বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০৭:১৭:৫৮

বজ্রপাতে কেন এত প্রাণহানি?

বজ্রপাতে কেন এত প্রাণহানি?

মুসতাক আহমদ ও মাহমুদুল হাসান নয়ন : বুধবার বেলা পৌনে ১২টা। চট্টগ্রামের মিরেরসরাই উপজেলার কইয়াছড়া ঝরনার তিন নম্বর ইউনিট। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আড়াইশ’ ফুট ওপরে এই ঝরনা দেখতে গিয়েছিলেন আবুল কালাম আজাদ নিরনসহ ৫ বন্ধু।

হঠাৎ বজ্রপাতে নিরনসহ তার বন্ধুরা পাহাড় থেকে নিচে পড়ে গেলেন। এতে প্রত্যেকেই গুরুতর আহত হন। নিরনের পা ভেঙে গেছে। তাকে ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর আগের দিন মঙ্গলবার দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও হাওরাঞ্চলের ৬ জেলায় ১৬ জন নিহত এবং ১৯ জন আহত হয়েছেন।

শুধু এই দু’দিনের ঘটনাই নয়, চলতি বছর বজ্রপাত এবং এতে মৃত্যুর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েছে। এর আগে ১২ মে বজ্রপাতে একদিনেই ৩৫ জন মারা যান। পরের দিন মারা যান আরও ২২ জন। ১৭ আগস্ট পঞ্চগড়ে মারা গেছেন ২ জন। এভাবে দিন দিন বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উদ্বেগ-আতংক দেখা দিয়েছে। এ কারণে অনেকেই একে ‘বজ দুর্যোগ’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন।

বজ্রপাত বা এ ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে একক কোনো কারণ চিহ্নিত করতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, আবহাওয়া অধিদফতর (বিএমডি) সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগে অনেকটাই ধারণানির্ভর তথ্য পাওয়া গেছে। তারা মনে করছেন, তাপমাত্রা ও বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি, জনজীবনে ধাতব পদার্থের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া, মোবাইল ফোন ব্যবহার ও এর টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনভূমি বা গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছের সংখ্যা আশংকাজনক হারে হ্রাস, জলাভূমি ভরাট ও নদী শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

বিশেষজ্ঞরা জানান, এসব কারণের প্রায় সবগুলোর সঙ্গে উষ্ণায়নের সম্পর্ক আছে। সাধারণত এক ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বজ্রপাতের আশংকা ১০ শতাংশ বেড়ে যায়। এ ব্যাপারে সচেতন হলে বজ্রপাতে মৃত্যু কমানো সম্ভব।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ চৌধুরী বলেন, বজ্রপাত নিয়ে আমাদের দেশে তেমন গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত নেই। এ কারণে বজ্রপাত বেড়েছে বা বাড়েনি- কোনোটিই বলা যাবে না। বিএমডির আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, বজ্রপাতের কারণ বায়ুদূষণ। বাতাসে সিসার পরিমাণ বেড়ে গেছে। সাধারণত ধাতব পদার্থ থাকলে তাতে বজ আকর্ষণ করে। কেননা মেঘে ইলেকট্রন-প্রোটন থাকে। তা সিসার কারণে আকর্ষিত হয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক খালেদ মাহমুদও একই কথা উল্লেখ করে বলেন, ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু চলতি বছর এই সংখ্যা বেড়ে গেছে। এ কারণে এর আগে ‘বজ্রপাত’ দুর্যোগ আইন ও বিধিমালায় কোনোভাবে উল্লেখ থাকলেও এবারের সংশোধনীতে তা আমরা বিশদভাবে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছি। বুধবার এ সংক্রান্ত একটি কর্মশালা হয়েছে। সেখানে এই বিধিমালা ও নীতিমালা ছেপে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি বলেন, বজ্রপাতে মৃত্যু হলে ২০ হাজার এবং আহত হলে তাৎক্ষণিকভাবে ১০ হাজার টাকা দেয়া হবে। এর চেয়ে বড় ক্ষতির কারণে অন্যান্য পুনর্বাসনমূলক পদক্ষেপ নেয়া হবে।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে সাধারণত বর্ষা আসার আগে এপ্রিল-মে মাসে তাপমাত্রা বেশি হারে বাড়ে। এতে এই সময়ে বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে ভেসে আসা আর্দ্র বায়ু আর উত্তরে হিমালয় থেকে আসা শুষ্ক বায়ুর মিলনে বজ্রঝড় সৃষ্টি হয়। তবে এবার আগস্ট-সেপ্টেম্বরেও বজ্রপাত এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, এক সময় দেশের বেশিরভাগ গ্রাম এলাকায় বড় বড় গাছ ছিল। তাল, নারিকেল, বটসহ নানা ধরনের বড় গাছ বজ্রপাতের আঘাত নিজের শরীরে নিয়ে নিত। ফলে মানুষের আঘাত পাওয়ার আশংকা কমত। তিনি বলেন, বজ্রপাত সাধারণত মাটির দিকে চলে আসে। মাটি তা আকর্ষণ করে। তাই ভূমিতে যেখানে ধাতব পদার্থ বেশি থাকবে, সেখানেই তা আকর্ষিত হবে। বজ্রপাতবিষয়ক গবেষকরা বলছেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে এখন মোবাইল ফোন আছে। অধিকাংশ এলাকায় মুঠোফোন ও বৈদ্যুতিক টাওয়ার আছে। দেশের কৃষিতেও যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। তাছাড়া সন্ধ্যার পর মানুষের ঘরের বাইরে অবস্থান বাড়ছে। আর বেশির ভাগ বজ্রপাতই হয় সন্ধ্যার দিকে।

মঙ্গলবার সারা দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর রেকর্ডে দেখা যায়, টাঙ্গাইলে নিহত হয়েছেন ৩ জন। এরা ঘরের বাইরে ছিলেন এবং কোথাও যাচ্ছিলেন। সুনামগঞ্জে নিহত ৬ জন হাওরে মাছ ধরছিলেন। দিনাজপুর নিহত ১ জন ও আহত ৬ জন জমিতে নিড়ানির কাজ করছিলেন। কিশোরগঞ্জে নিহত ২ জন টিনশেডের ঘরে ছিলেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিহত ২ জন পদ্মা নদীতে মাছ ধরছিলেন। আর বুধবার আহত ৫ জন পাহাড়ে ছিলেন।

দুর্যোগ অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক বলেন, আমরা দেখেছি, বজ্রপাতে মৃত্যুর ৯৯ শতাংশই ঘটেছে বাইরের খোলা আকাশের নিচে থাকার কারণে। তাই একটু সচেতনতাই পারে এই মৃত্যু ঠেকাতে। তিনি পরামর্শ দেন, যখনই আকাশ একটু মেঘলা দেখা যাবে, তখন যথাসম্ভব খোলা আকাশের নিচে থেকে চলে আসতে হবে। বড় গাছ, টিনের ঘর, বৈদ্যুতিক খুঁটি ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। পারলে ইটের বা মাটির ঘরে ও ছাদের নিচে চলে আসতে হবে। মোবাইল ফোন, ফ্রিজ, টিভি ইত্যাদি বন্ধ করে দিতে হবে। এই প্রচারণা চালাতে দুর্যোগ অধিদফতর কাজ করছে বলে জানান তিনি।

হাওর এবং উত্তরাঞ্চলে বজ্রপাত বেশি হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, হাওরাঞ্চলে আর্দ্রতা বেশি। আর উত্তরাঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি। এ কারণে এই দুই অঞ্চলে বজ্রপাত বেশি হতে পারে। বিএমডির তথ্য মতে, মে মাসে নিয়মিতভাবে বজ্রপাতের পরিমাণ বাড়ছে। সংস্থাটির হিসাবে ১৯৮১ সাল থেকে মে মাসে গড়ে নয় দিন বজ্রপাত হতো। ২০১৫ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১২ দিন। ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা গেছেন ১ হাজার ৪৭৬ জন। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে বজ্রপাতে যেসব মৃত্যু হয়েছে এর এক-চতুর্থাংশ হয়েছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওরের নয় জেলায়। চলতি বছর মে মাস পর্যন্ত ৮৮টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৭টিই হয়েছে হাওর অঞ্চলে। যুগান্তর
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে