েছে চীনের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে ভারত পর্যুদস্ত হয়েছিল। এখন ভারত চায় এমন বন্ধু যার চীনকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা আছে। অন্যদিকে চীন-রাশিয়া সম্পর্ক আগের তুলনায় ভালো। আমেরিকা তার স্বার্থ বজায় রাখতে ও গভীর সমুদ্রে তার আধিপত্য বজায় রাখতে ভারতের সাহায্য চাইছে। ভারত সঙ্গত কারণেই আমেরিকাকে সাহায্য-সমর্থন দেবে। তবে এ নিয়ে সংঘর্ষের চেয়ে ক্ষমতাবলয় বৃদ্ধিতে চীন-আমেরিকা প্রতিযোগিতায় নামবে, এটাই স্বাভাবিক।
ইদানীংকালে সন্ত্রাস দমনে আমেরিকা পৃথিবীর সর্বত্রই জড়িয়ে পড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম দেশগুলো আমেরিকার খেলার পুতুলে পরিণত হয়েছে। ইরাক, লিবিয়া হয়ে এখন সিরিয়া ধ্বংসের শেষপ্রান্তে। উন্নত ধনী দেশ এখন মিসকিন। ইয়েমেনসহ সারা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি নেই। শান্তিতে নেই আফ্রিকা, বিশেষত মধ্য এবং উত্তর আফ্রিকা। তবে এর ফলে সামান্য হলেও আমেরিকার লোকক্ষয় হচ্ছে।
ভারতও কাশ্মীর ও পাকিস্তান নিয়ে ব্যস্ত। সমরাস্ত্র ও সেনাবাহিনীর খরচ মেটাতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার ওপর ভারতের পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলোয় এখনও উন্নয়নের ছোঁয়া তেমন লাগেনি। রাশিয়াও ব্যস্ত সিরিয়া ও ইউক্রেন নিয়ে। ফলে রাশিয়ারও শক্তি ও লোকক্ষয় হচ্ছে। শুধু চীন কোনো ঝামেলায় না গিয়ে তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ব্রতী হয়েছে। চীন-ভারত যুদ্ধের পর ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসে চীন কিছুটা বিব্রত ছিল। এখন চীনের কোনো সংঘর্ষের তেমন একটা দরকার পড়ে না। চীন এখন অর্থনৈতিক শক্তি। তার দরকার সারা পৃথিবীতে বাণিজ্যের সহজ জলপথ।
চীনসাগর ছাড়াও চীন আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে ভারত মহাসাগরে। এটা কি আমেরিকা ও ভারত সহজভাবে নেবে? সুতরাং টার্গেট এখন চীন। এটা আমেরিকার স্থির লক্ষ্য। এতে বন্ধু হিসেবে পাওয়া গেল ভারতকে। তবে এতে অর্থনৈতিক উন্নতি ও প্রগতি কতটা বাধাগ্রস্ত হয়, তা হচ্ছে দেখার বিষয়। আমেরিকা সচরাচর অন্য দেশে, অন্যভূমিতে যুদ্ধ করতে ভালোবাসে। এখানেও তার সে চিন্তার ব্যত্যয় ঘটেনি। -যুগান্তর
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম (অব.) : তুরস্কে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক সামরিক অ্যাটাশে।
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি