লুৎফর রহমান : আসন্ন সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচনমুখী নেতৃত্ব তুলে আনার প্রস্তুতি শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। আগামী নির্বাচনে দলকে সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারেন এমন নেতাদের তুলে আনা হবে নতুন কমিটিতে। নির্বাচনকে সামনে রেখে এ কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের নেতাকর্মী এবং দেশবাসীকে একটি বিশেষ বার্তাও পৌঁছে দিতে চায় দেশের সবচেয়ে পুরনো ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি।
কার্যত এই সম্মেলনের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করতে চায় আওয়ামী লীগ। সম্মেলন সফল করতে ইতিমধ্যে দলটির নেতারা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। প্রতিদিনই আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে সম্মেলন প্রস্তুতি উপকমিটিগুলোর বৈঠক হচ্ছে। সম্মেলনে ব্যাপক শোডাউন ও দেশি-বিদেশি অতিথিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করারও চেষ্টা চলছে। সুশৃঙ্খল ও জাঁকজমকপূর্ণ সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ দেশের প্রধান ও নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে চায়।
দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা বলছেন, এই কাউন্সিলের পর গঠিত কমিটিই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে নেতৃত্ব দেবে। তাই নেতৃত্ব বাছাই প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও নির্বাচনকেই গুরুত্ব দেয়া হবে। সৎ, দক্ষ, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের পছন্দের নেতারাই জাতীয় কমিটিতে স্থান পাবেন। এছাড়া এসব দিক বিবেচনায় রেখেই বর্তমান কমিটির নেতাদের পদোন্নতি নির্ভর করবে। নিজেদের আমলনামার কারণে বর্তমান কমিটির কেউ কেউ বাদও পড়তে পারেন। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে বর্তমান কমিটির নেতাদের একটি মূল্যায়নও দলীয় সভানেত্রীর হাতে এসেছে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসতে পারেন এমন সম্ভাব্য নেতাদের বিষয়েও মূল্যায়ন চলছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের মাধ্যমে।
আগামী ২২ ও ২৩শে অক্টোবর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ কাউন্সিলে গঠিত কমিটিতেও চমক এসেছিল। দলটির কয়েকজন প্রবীণ নেতাকে প্রেসিডিয়াম থেকে বাদ দিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে স্থান দেয়া হয়েছিল। এছাড়া সম্পাদকমণ্ডলীতে অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং দক্ষ ও কর্মঠ নেতাদের স্থান দেয়া হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, বর্তমান কমিটির নেতারা যারা যে দায়িত্ব পেয়েছিলেন তাদের অনেকে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নিজ নিজ বিভাগে তারা সফল হয়েছেন। এমনকি তরুণ নেতৃত্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিও সফলভাবে মোকাবিলা করেছে। বিষয়টি মাথায় রেখেই পরবর্তী নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। তবে যে কয়েকজন নিজেদের কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত হয়েছেন বা নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি তাদের আর স্বস্থানে রাখা হবে না নতুন কমিটিতে। এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখেই কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা নির্বাচন হবে। যারা কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেতৃত্ব পাবেন তারা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন করবেন এমনটি মাথায় রেখেই তাদের দায়িত্ব দেয়া হবে।
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় কমিটির কলেবর কিছুটা বাড়ছে। এজন্য গঠনতন্ত্র সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গঠনতন্ত্র সংশোধন উপকমিটি ইতিমধ্যে তাদের সুপারিশ কেন্দ্রীয় কমিটিতে জমা দিয়েছে। এ সুপারিশের ওপর কিছু পরামর্শ ও মতামত দিয়ে এটি আবার উপকমিটির হাতে এসেছে। গঠনতন্ত্রের চূড়ান্ত সংশোধনী কাউন্সিলে কাউন্সিরদের অনুমোদন নিয়ে চূড়ান্ত হবে। উপকমিটি সূত্র জানিয়েছে, সম্পাদকমণ্ডলীর কয়েকটি পদ বাড়ছে নতুন গঠনতন্ত্রে। এর মধ্যে নতুন প্রতিষ্ঠিত বিভাগগুলোর জন্য একজন করে সাংগঠনিক সম্পাদক বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া দু-একটি সম্পাদকীয় পদও বাড়ানো হবে।
সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় কমিটির কলেবর খুব একটা না বাড়লেও তৃণমূলের কমিটির কলেবর বাড়ানোর নির্দেশনা থাকবে গঠনতন্ত্রে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যন্য বিষয় বিবেচনায় নিয়ে জেলা, থানা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটির পদ ও সদস্য সংখ্যা বাড়বে আগের চেয়ে। এছাড়া এখন থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে হওয়ায় এ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী নির্বাচন করার বিষয়টি গঠনতন্ত্রে সংযোজন করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের মতো এসব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে মনোনয়ন বোর্ডের নির্দেশনা থাকবে গঠনতন্ত্রে। সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে থাকবে সরকারের উন্নয়ন চিত্র ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার ঘোষণা।
এক্ষেত্রে ‘ভিশন-২০৪১’ লক্ষ্য ধরে আওয়ামী লীগের উন্নয়ন পরিকল্পনা তুলে ধরা হবে। এ ঘোষণাপত্রকে ভিত্তি ধরেই রচিত হবে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দলীয় নির্বাচনী ইশতেহার। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকবে সম্মেলন ঘোষণাপত্রে। এছাড়া বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াইয়ে আওয়ামী লীগের সুদৃঢ় অবস্থান ঘোষণা করা হবে এতে।
গঠনতন্ত্র সংশোধন উপকমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন বলেন, কমিটি ইতিমধ্যে সংশোধনীর খসড়া তৈরি করে কেন্দ্রীয় কমিটিতে জমা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যালোচনা করে কিছু পরামর্শ দিয়েছে। এর আলোকে চূড়ান্ত সংশোধনী কাউন্সিলে উপস্থাপন করা হবে। সেখানেই গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত হবে। তিনি বলেন, দেশের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের মাধ্যমেই পরবর্তী নেতৃত্ব নির্বাচন করবে।
আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৭৩ জন। এর মধ্যে প্রেসিডিয়ামে পদ রয়েছে ১৫টি। কমিটির পরিধি বাড়ানো হলে এ সংখ্যা ১৯-এ দাঁড়াতে পারে। এ ছাড়া যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বর্তমানে তিনজন রয়েছেন। এই সংখ্যাও বেড়ে এক থেকে দুটি বাড়তে পারে। সাংগঠনিক সম্পাদকের সংখ্যাও বাড়ছে। বর্তমানে সাত বিভাগের জন্য সাতজন দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক রয়েছেন। আরো তিনটি প্রশাসনিক বিভাগ বাড়ায় সাংগঠনিক সম্পাদকও বাড়বে। তবে এই সংখ্যা বাড়বে বিভাগ বাড়ার সংখ্যা অনুযায়ী। কমিটির পরিধি ৮১ এর বেশি হবে না বলে জানিয়েছেন গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটির একজন সদস্য।
সম্মেলন প্রস্তুতির বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পর সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও সংগত কারণে এটি প্রায় চার বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এছাড়া এ সম্মেলনে যে কমিটি হবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে তারা দলের নেতৃত্ব দেবেন। তাই এই সম্মেলন ঘিরে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা অনেকে। কাউন্সিলের মাধ্যমে যারা নেতৃত্বে আসবেন তাদের অনেকে আগামী নির্বাচনে নিজ নিজ এলাকায় দলের হয়ে প্রার্থী হবেন। তাই এসব দিক বিবেচনায় নিয়েই কাউন্সিল প্রস্তুতি চলছে। তিনি বলেন, যেহেতু সামনে নির্বাচন তাই কাউন্সিলে নির্বাচনকেই গুরুত্ব দেয়া হবে। কাউন্সিলে যে ঘোষণা পত্র আসবে তার ওপর নির্ভর করেই পরবর্তী নির্বাচনের ইশতেহার তৈরি করা হবে।
এদিকে নির্বাচন প্রস্তুতি নিতে দলের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় নেতা ও সংসদ সদস্যদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে আগে থেকেই। বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে আগাম নির্বাচনের দাবি থাকলেও আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, নির্ধারিত সময়ে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কে সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, আগাম নির্বাচন দেয়ার পরিস্থিতি দেশে নেই।
যথাসময়ে নির্বাচন হবে। আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ জাতীয় নির্বাচন হবে। জাতীয় কাউন্সিলের পর নির্বাচনের আর দুবছরের মতো সময় থাকবে। নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। গত জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় প্রধানমন্ত্রী দলের এমপিদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিষয় জনগণের সামনে তুলে ধরারও পরামর্শ দেন তিনি।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ২৯শে ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ১৯ তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই কমিটির মেয়াদ গত ২৯শে ডিসেম্বর শেষ হয়। পরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ বাড়ানো হয়।
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি