ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : এবার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ক’দিন আগে থেকেই সারা বাংলায় ছড়িয়েছে ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস’ হয়েছে। এই অভিযোগের মধ্যেই পরীক্ষা গ্রহণ করেন কর্তৃপক্ষ।পরীক্ষার পর থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ-সমাবেশ ও মানবন্ধন করে আসছে ভর্তিচ্ছুরা।ভর্তি ফলাফল বাতিলে সরকারকে আল্টিমেটাম শেষে বুধবার সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়েছে। তারা শাহাবাগের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ করেছে।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এ কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করেছেন।
দেশের শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্নমহল থেকেও পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষার দাবি করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্টরা কোনো মতেই বিষয়টি আমলে নেয়নি কিংবা সে ধরনের কোনো মনোভাবও লক্ষ্য করা যায়নি। বরং বিতর্কিত পরীক্ষাটির ফলাফল প্রকাশ করে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়েছে। রংপুরে সরকার দলীয় লোকজনের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন নারী শিক্ষার্থীরাও। আমরা দেখেছি, তাদের ওপর পুলিশের এ্যাকশনের চিত্র, কীভাবে পুলিশের রাইলেফের ভার্ট দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে, কীভাবে নারী শিক্ষার্থীদের চুলে মুঠো ধরে টানা হেঁচড়া করা হয়েছে!
পরীক্ষার পর থেকে এ পর্যন্ত সংশ্লিষ্টদের তৎপরতা দেখে জনমনে এমন ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে- তড়িঘড়ি করে যে কোনো মূল্যে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে। আসলেই কী ধামাচাপা হচ্ছে, না অভিযোগটি আরো বেশি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় হচ্ছে? আমাদের ধর্মেও একটি বাণী আছে- মানুষের কর্মের প্রতিচ্ছবি তার চেহারায় ভাসে। ফলে সংশ্লিষ্টদের তৎপরতায় সহজেই অনুমেয় এখানে কিছু একটা ঘাপলা হয়েছে। অন্যথা এমনটি করার কথা নয়।
প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রথম থেকেই বলে আসছেন- ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। আবার সাংবাদিকদের কাছে তিনিই বলেছেন- ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া প্রশ্নগুলো ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন কি না, তা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে খতিয়ে দেখা হয়নি’। এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হল- বিষয়টি তদন্ত করে দেখার আগেই মন্ত্রী কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে- প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। এছাড়া এই অভিযোগের পক্ষে বিভিন্ন মহলের যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কেনইবা তদন্ত কমিটি গঠন করে তা খতিয়ে দেখা হলো না। ফলে এ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই জনমনে নানা প্রশ্ন জাগে।
এই পরীক্ষা নিয়ে সরকাররে সংশ্লিষ্টমন্ত্রী যাই দাবি করুক না কেন, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগটি একেবারেই অমূলক ধরে নেয়ার সুযোগ নেই। কেননা, পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার দুদিন আগে থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব ভেসে বেড়াচ্ছিল। তা ফেসবুকেও ছড়িয়েছে। অনেকে আগের রাতেই প্রশ্নপত্র পেয়েছেন তা গণমাধ্যমের সাক্ষাৎকারেও স্বীকার করেছেন।
পরীক্ষার দুই দিন আগে মঙ্গলবার রাতে এই অভিযোগে মহাখালী ডিওএইচএস থেকে নগদ ৩৮ হাজার ও এক কোটি ২১ লাখ টাকার ১৩টি চেকসহ চারজনকে আটক করে র্যাব। এছাড়া পরীক্ষার দিন আগারগাও থেকে ইউজিসির কর্মকর্তা ওমর সিরাজসহ চারজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। পরে রংপুর থেকেও শিক্ষক-চিকিৎসকসহ সাতজনকে র্যাব আটক করে। তখন র্যাব গণমাধ্যম কর্মীদের জানিয়েছিল, প্রশ্নপত্র ফাঁসের চক্রটির মূল হোতা ওমর সিরাজকে জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে। তারা দীর্ঘদিন ধরেই এটি করে আসছে। কিন্তু আমরা কি দেখলাম- র্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায় ৩ অক্টোবর ওমর সিরাজের মারা যান। র্যাবের পক্ষ থেকে হার্টএ্যাটাকে ওমর সিরাজের মৃত্যুর কথা বলা হলেও পরিবারের দাবি তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
এরফলে স্বাভাবিকভাবেই জনমনের সেই ধারণা আরো প্রগাঢ় হয়েছে। এখন সর্বমহলে প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ধামাচাপা দিতেই এমনটি ঘটলো? অন্যথা কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটল?। আমাদের কথা হলো - ইউজিসি কর্মকর্তা ওমর সিরাজ তো এমন কোনো ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী ছিল না যে, তাকে গ্রেফতারের পর র্যাব হেফাজতেই জিজ্ঞাসাবাদ করা খুবই জরুরি ছিল। কেননা, সাধারণত আমরা জানি কিংবা দেখে আসছি, র্যাব অভিযুক্ত কাউকে গ্রেফতার করে পুলিশে সোপর্দ করে। আর পুলিশই পরবর্তী তদন্ত কিংবা আসামীকে রিমান্ডে নেয়ার প্রয়োজন হলে সেটিও করে থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এমনটি করা হয়নি। স্বাভাবিকভাবে এ নিয়ে নানা প্রশ্ন জাগতেই পারে। কেননা, এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারকাজ সম্পন্ন হলে যেমনটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত চক্রগুলো সম্পর্কে অনেক তথ্য প্রমাণ পাওয়া যেত তেমনি এর প্রতিকারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ হতো। কিন্তু এখন তো সেই সুযোগ থাকল না।
জানি জনশ্রুতি কতটুকু সত্য, তবে গেল দুইদিন ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় একটি বিষয় ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। সেটি হলো- একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কেলেঙ্কারীর সঙ্গে জড়িত থাকায় বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার জোর তৎপরতা চলছে। ইতোমধ্যে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তা নিশ্চিত হয়ে তা রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানের দপ্তরে প্রতিবেদন দিয়েছে। ফলে এ নিয়ে সরকারের ভেতরেই চলছে ব্যাপক তোলপাড়। যতদূর শোনা যাচ্ছে- সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরাও এ ঘটনায় খুবই ক্ষুব্ধ। কোনোভাবেই এ ঘটনার দায় সরকার নিতে চাচ্ছে না। তবে মেডিকেল ভর্তি ফলাফল ঘোষণার পর ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাওয়ায় কিছুটা বিপাকে পড়েছে সরকার। সহজেই সমাধানে যেতে পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকার বিকল্প খুঁজছে। উচ্চ আদালতে কর্মরত এমন একজন কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, আদালতের মাধ্যমেই সরকার এর একটা সমাধানে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।এতে অচিরেই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের জন্য সুখবর আসতে পারে।
এনিয়ে দেশের শিক্ষাবিদরা দীর্ঘদিন কথা বলে আসছেন। তারা বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে আসছেন। কেননা, গেল কয়েক বছরে এমন কোনো পরীক্ষা নেই যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। প্রাথমিক সমাপনী থেকে শুরু করে সব পাবলিক পরীক্ষা, নিয়োগ পরীক্ষা, এমন কী বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। কে শোনে কার কথা! সরকারের পক্ষ থেকে আশাপদ কোন পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি।
তবে এ বিষয়ে সরকাররে সংশ্লিষ্টমন্ত্রী যাই দাবি করুক না কেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগটি বেশ গুরুতর, কিছু দালিলিক তথ্য-প্রমাণও রয়েছে অভিযোগ উত্থাপনকারীদের কাছে। এমন কী আইন-শৃঙ্খলাাবাহিনীর কর্মকাণ্ডেও এর কিছুটা প্রমাণ মিলেছে।ফলে এই ভর্তি পরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। আর তাই এ পরীক্ষার ফলাফল বাতিলের কোনো বিকল্প নেই। সরকারেরর উচিত হবে সবার দাবির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ঘটনাটি গুরুত্বের সাথে তদন্ত করা, প্রশ্নবিদ্ধ এই পরীক্ষার ফল বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা গ্রহণ করে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা। সেই সাথে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার জড়িত ব্যক্তিরা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করা । সবশেষে, মনে পড়ে গেল গ্রামবাংলায় বহুল প্রচলিত সেই প্রবাদের কথা ‘যাহা রটে তাহা কিছু না কিছু ঘটে’।
লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক এবং কলাম লেখক। ই-মেইল:[email protected]