বুধবার, ০৭ অক্টোবর, ২০১৫, ০১:৪৮:২৭

অস্বস্তি সরকার ও কূটনীতিক মহলে

অস্বস্তি সরকার ও কূটনীতিক মহলে

কূটনৈতিক প্রতিবেদক : মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কূটনীতিকদের পাশাপাশি সরকারও অস্বস্তিতে পড়েছে। নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় বিদেশি দূতাবাসগুলোর দেওয়া সতর্কবার্তায় বাতিল হচ্ছে বিদেশিদের একের পর এক সফর। প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন থেকে শুরু করে ক্রীড়াঙ্গন পর্যন্ত। এক ইতালিয়ান নাগরিক খুন হওয়ার পর সরকার নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করলেও এর মধ্যেই ঢাকার বাইরে খুন হয়েছেন একজন জাপানি নাগরিক। ফলে শুধু ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় নয়, পুরো দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিদেশিদের নিরাপত্তা জোরদারের দাবি করেছেন কূটনীতিকরা। পাশাপাশি দুই খুনের তদন্তে তেমন কোনো অগ্রগতি না থাকায় এবং এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো ক্লু খুঁজে না পাওয়ায় সৃষ্টি করেছে অস্বস্তি। খুনে আইএসের দায় স্বীকার সেই অস্বস্তির মাত্রা আরও বাড়িয়েছে। সরকার মনে করছে, বাংলাদেশ যখন আর্থ-সামাজিকভাবে বিশ্বে সম্মানিত হচ্ছে, তখন কোনো বিশেষ মহল সরকার ও জনগণের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে।

জানা যায়, ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলা ও জাপানের নাগরিক হোশি কোনিওর হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার বিকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ঢাকায় থাকা বিদেশি কূটনীতিকদের জন্য যৌথ ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক, র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ও ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ দুই মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তারা নিরাপত্তা নিয়ে বিদেশিদের উৎকণ্ঠা, দুই খুনের তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরেন। এতে যোগ দেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের প্রধান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্র ও সংস্থার রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার বা মিশনের প্রধান।

এ ব্রিফিংয়ে সারা দেশে বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকরা। সেই সঙ্গে দুই খুনের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবিও তারা সরকারের কাছে জানিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে থাকা সব বিদেশি নাগরিকের সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা জানানো হয়। এ সময় দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আইএস এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত- এমন কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। তবে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

ব্রিফিং শেষে কূটনৈতিক কোরের ডিন ও ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন সাংবাদিকদের বলেন, দুই ঘটনার পূর্ণ চিত্র বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও পুলিশের আইজিসহ সংশ্লিষ্টরা নিরাপত্তার বিষয়ে আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। আমরাও বিভিন্ন আইডিয়া শেয়ার করেছি। ইতিমধ্যেই তারা নিরাপত্তা জোরদারও করেছেন। তাতে আমরা কৃতজ্ঞ। তবে সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িতদের বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেছি।

হাইকমিশনার আরও বলেন, একই সঙ্গে বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনা তদন্তের বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। হত্যাকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে তদন্ত ও ঘাতকদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দিয়েছেন তারা। পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। এ কথাটিই ব্রিফিংয়ে বিশেষভাবে কূটনীতিকদের অবহিত করা হয়েছে।

এ ঘটনায় আইএস জড়িত কিনা এ বিষয়ে এখনো আমরা কোনো প্রমাণ পাইনি। বিষয়টির তদন্ত চলছে। সম্ভাব্য হুমকির ব্যাপারে বিদেশিরা যে তথ্য পেয়েছিল সেটি তারা সরকারকে জানিয়েছিল। কিন্তু সন্ত্রাসীরা যখন অপকর্ম ও অপরাধ ঘটায়, তখন তো তারা এক জায়গায় থাকে না। জায়গা বদল করে। দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা সতর্কতা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দূতাবাস থেকে নিজ দেশের নাগরিকদের সতর্কতা জারি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আশা করি তারা বিষয়টি উপলব্ধি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

সূত্র জানায়, ব্রিফিংয়ে প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুই খুনের জন্য তাদের শোক ও সমবেদনার কথা ব্যক্ত করেন। পরে এ ঘটনার তদন্তের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তাদের লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এরপর কথা বলেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। তিনি জানতে চান নিরাপত্তার বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপগুলো কী কী। এর উত্তরে পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তারা তাদের ইতিমধ্যেই নেওয়া ব্যবস্থা ও পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। এরপর একে একে কথা বলেন জাপানের রাষ্ট্রদূতসহ অন্য পশ্চিমা কূটনীতিকরা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দুই মন্ত্রী বাংলাদেশে থাকা বিদেশিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সারা দেশে নেওয়া নিরাপত্তাব্যবস্থার কথা তুলে ধরেন।

তারা কূটনীতিকদের জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল আছে। তবে বিদেশিদের বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা বাংলাদেশে থাকা সব বিদেশির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে সাম্প্রতিক গ্যালাপের গ্লোবাল ল অ্যান্ড অর্ডার রিপোর্ট তুলে ধরে বাংলাদেশ প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় শান্তিপূর্ণ উল্লেখ করে বলেন, কয়েকটি অপরাধ কর্মকাণ্ডের কথা তুলে পুরো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে- বলা উচিত হবে না। সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্সের কথা উল্লেখ করেন পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীদ্বয়। ব্রিটিশ হাইকমিশনার তার বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুটি সম্মানজনক পুরস্কারপ্রাপ্তি ও জিরো টলারেন্সের প্রশংসা করেছেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ব্রিফিংয়ে বলেন, নিহত সিজার তাভেলা ও হোশি কোনিও দুজনই ভালো মানুষ ছিলেন। সিজার খুনের পরিপ্রেক্ষিতে গুলশান থানায় হওয়া মামলার তদন্তে ডিবি ও ডিএমপি একটি পেশাদার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সিআইপি ও র্যাবও এর তদন্ত করছে। হোশি কোনিও খুনের ঘটনায় রংপুরের কাউনিয়া থানায় হওয়া মামলার পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব, সিআইডি ও পিবিআই তদন্ত করছে। পুলিশ ইতিমধ্যে চার সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করেছে। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। অন্যদের ধরতে অপারেশন চলছে।

ব্রিফিংয়ের শুরুতে মূল বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী কূটনীতিকদের উদ্দেশে বলেন, দুটি দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আপনারা ভীতসন্ত্রস্ত হবেন না। এ পরিপ্রেক্ষিতে আপনাদের প্রতিক্রিয়া শুধু দুষ্কৃতিকারীদের উৎসাহিতই করবে। দুই খুনের পেছনে কারা আছে বা কী উদ্দেশ্যে এটি ঘটানো হয়েছে তা বের করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

নিজেদের মধ্যে বৈঠকে পশ্চিমারা : বিকালে ব্রিফিং থেকে ফিরে নিজেরা আবার বৈঠক করেছেন উৎকণ্ঠিত পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা। ইউরোপের একটি দেশের কূটনীতিকের বাসায় আয়োজিত ওই বৈঠকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলোচনা করেন তারা। সেখানে যোগ দিতে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্র, কনাডা ও অস্ট্রেলিয়ার কূটনীতিকদেরও। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদের বৈঠক চলছিল।

জাতিসংঘ ও ফ্রান্সের নিন্দা : বাংলাদেশে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার নিন্দা জানিয়ে খুনিদের খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মুখপাত্রের দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, জাতিসংঘ আশা প্রকাশ করছে, বাংলাদেশ সরকার অনতিবিলম্বে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতেও এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে দ্রুত তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে।

সতর্কতা জারি অব্যাহত : বিদেশি দূতাবাসগুলো তাদের সতর্কতা জারি অব্যাহত রেখেছে। গতকালও বাংলাদেশে সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায় রাখতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কোরিয়া, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ।-বিডিপ্রতিদিন
৭ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে