পাভেল হায়দার চৌধুরী : ঈদুল আজহায় রাজধানী ঢাকা ছিল যেন মাংসের হাটঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানী ঢাকায় যেন বসেছে কোরবানির মাংসের হাট। পাড়া-মহল্লা, বাজার, ফুটপাত জুড়ে যে যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই বসে গেছেন মাংস নিয়ে। তবে পেশাদার কোনও মাংস ব্যবসায়ী এ হাট বসাননি। মৌসুমি কসাই, দিনমজুর, দুস্থ্, ভিখারি-গরিব, শিশু যারাই কিছু মাংস জোগাড় করতে পেরেছেন, তা নিয়েই বসে গেছেন বিক্রি করতে। যারা আজকের দিনে শ্রম বিক্রি করেছেন, কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে মাংস পেয়েছেন, তারাই রাজধানীতে এ মাংসের হাট বসিয়েছেন। মাংস বিক্রেতা হিসেবে কিছু শিশুকেও দেখা গেছে।
এসব হাটে মাংসের ক্রেতা হিসেবে ছিলেন শহরে বসবাসীকারী নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা। রিকশাওয়ালা, টং-দোকানি, খেটে খাওয়া দিনমজুর মানুষ ও যারা কম বেতনে শহরে চাকরি-বাকরি করেন তারাই ছিলেন মূল ক্রেতা। এই হাটে মাংস ক্রেতা হিসেবে আরও ছিলেন রাজধানীর বিভিন্ন মেসে ব্যাচেলর হিসেবে যারা থাকেন, তারাও। এছাড়া খাবার হোটেল ব্যবসায়ীদেরও এই হাট থেকে মাংস কিনতে দেখা গেছে।
মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এই দৃশ্য দেখা গেছে। মূলত বিকেল তিনটা থেকে এই হাটগুলো জমতে শুরু করে। বেচাকেনা চলে সন্ধ্যা-রাত পর্যন্ত।
হাটগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে, এই হাটের ক্রেতারা মাংস কিনে কেউ ঠকছেন, কেউ আবার জিতছেন। কোরবানির ঈদে পরিবার-পরিজন নিয়ে মাংস খাবেন, এ ইচ্ছাতেই এসব হাট থেকে মাংস কেনা।
রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানের পাশে বসে বিরাট মাংসের হাট। এ হাটে বিক্রেতা যেমন বেশি, ক্রেতাও তেমনি অসংখ্য দেখা গেছে। ১০/১৫ হাজার টাকার কোরবানির মাংস কিনেছেন এমন লোকও পাওয়া গেছে এই হাটে।
যারা মৌসুমি কসাই, হতদরিদ্র ভিখারি গোছের মানুষ যারা মাংস বিক্রি করছিলেন তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা জানান, বিভিন্ন বাড়িতে কোরবানির পশু জবাই করেছেন। আসার সময় তারা যে মাংস পেয়েছেন, তা দিয়েই এখানে এনে বিক্রি করেছেন। এসব কসাইরা বলেন, ‘এসব মাংস বাড়ি নেওয়া যাবে না। আমরা ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকে কোরবানি ঈদ উপলক্ষে ঢাকায় এসেছি কাজের উদ্দেশ্যে। ঈদ শেষে আবার যার যার এলাকাতে চলে যাবো। কিন্তু মাংসগুলো বাড়ি পর্যন্ত নিতে গেলে নষ্ট হয়ে যাবে। সে কারণে এখানে মাংস বিক্রি করে টাকা নিয়ে বাড়ি যাবো। এতে কিছু বাড়তি আয়ও হবে।’
আজিমপুর থেকে মাংস কিনছে মনিরধানমণ্ডি থেকে আসা মনির নামে অল্প বয়সী এক ছেলে ৬ হাজার টাকার মাংস কিনে নিয়ে যায় আজিমপুর এলাকা থেকে। কী উপলক্ষে এত টাকার মাংস কেনা হয়েছে জানতে চাইলে সে বলে, ‘কোনও উপলক্ষ নেই। পরিবারের সবাইকে নিয়ে খাবো, তাই মাংস কিনেছি।’ এখানে কি সস্তায় পাওয়া গেল জানতে চাইলে সে বললো, ‘একটু সস্তায় পেয়েছি।’
নারায়ণগঞ্জ থেকে মাংস কিনতে এসেছেন আব্দুল লতিফ নামে এক তরুণ। আজিমপুর থেকে তিনিও প্রায় ১০ হাজার টাকার মাংস কিনে ব্যাগ বোঝাই করেন পুটলি আকারে করা বেশ কয়েকটি পুটলি। উপলক্ষ জানতে চাইলে তিনিও বলেন, ‘রসনা বিলাস ছাড়া আর কিছুই না।’ সস্তায় কিনেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা তো জানি না! কোরবানির ঈদ, কোরবানি করার সামর্থ্য নেই। কিন্তু পরিবার-পরিজন নিয়ে মাংস খাওয়ার শখ তো আছেই! তাই, কিনে নিয়ে যাওয়া।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন তো বাজার থেকে মাংস কেনা যাবে না। সব কসাইয়ের দোকান বন্ধ। তাই, সস্তায় হোক আর বেশি দামেই হোক, প্রয়োজন তাই কিনেছি!’
শাহেনা আজিমপুরের মাংসের হাট থেকে মাংস কিনছেনবাংলামোটর থেকে শাহেনা নামে এক নারী প্লাস্টিকের ব্যাগে পুটুলি করা তিন পুটলি মাংস কিনেছেন এক হাজার সাতশ টাকা দিয়ে। তার বিশ্বাস, মাংস ভালোই হবে। তিনি বলেন, ‘কোরবানি করতে পারিনি। গ্রামের বাড়িতেও যেতে পারিনি; কিন্তু কোরবানির মাংস তো খেতে হবে, তাই এখানে এসেছি।’ শাহেনা বলেন, এখন তো বাজারে মাংস বিক্রি বন্ধ। সে কারণে এখান থেকেই মাংস কিনলাম।’
নুরুজ্জামান ও রবিনসহ কয়েক বন্ধু থাকেন লালবাগের একটি মেসে। প্রাইভেট একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তারা। বাড়ি উত্তরবঙ্গে। কিন্তু এখন বাড়ি যাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় তারা ঢাকাতেই থেকে যান। তারা দুই বন্ধু মিলে আজিমপুর থেকে এক পুটলি মাংস কেনেন সাতশ টাকা দিয়ে। বাজারের চেয়ে যে কমদামে কিনেছেন, তা মনে হয়নি। জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘মাংস তো খেতে হবে; তাই কিনেছি। কম বা বেশি দাম সেটা চিন্তা করিনি।’
কোরকানির ঈদ উপলক্ষে মৌসুমি কসাই ইউনুস আলীসহ পাঁচজন ঢাকায় এসেছেন কুষ্টিয়া থেকে। আজিমপুরের একটি বাড়িতে তারা মঙ্গলবার কসাইয়ের কাজ করেছেন। কাজ শেষ করে আসার সময় বেশ কিছু মাংস পেয়েছেন তারা। পেয়েছেন একটি গরুর মাথাও।
ইউনুস আলী বলেন, ‘বাড়ি নিতে গেলে মাংসগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। তাই, ভাগ বসিয়ে বিক্রি করে ফেলছি।’ কত টাকায় বিক্রি হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাড়ে চার হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। আরও পাঁচ হাজার টাকার মাংস বিক্রি করতে পারবো, আশা করি।’ সব মাংস এখনও বিক্রি হয়নি। কখন এগুলো বিক্রি হতে পারে জানতে চাইলে ইউনুস বলেন, ‘সন্ধ্যার পর সবই বিক্রি হয়ে যাবে।’ তিনি জানান, এখন দিনের বেলা। তাই, অনেক ভদ্রলোক লজ্জায় মাংস কিনতে বাজারে আসছেন না। সন্ধ্যার পর আসবেন, যাতে কেউ না দেখে।
ঈদুল আজহায় রাজধানীতে বসে মাংসের হাট মৌসুমী কসাই আমিন খান ফুটপাতে কয়েক ভাগ মাংস সাজিয়ে বসে আছেন বিক্রির উদ্দেশ্যে। কিছু বিক্রি করেছেন। বাকিগুলো সন্ধ্যায় বিক্রি করবেন বলে বসে আছেন। সন্ধ্যায় কেন জানতে চাইলে আমিন খান বলেন, ‘তখন ভালো দাম পাওয়া যাবে। সে সময় ভদ্রলোকরা আসবেন। কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নেই, কিন্তু মাংস খাবেন, এমন লোক কিছু আসবেন। তাদের কাছে মোটামুটি ভালো দামে মাংস বিক্রি করা যাবে। তখন আরও কিছু লাভ হবে।’
রেশমা নামে এক মধ্য বয়সী নারী আজিমপুরে এসেছেন মাংস কিনতে। সুবিধা মতো দাম ও মাংস না পাওয়ায় প্রায় ঘণ্টাখানেক ঘুরেছেন মাংসের হাটে। তারপর আব্বাস কসাইয়ের পসরা থেকে দুই ভাগ মাংস কিনেছেন ছয়শ টাকা দিয়ে। উপলক্ষ জানতে চাইলে তিনি অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। -বাংলা ট্রিবিউন
১৩ সেপ্টেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম