বুধবার, ০৭ অক্টোবর, ২০১৫, ০৪:২৪:৫৮

সন্দেহজনক সেই ই-মেইল উদ্ধার

সন্দেহজনক সেই ই-মেইল উদ্ধার

তোহুর আহমদ ও মাহবুব রহমান : জাপানি নাগরিক কুনিও হোশির খুনিরা স্থানীয়, নাকি বাইরে থেকে এসেছিল- এমন প্রশ্নের উত্তর এখনই খোলসা করতে রাজি নন আইনশৃংখলা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা। তারা বলছেন, এ প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অনুসন্ধান রহস্য। আর তাদের তদন্ত চলছে ‘নর্থ-সাউথ-ইস্ট-ওয়েস্ট’ পদ্ধতিতে। অর্থাৎ সম্ভাব্য সব দিক মাথায় রেখে তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত দশটি সম্ভাব্য সূত্রকে সামনে রেখে তদন্ত চলছে। তদন্তের এ রোডম্যাপের মধ্যে তারা শিগগিরই আশার আলো জ্বালাতে পারবেন বলে মনে করেন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ক্লু হিসেবে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে সন্দেহভাজন একটি ই-মেইল। এর আরবি ও ইংরেজি ভার্সনও পাওয়া গেছে।

এ ই-মেইলে বার্তা আদান-প্রদানের জন্য সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। তারা মনে করেন, জাপানি নাগরিক খুনের হাইপ্রোফাইল তদন্তে সন্দেহজনক ই-মেইলটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। নানা সূত্র মিলিয়ে এমনও ধারণা করা হচ্ছে যে, ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক ও রংপুরে জাপানি নাগরিক হত্যার নির্দেশদাতা একজনই।

দুই বিদেশী নাগরিক খুনের তদন্তে অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল জিয়াউল আহসান সোমবার রাতে প্রতিবেদককে বলেন, আমরা রাত-দিন কাজ করছি। ঘটনার রহস্য ভেদ করার ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়েছি। তবে তদন্ত পর্যায়ে সব তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হলে লক্ষ্য অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, আপনাদের আশ্বস্ত করছি, শিগগিরই আমরা ঘটনার আদ্যোপান্ত গণমাধ্যমকে জানাব। তবে তদন্ত চলাকালে অনুমান নির্ভর কোনো সংবাদ প্রকাশ থেকে বিরত থাকার জন্য তিনি আহ্বান জানান।

সন্দেহজনক ই-মেইল : হত্যাকাণ্ডের মাত্র ৩ দিন আগে শহরের একটি কম্পিউটারের দোকান থেকে একটি ই-মেইল আদান-প্রদানের তথ্য এসেছে গোয়েন্দাদের হাতে। শহরের একটি সাইবার ক্যাফে থেকে একজন অপরিচিত যুবক ই-মেইল আদান-প্রদান করেন। পরে ই-মেইল বার্তার বিষয়বস্তু তিনি ফটোকপি করে ওই সাইবার ক্যাফে থেকে বেরিয়ে যান।

জানা গেছে, ই-মেইলটির বার্তা ছিল দুর্বোধ্য এবং সাংকেতিক। আরবি ও ইংরেজি ভাষায় ই-মেইল বার্তাটি আদান-প্রদান করা হয়। ই-মেইলের শব্দগুলো হচ্ছে, ওয়েটিং গুড অ্যাক্টর, এন্ড গড সেভড হার রিওয়ার্ড/সিটি-হেল/ওয়েটিং ফ্লেয়ারর্স ইব্রাহিম আল কাশিম এন্ড গড সেভ হার রিওয়ার্ড/ ওডিজেডএল। এ ধরনের একাধিক দুর্বোধ্য শব্দগুচ্ছ রয়েছে ওই ই-মেইল বার্তায়।

সন্দেহজনক এ ই-মেইল বার্তার মর্মার্থ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এই ই-মেইলটি দেখেছেন র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ। সোমবার রাতে র‌্যাব-১৩ এর ব্যাটালিয়ন সদর দফতরে কর্নেল আজাদ এই প্রতিবেদককে বলেন, ই-মেইল বার্তাটির বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব সম্ভাবনা মাথায় নিয়েই তারা তদন্ত করছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী সেই রিকশাচালক যা বললেন : জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে রিকশায় নিয়মিত তার খামারে নিয়ে যেতেন স্থানীয় রিকশাচালক মোন্নাফ মিয়া। তিনিই ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী। মোন্নাফ মিয়া এখন কোতোয়ালি থানা পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। বিশেষ ব্যবস্থায় এই প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে থানায় মোন্নাফ মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম হন। এ সময় ঘটনার বিবরণ দিয়ে রিকশাচালক মোন্নাফ মিয়া আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, প্রতিদিনের মতোই জাপানি বাবুকে রিকশায় করি নিয়া যাং। সেদিন যাওয়ার সময় যেটে খুন হয় তার আগত একজন মটরসাইকোলত পাকা রাস্তায় খাড়া হইয়া ছিল। আরও দুইজন কাঁচা রাস্তায় খাড়া হইয়া মোক গাড়ি থামবার কয়। মুই থামার আগত গাড়ির সামনোত আসি গাড়ি আটক করে। পরে দুইজন পিস্তল বাইর করি জাপানি বাবুক গুলি করে। ওই সময় মুই ভয়ে কাঁপতেছিনু। গুলি করার পর একজন মোক কয়, তুই পালাও। না হলে গুলি করিম। মুই ভয়ে গ্রামের ভিতর‌্যার রাস্তা দিয়া দৌড়ি যাং। ফিরি দেকম ওমরা তিনজন মটরসাইকোলতকরি হারাগাছের দিকে যাবার নাগছে। জাপানি বাবু রিকশা থাকি মাটিত পড়ি গেছে। মোন্নাফ মিয়া নিশ্চিত করেন খুনিরা তাকে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষাতেই পালাতে বলে।

রিকশাচালকের এ বক্তব্য রেকর্ড করেছে পুলিশ। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রিকশাচালকের ভাষ্য অনুযায়ী খুনিরা দুটি অস্ত্র ব্যবহার করে। প্রথমে একজন গুলি করার পর দুটি গুলি কুনিওর শারীরে বিদ্ধ হয়। পরে আরেকজন তার অস্ত্র দিয়ে কুনিওকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। রংপুর মেডিকেলের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে। গুলি শরীর ভেদ করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নাড়ি ফুটো হয়ে যায়। এলোপাতাড়ি গুলির কারণে কুনিওর একটি আঙ্গুল প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

নির্দেশদাতা একজনই : গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, দুই বিদেশী নাগরিককে খুনের নির্দেশদাতা একজনই। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বাস্তবায়নে এ খুন করা হয়েছে। ঘটনার পর আইএসের দায় স্বীকারের বিষয়টিও বিশ্বাসযোগ্য নয়। গোয়েন্দারা বলছেন, জাপানি নাগরিক কুনিও হোশির সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি নিতান্ত সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। তার ব্যক্তিগত কোনো শত্রু ছিল না। সহজ শিকার হিসেবে খুনিরা এ বৃদ্ধ বিদেশীকে বেছে নেয়। একইভাবে রাজধানীর গুলশানে ইতালির নাগরিক সিরাজি তাভেল্লাকেও সহজ শিকারে পরিণত করেছে খুনিরা। তদন্তের সংঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, ঘটনা সংগঠনের প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এ দুই খুনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততার ভিত্তি নেই।

এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা একটি সাদা কাগজে মানচিত্র এঁকে প্রতিবেদকের কাছে খুনের ছকটি খোলাসা করার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ইতালি নাগরিক তাভেল্লা যদি খুনিদের সুনির্দিষ্ট টার্গেট হতেন তবে তাকে খুন করার মোক্ষম জায়গাটি ছিল গুলশানে তার বাসভবনের আশপাশ। কারণ, তাভেল্লার বাসার আশাপাশ অনেকটাই নির্জন এবং সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য একাধিক বিকল্প রাস্তা খোলা ছিল। কিন্তু খুনিরা তাকে এমন এক জায়গায় খুন করেছে যেখান দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ সীমিত ছিল।

পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি রয়েছে এমন রাস্তা দিয়েই খুনিরা বেরিয়ে গেছে। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা প্রতিবেদককে বলেন, প্রকৃতপক্ষে খুনিদের ওপর নির্দেশ ছিল দু’জন বিদেশীকে খুন করতে হবে। এ নির্দেশ পালনের জন্য তারা গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায় চলে যায়। সেখানে হাতের কাছে বৃদ্ধ তাভেল্লাকে পেয়ে তাকে খুন করা হয়। একইভাবে জাপানি নাগরিককেও খুন করা হয়েছে অনেকটা র‌্যানডম স্যাম্পল হিসেবে। এ কারণেই নিভৃত গ্রামে কৃষি কাজে নিয়োজিত কুনিওকে বেছে নেয় খুনিরা।

যানবাহন পরিবর্তন : গোয়েন্দারা বলছেন, তাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, খুনের পর পালিয়ে যাওয়ার পথে খুনিরা যানবাহন পরিবর্তন করে। মোটরসাইকেলে এসে মিশন বাস্তবায়ন করে ফিরে যাওয়ার পথে তারা মোটরসাইকেল পরিবর্তন করে। অথবা অন্য কোনো যানবাহনে এলাকা ছেড়েছে। ঘটনাস্থলের আশপাশ ঘুরে দেখা গেছে, কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলু কাচুটারি গ্রামের ঘটনাস্থলটি অনেকটাই নির্জন। এটি রংপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকার শেষ সীমানাসংলগ্ন।

ধারণা করা হচ্ছে, খুনিরা ঘটনা ঘটিয়ে পালানোর জন্য হারাগাছ এলাকার সড়কপথ বেছে নেয়। পুলিশ বলছে, এ পথে তিস্তা নদী পার হওয়ার একাধিক ঘাট রয়েছে। নদীপথ ব্যবহার করে রংপুর শহর এড়িয়ে বিকল্প পথে তারা গা ঢাকা দিয়েছে। তিস্তা পার হলেই উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট এলাকা। এ জেলা শহরের সঙ্গেই ভারতীয় সীমান্ত। পুলিশ বলছে, খুনিরা এ পথেও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে থাকতে পারে।-যুগান্তর
৭ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে