বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০৩:৩৮:৪৯

কাশ্মীরি জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রসঙ্গে

কাশ্মীরি জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রসঙ্গে

বদরুদ্দীন উমর : দক্ষিণ এশিয়া বা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হওয়া সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত তার জের কীভাবে এই সমগ্র অঞ্চলে ঔপনিবেশিক শাসনের অভিশাপ হিসেবে জনগণের জীবন বিপর্যস্ত করছে, তার অন্যতম প্রধান দৃষ্টান্ত হল কাশ্মীর সমস্যা। ভারতে সর্বশেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাদের সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করে স্বাধীনতা দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতে এসে ওই বছরেরই মে মাসের মধ্যে ঝটিকাবেগে তার দায়িত্ব সুসম্পন্ন করে ৩ জুন ভারতের স্বাধীনতা ও বিভক্তির ঘোষণা দিয়েছিলেন।

অল ইন্ডিয়া রেডিওতে তিনি সেই ঘোষণা দেয়ার পর একে একে জওহরলাল নেহরু, মহম্মদ আলী জিন্নাহ ও সরদার বলদেব সিং তা শিরোধার্য করে বক্তৃতা দেন। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ যেভাবে স্বাধীনতা চেয়েছিল, ব্রিটিশ সরকার সে অনুযায়ী ভারতকে স্বাধীনতা দেয়নি। তারা ভারতকে স্বাধীনতা দিয়েছিল নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, যে পরিকল্পনা লন্ডনে বসে তারা বিস্তারিতভাবে তৈরি করে মাউন্টব্যাটেনকে পাঠিয়েছিল তা কার্যকর করতে। মাউন্টব্যাটেন অতি দক্ষতা ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এমনভাবে সে পরিকল্পনা কার্যকর করেছিলেন যে মনে হয়নি, তিনি একটি পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের অনেক খেলা দেখিয়ে, অনেক খেলার খেলোয়াড় হিসেবে ব্যবহার করে মাউন্টব্যাটেন তার দায়িত্ব অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছিলেন।

এ ব্যাপারে কংগ্রেসকে, বিশেষত জওহরলাল নেহরুকে, তিনি এমনভাবে কব্জা করেছিলেন যে তার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কংগ্রেস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শেষ প্রতিনিধি মাউন্টব্যাটেনকে স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রপতি করেছিলেন! এটা একদিক দিয়ে যেমন ছিল এক মহাব্যতিক্রমী ব্যাপার, তেমনি অন্যদিক দিয়ে কংগ্রেসের পক্ষে এটা ছিল এক সস্তা রাজনৈতিক কেলেংকারি। এ কেলেংকারি সত্ত্বেও কংগ্রেস হয়ে দাঁড়ায় ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সব থেকে বড় বিরোধী শক্তি এবং ভারতের স্বাধীনতার পথপ্রদর্শক! কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের শ্রেণীচরিত্র, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে তাদের নাড়ির যোগ রক্ষা করেই এ কাজ করেছিল। কাজেই স্বাধীন ভারত ও সেই সঙ্গে স্বাধীন পাকিস্তানের চরিত্র যা হওয়ার তাই হয়েছিল।

মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী স্বাধীনতা আন্দোলন করেছিলেন অহিংসভাবে। কিন্তু তার সেই অহিংস রাজনীতির পরিণতিতে স্বাধীনতার সংগ্রামে, বিশেষত ভারত স্বাধীন হওয়ার মুহূর্তে, এত লাখ লাখ নিরীহ মানুষ হিংসার শিকার হয়ে নিহত, আহত, বাস্তুচ্যুত ও দেশত্যাগী হয়েছিলেন, যার কোনো দৃষ্টান্ত দুনিয়ার ইতিহাসে নেই। এ ক্ষেত্রে মুসলিম লীগের রাজনীতি একই শ্রেণীর চরিত্রের দ্বারা গঠিত হয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারতের রাজনীতিকে বিভক্ত করেছিল। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভারতের রাজনীতির মূলধারা অনুসরণ করলে স্পষ্ট বোঝা যাবে, সংখ্যালঘিষ্ঠের সেই সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতার পরিণাম হিসেবেই ঘটেছিল।

বর্তমানে কাশ্মীরে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এটা নতুন নয়। কিন্তু এ সমস্যা সৃষ্টি কীভাবে হয়েছিল এবং মাউন্টব্যাটেন এ ক্ষেত্রে তাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি কীভাবে কার্যকর করেছিলেন, সেটার ওপর সংক্ষিপ্তভাবে যা বলা হয়েছে তার দিকে না তাকালে বোঝা যাবে না। এ ব্যাপারে মাউন্টব্যাটেন যে জওহরলাল নেহরুকে নিজের কৌশলের হাতিয়ার হিসেবে সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছিলেন, এটা এখন আর ধামাচাপা দেয়ার কোনো উপায় নেই। ভারতে গুরুত্বপূর্ণ দেশীয় রাজ্যগুলোর প্রতিটিকেই ভারতভুক্ত করার ক্ষেত্রে নেহরুর তো বটেই, মাউন্টব্যাটেনেরও সক্রিয় সহযোগিতা ছিল, পরামর্শ ছিল, যা তিনি ভারত ছেড়ে যাওয়ার পরও নেহরু অনুসরণ করেছিলেন। এ বিষয়ে কোনো বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। কিন্তু সংক্ষেপে সামান্য কিছু কথা না বললে কাশ্মীর সমস্যা বোঝা সম্ভব নয়।

সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়। সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের বাইরে ব্রিটিশের অধীন যেসব দেশীয় রাজ্য ছিল, সেগুলোও ভারত নয়তো পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শর্ত তৈরি হয়। দেশীয় রাজাদের মধ্যে হিন্দু মুসলমান দুই-ই ছিলেন। এর মধ্যে কোনো কোনোটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক হিন্দু হলেও শাসক ছিলেন মুসলমান, আবার কোনো কোনোটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক মুসলমান হলেও শাসক ছিলেন হিন্দু। শত শত দেশীয় রাজ্যের মধ্যে এ নিয়ে বিশেষ কোনো সমস্যা না হলেও তিনটি রাজ্যে সমস্যা হয়।

হায়দরাবাদ হিন্দুপ্রধান হলেও তার শাসক ছিলেন মুসলমান, জুনাগড় হিন্দুপ্রধান হলেও শাসক ছিলেন মুসলমান এবং কাশ্মীর মুসলানপ্রধান হলেও শাসক ছিলেন হিন্দু। হায়দরাবাদের নিজাম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করার পর ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দরাবাদ দখল করে। জুনাগড়েও ভারতীয় বাহিনী দখল নেয় এবং তার নবাব পাকিস্তানে পলায়ন করেন। কাশ্মীরের রাজা ছিলেন মহারাজা হরি সিং। প্রথমে ভারতে যোগদানে অসম্মত থাকলেও শেষ পর্যন্ত শুধু প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ এ তিন বিষয়ে ভারতের কর্তৃত্ব মেনে চলার শর্তে তিনি বাধ্য হয়ে ভারতের সঙ্গে Instrument of Accession-এ স্বাক্ষর করেন।

পাকিস্তান কাশ্মীরকে তার অন্তর্ভুক্ত করার দাবি প্রথম থেকেই জানানোর ফলে সেখানে এক সংকটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কাশ্মীর জনগণের এক বিরাট অংশও ভারতভুক্তির বিরোধিতা করে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে জওহরলাল নেহরু গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে সে প্রতিশ্রুতি শিকেয় তুলে তিনি কাশ্মীরকে ভারতের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেন। কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তারা সম্পূর্ণভাবে নাকচ করেন। সেই পরিস্থিতি এখনও বজায় আছে।

কিন্তু কাশ্মীরের অধিকাংশ মানুষ ভারত বা পাকিস্তান কোনো রাষ্ট্রেরই অন্তর্ভুক্ত না হয়ে পরিপূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার পক্ষে থাকায় কাশ্মীরে ভারতের শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। সামরিক ক্ষমতার জোরে কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত রেখে ভারত সরকার সেখানে জনগণের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। কাশ্মীরে প্রকৃতপক্ষে সামরিক শাসনই চলছে। সরকার সেখানে এত অধিক সংখ্যায় সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছে যে, প্রতি তিনজন কাশ্মীরির জন্য আছে একজন সৈন্য!

এটা যে শুধু কাশ্মীরের জনগণের জন্যই নির্যাতনমূলক তাই নয়, ভারতের স্বাধীনতার ওপরও এর চাপ খুব প্রবল। কাশ্মীর সমস্যা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে সাংঘর্ষিক সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছে, তাতে উভয় দেশই তথাকথিত দেশরক্ষা খাতে সামরিক ব্যয় করছে বেপরোয়াভাবে। মাত্র কয়েকদিন আগে ভারত ফ্রান্সের সঙ্গে ৩৬টি অতি আধুনিক যুদ্ধবিমান কেনার জন্য চুক্তি করেছে ৫৮ হাজার কোটি টাকার! যুদ্ধবাজ পাকিস্তানেও সামরিক খাতে ব্যয়ের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এর ফলে জনগণের জন্য যে অর্থ ব্যয় প্রয়োজন তা হচ্ছে না।

কাশ্মীরে স্বাধীনতার জন্য জনগণের সংগ্রাম চলছে। ভারত সরকার সেখানে সামরিক শক্তির জোরে এক একটি নতুন সরকার খাড়া করে সেখানে গণতন্ত্রের ভেল্কি দেখাচ্ছে। তারা নির্বাচনও অনুষ্ঠান করছে। কিন্তু এ নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে যে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটছে না তা বলাই বাহুল্য। এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পাকিস্তান তার এলাকা থেকে নিয়মিতভাবে কাশ্মীরে দুই দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে জঙ্গিদের আক্রমণে সহায়তা করছে। অনেক হামলা তারা নিজেরাও সংঘটিত করছে। এর ফলে অন্য কোনো কারণে নয়, বলা চলে শুধু কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করেই দক্ষিণ এশিয়ার এ দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বজায় থাকার শর্ত তৈরি হয়েছে।

কাশ্মীরে এ মুহূর্তে ব্যাপক জনগণ ভারত সরকারের নির্যাতন ও দখলদারির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। পাকিস্তান কাশ্মীর সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও এ প্রতিরোধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো সম্পর্ক নেই। এখন কাশ্মীরের ব্যাপক জনগণ ভারত বা পাকিস্তান কারও অন্তর্ভুক্ত থাকতে চান না। তারা চান পরিপূর্ণ স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতার লড়াই কাশ্মীরে চলছে। এ লড়াইয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভারত সরকার কাশ্মীরের শত শত স্বাধীনতা যোদ্ধাকে খুন করছে। এর বিরুদ্ধে ভারতের প্রগতিশীল কিছু সংগঠন, পত্রিকা ও বুদ্ধিজীবী কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে এলেও সরকার এ বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে এবং ব্যবহার করছে সেখানকার পুতুল সরকারকে।

সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উরির সামরিক ছাউনির অভ্যন্তরে ১৮ ভারতীয় সৈন্য জঙ্গিদের আক্রমণে নিহত হয়েছেন। নিজেরা শত শত কাশ্মীরিকে হত্যা করে চললেও এ সেনাসদস্যদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সরকার যেভাবে আকাশ-বাতাস উতলা করে প্রচারণা চালাচ্ছে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির চেষ্টায় নিযুক্ত আছে এটা লক্ষ্য করার মতো। উরির সেনা ছাউনিতে আক্রমণের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক উড়িয়ে দেয়ার নয়, যা পাকিস্তান সরকার রুটিন ব্যাপার হিসেবে অস্বীকার করেছে।

এ প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, কাশ্মীরে নিজেদের নির্যাতনের বিষয়টি যুক্তিযুক্ত ও আড়াল করার জন্য ভারত সরকার বেলুচিস্তানের জনগণের ওপর পাকিস্তানের নির্যাতনের বিষয়টি সামনে এনে জোর প্রচারণা চালাচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তানের বেলুচ সমস্যার সঙ্গে ভারতের কাশ্মীর সমস্যার কোনো তুলনাই হয় না। এর তুলনা হয় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর পাকিস্তান সরকারের নির্যাতনের।

প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান সরকার প্রথম থেকেই বেলুচ জনগণের ওপর যে নির্যাতন এ পর্যন্ত চালিয়ে আসছে, সেটা ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের ওপর তাদের নির্যাতনের থেকে অনেক বেশি। নিয়মিতভাবে তারা বেলুচিস্তানের ওপর বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করেছে। আইউব খানের আমলে সেখানে বোমাবর্ষণের ঘটনা পরিণত হয়েছিল একটা নিয়মিত ব্যাপারে। ভারত তার নিজের স্বার্থে এখন বেলুচিস্তানে পাকিস্তানের নির্যাতনের বিষয়টি সামনে আনলেও এটা ভালো হয়েছে। বিশ্বের জনগণের দৃষ্টিও এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয়, এ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো কাশ্মীরে ভারতের নির্মম নির্যাতনের বিরুদ্ধে কিছুই বলছে না। তাদের পারস্পরিক রাষ্ট্রীয় সম্পর্কই যে এর মূল কারণ এতে সন্দেহ নেই।

কাশ্মীরে পাকিস্তানি অনুপ্রবেশ থেকে নিয়ে জঙ্গি হামলার যেসব ঘটনা ঘটছে তা সম্ভব হতো না, যদি ভারত সরকার কাশ্মীরের জনগণের ওপর নিয়মিত সামরিক হামলার মাধ্যমে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে না যেত। আসলে কাশ্মীরে এখন গণভোট ছাড়া সমস্যার অন্য কোনো গণতান্ত্রিক সমাধান নেই। জওহরলাল নেহরু কাশ্মীরে গণভোটের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে কাশ্মীরকে ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করার জন্যই এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ভারত সরকার নেহরুর সময় থেকে কাশ্মীরকে যেভাবে হজম করার চেষ্টা করে এসেছে তা সফল হয়নি। কাশ্মীরকে হজম করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এর জন্য ভারতীয় জনগণকেও অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

আসলে কাশ্মীরে এখন যে রাজনৈতিক উত্তাপ দেখা যাচ্ছে, সে উত্তাপ মাউন্টব্যাটেন ও নেহরু যৌথভাবেই সৃষ্টি করে গেছেন। তার ধারাবাহিকতাই এখনও চলছে। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য করার বিষয়, এ অবস্থা সৃষ্টি করে শুধু যে সাম্রাজ্যবাদীরাই লাভবান হচ্ছে তাই নয়। এর ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি প্রায় একটি স্থায়ী ব্যাপারে পরিণত হওয়ায় ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের শাসক শ্রেণী ও তাদের সরকারও প্রভূতভাবে লাভবান হচ্ছে। এ দুই রাষ্ট্রই নিজেদের দেশের হাজার সমস্যা ধামাচাপা দিয়ে জনগণের দৃষ্টি কাশ্মীরের দিকে ঘুরিয়ে রেখে তাদের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধকেও অনেকাংশে বিভ্রান্ত ও দুর্বল করতে সক্ষম হচ্ছে।

এ বিষয়টিও যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পরিকল্পনার বাইরে ছিল এমন নয়। উপরন্তু এসব হিসাব করেই তারা যেভাবে চেয়েছিল সেভাবেই ব্রিটিশ ভারতকে বিভক্ত করে স্বাধীনতা দিয়েছিল। ভারত শাসন করতে গিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতীয় জনগণের ওপর জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শোষণ-নির্যাতন জারি রেখেছিল। ভারত ছেড়ে যাওয়ার সময়ও তারা ভারতবর্ষের জনগণের জীবনে সাম্প্রদায়িকতা এবং দুই দেশের মধ্যে শত্রুতামূলক সম্পর্ক স্থায়ী করার জন্যই কাশ্মীর সমস্যা সৃষ্টি করে গেছে।

আমি এ পরিস্থিতির কয়েকটি দিকের উল্লেখ করে ‘মাউন্টব্যাটেন জিন্দাবাদ’ নামে দৈনিক সমকালে (২৩.০৮.২০১৬) একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। এ মুহূর্তে কাশ্মীরে যা ঘটছে তাকে সামনে রেখে ‘মাউন্টব্যাটেন জিন্দাবাদ’ বলা ছাড়া উপায় নেই। কারণ ১৯৪৭ সালে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে চক্রান্ত করে যেভাবে ভারতবর্ষ বিভক্ত করেছিল, সেই ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে অবহিত হয়ে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের চেষ্টা না করলে এ পরিস্থিতির পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। - যুগান্তর

২৫.০৯.২০১৬

বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে