নুরুজ্জামান লাবু : রাজধানীর কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে আহতাবস্থায় গ্রেফতার হওয়া জঙ্গি রাকিবুল হাসান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে সে বলেছে, জিহাদের জন্য সে সিরিয়া যেতে ইচ্ছুক হয়।
কিন্তু কয়েক মাস আগে ‘বড় ভাই’ তাকে বলে, ‘সিরিয়া যেতে দেরি হচ্ছে, দেশেই বড় কিছু একটা করে দেখাতে হবে।’ রবিবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের হাকিম সাদবির ইয়াসির আহসান চৌধুরী তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাকিবুল হাসানের একাধিক সাংগঠনিক নাম রয়েছে, রাকিবুল ছাড়াও সংগঠনের ভেতরে সে রিগান ওরফে রাফিউল ওরফে রিপন ওরফে হাসান নামে পরিচিত।
জবানবন্দিতে রাকিবুল হাসান বলেছে, এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে অনলাইনে তার যোগাযোগ হয়। তার মাধ্যমেই সে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। জিহাদের জন্য সে সিরিয়া যেতে ইচ্ছুক হয়। তবে কয়েক মাস আগে ওই বড় ভাই তাকে বলে, ‘সিরিয়া যেতে দেরি হচ্ছে, দেশেই বড় কিছু একটা করে দেখাতে হবে।’ এজন্যই সে অন্যদের সঙ্গে কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় অবস্থান করছিল। আদালত ও তদন্তসংশ্লিষ্ট কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে আহতাবস্থায় গ্রেফতার করা হয় রাকিবুল হাসান রিগানকে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ৪ সেপ্টেম্বর তাকে প্রথম দফায় সাত দিনের রিমান্ডে নেয় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। দ্বিতীয় দফায় আরও সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হলে, রিমান্ড শেষ হওয়ার আগেই সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হওয়ায় তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম বলেন, ‘রাকিবুল হাসান রিমান্ডে থাকার সময় জিজ্ঞাসাবাদে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করে।পরে তাকে আদালতে নেওয়া হলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দিতে সে অনেক তথ্য বলেছে।সেগুলো আমলে নিয়ে অনুসন্ধান চলছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে রাকিবুল হাসান জানিয়েছে, সে রিগান ছাড়াও রাফিউল ইসলাম রাফি ওরফে রিগান ওরফে রিপন ওরফে ওরফে হাসান তার সাংগঠনিক নাম। তার বাবার নাম মৃত রেজাউল হক। মায়ের নাম রোকেয়া আক্তার। গ্রামের বাড়ি বগুড়া সদরের জামিলনগর তালতলায়। ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে তার বাবা মারা যান। বাবা বগুড়া সদরের ইসলামপুরে মাছের চাষ করতো।
রাকিবুল হাসান বলেছে, ২০১১ সালের শেষের দিকে জামিলনগরের বাসায় স্থানীয় শিবিরকর্মী রাজু, তানজিল, রেজ্জাকদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। তারা এক সঙ্গে নামাজ পড়তো। কিছুটা রাজনৈতিক কাজেও যুক্ত ছিল সে। রাকিবুল জামিলনগর এলাকার করতোয়া মাল্টিমিডিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজে নার্সারি থেকে এসএসসি পর্যন্ত পড়েছে। ২০১৩ সালে সে এ প্লাস গ্রেড নিয়ে এসএসসি পাশ করে। পরে বগুড়ার বনানী এলাকার শাহ সুলতান কলেজে এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। ২০১৫ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর বগুড়া রেটিনা মেডিক্যাল কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়।
আদালতে রাকিবুল বলেছে, এইচএসসি পরীক্ষার ৩-৪ মাস আগে ফেসবুকে সাব্বির নামে একজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সাব্বির তার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ইসলামিক বিষয়ে চ্যাট করতো। একই সঙ্গে নানারকম জিহাদি লেকচারের লিংক দিতো। সে এসব নিয়মিত পড়তো।
রাকিবুল জানিয়েছে, সাব্বিরের সাথে মেসেজ আদান-প্রদানের মাধ্যমে নিয়মিত কথা হতো। তার কথা মতো গত বছরের ২৩ জুলাই বাসা থেকে মা ও বোনকে না জানিয়ে কোচিং-এ যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এরপর সে শিবগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে সাব্বিরের সঙ্গে দেখা করে। তার সঙ্গে মাসুদ ও সিহাব নামে আরও দুই বন্ধু ছিল। সাব্বিরের কাছ থেকে দাওয়াত পাওয়ার পর সে তার দুই বন্ধুকে দাওয়াত দেয়। সাব্বির তাকে বলেছিল, ‘আমরা সিরিয়ায় যাবো। সেখানে আমেরিকা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মুসলিমদেরকে রক্ষা করবো।’
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে রাকিবুল জানিয়েছে, শিবগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড থেকে সাব্বির তাদের তিনজনকে বাসে করে ঢাকায় নিয়ে যায়। ঢাকায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তাদের আগে থেকেই বলে দেওয়া হয়েছিল ঢাকার কোনও এলাকার জায়গার নাম দেখা যাবে না। এই নির্দেশনা অনুযায়ী তারা কিছু দেখেনি। পরে তিন বার রিকশা পরিবর্তন করে একটি বাড়ির সামনে নিয়ে যায়। ওই বাড়ির পঞ্চম তলার তিন রুমের একটি ফ্ল্যাটে তারা তিনজন থাকতে শুরু করে। ওই ফ্ল্যাটের অন্য দুই রুমে আরও লোকজন ছিল।
রাকিবুল জানায়, রবিন নামে এক বড় ভাই তাদের খাবার ও দেখাশোনা করতো। ১৫-২০ দিন সেখানে থাকার পর রিকশা করে অন্য আরেক জায়গায় দ্বিতীয় বাসায় নিয়ে যায়। ওই বাসায় দুই মাস থাকার পর তার দুই বন্ধু শিহাব ও মাসুদ ব্যতীত অন্য সকলে অর্থাৎ রবিন, সাব্বির, ইমরান, সোহান, ইকবাল তাদের ভাড়া করা তৃতীয় বাসায় আসে। তৃতীয় বাসায় ৪/৫ মাস থাকার পর তারা চতুর্থ ভাড়া বাসায় যায়। সেখানে অভি, তাপস, আবির ও নাঈম নামে আরও চার জন ছিল। সেখানে তারা এক সঙ্গে ৪-৫ মাস অবস্থান করে। রাকিবুল জানায়, শেষের দিকে তাদের সাথে যোগ দেয় আতিক নামে এক তরুণ।
রাকিবুল জানায়, চলতি বছরের ১২ জুলাই তারা সবাই পর্যায়ক্রমে কল্যাণপুরের ৫৩ নম্বর তাজ মঞ্জিল (জাহাজ বাড়ি নামেও পরিচিত)নামে ষষ্ঠ তলা বাড়ির ৫ম তলা ফ্ল্যাটে যায়। এদিন সাব্বির, আতিক, ইকবাল, সোহান, ইমরান এবং ১৬ জুলাই সে সহ রবিন, অভি, তাপস, আবির ও নাঈমসহ কল্যাণপুরের বাসায় ওঠে। সেখানে তারা মোট এগারজন ছিল।
রাকিবুল জানায়, বিভিন্ন বাসায় অবস্থানকালে রবিন তাদের ঈমান, তাওহীদ, জিহাদ, নামাজ এবং আখলাক বিষয়ে ক্লাসসহ অস্ত্র চালনা, অস্ত্র কিভাবে ধরতে হয়, কিভাবে গুলি করতে হয়, কিভাবে ম্যাগাজিন খোলা এবং লাগাতে হয়, কিভাবে গুলি ম্যাগাজিনে ঢোকানো হয় তা শেখাতো। অস্ত্রের ক্লাসে রবিন একে ২২ রাইফেল দেখাতো। কিভাবে টারগেট ঠিক করতে হয়, নিশানা করা ও ধরার নিয়ম শিক্ষা দিতো।
রাকিবুল জানায়, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ বাসায় অপরিচিত ২/৩ জন নিয়মিত যাতায়াত করতো। তারা এলে রবিন তাদের আলাদা রুমের ভেতরে অবস্থান করতে বলতো। তবে মাঝে মধ্যে রবিন তাকে চা বানানোর জন্য বলতো। তখন সে আন্দাজ করতো কতোজন এসেছে। রবিন তাদের বলতো এরা ‘বড় ভাই’।
রবিন তাদের বলতো যে, আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নির্যাতিত মুসলিমদের রক্ষা করতে হবে। সিরিয়ায় যুদ্ধ শেষ করতে পারলে প্রয়োজন হলে ফিলিস্তিন বা অন্য জায়গায় যোগদান করতে হবে। যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেলে আল্লাহ যদি কবুল করেন, তাহলে তারা সবাই শহীদ হবে।
পরে রবিন তাদের একদিন বলে, ‘সিরিয়া যেতে দেরি হচ্ছে। এজন্য দেশেই বড় কিছু একটা করে দেখাতে হবে। যদি সফল হই তবে সকলে সিরিয়া চলে যাব।’ এটাই তাদের বড় ভাইদের নির্দেশ।
রাকিবুল জানায়, সেই বড় ভাইদের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা সবাই বড় ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কল্যাণপুর এলাকায় প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গত ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের ওই বাসায় তারা ১১ জন অবস্থান করছিল। রাকিবুলের ভাষ্য অনুযায়ী, রাত ১১টায় সে ঘুমিয়ে যায়। হঠাৎ তাকে কেউ একজন ডেকে বলে পুলিশ আসছে।
রবিন তাদের বলে, বারান্দার গ্রিলের পকেট গেট খোলা আছে, যারা পারবেন বের হয়ে চলে যান। তখন সে ও ইকবাল পকেট গেট দিয়ে বের হয়ে জানালার সানসেট দিয়ে নিচে নামতে থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় তলায় গিয়ে সে পা ফসকে ও পিছলে পড়ে যায়। এতে তার মাথা ফেটে যায় এবং রক্ত পড়তে থাকে। তারপর সেখান থেকে বের হয়ে আসার সময় এক জায়গায় চিপাগলিতে রাস্তার কাছে দাঁড়ায়। সে সময় পুলিশের গুলি তার বাম পায়ে বিদ্ধ হয়।
রাকিবুল বলে, ইকবাল তার সাথেই ছিল। তার হাতে থাকা একে-২২ রাইফেল দিয়ে গুলি করতে করতে পালিয়ে যায়। বাসায় অস্ত্র-গুলি, চাকু, দা, কালো পাঞ্জাবি, হাজী রুমাল ও গ্রেনেড ছিল। রাকিবুল বলে,‘ওই বাসা থেকে নেমে আসার পর আর কিছুই জানি না। পুলিশ আমাকে ধরে ফেলে এবং রাতেই হাসপাতালে ভর্তি করে। আমি নিজে অন্যদের সঙ্গে অবৈধভাবে ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলাম।’ বাংলা ট্রিবিউন
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি