চৌধুরী আকবর হোসেন : ফিরতি হজ ফ্লাইটের প্রায় প্রতিটি বিমান নির্ধারিত সময় থেকে বিলম্বে ফেরা এবং লাগেজ না পাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়ছেন হাজিরা। সৌদি আরব থেকে কমপক্ষে ৬/৭ ঘণ্টা পর দেশে ফিরেও লাগেজ না পেয়ে ক্ষুব্ধ হাজিরা। গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় ফিরতি হজ ফ্লাইট। প্রথম হজ ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ের ৭ ঘণ্টা পরে ঢাকায় পৌঁছায়। এদিকে বাংলাদেশ বিমানের ১ অক্টোবরের দুটি ও ২ অক্টোবর একটি ফ্লাইটের সর্বমোট ১৩৫০ হাজির লাগেজ দেশে আসেনি। দেশে ফিরে লাগেজ না পেয়ে প্রায় ৪০ জন হাজি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবস্থান করছেন। হজযাত্রী ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
সরেজমিনে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘুরে দেখা গেছে, দেশে ফিরেও হাজিরা লাগেজের জন্য অপেক্ষা করছেন বিমানবন্দরে। এছাড়া যারা পূর্বে লাগেজ পাননি তারাও বিমানবন্দরের ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ বিভাগে খোঁজ নিচ্ছেন। প্রায় প্রতিটি ফিরতি হজ ফ্লাইট ৬-৭ ঘণ্টা দেরিতে ফিরছে। দেরিতে ফিরেও লাগেজ না পেয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে হাজিদের। গত ২ অক্টোবর দেশে ফিরেও লাগেজ না পেয়ে প্রায় ৮০ জন হাজি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবস্থান নেন। বিমানবন্দরের কনভেয়ার বেল্ট এলাকায় তারা রাত্রী যাপন করেছেন।
সেখানে তারা ফ্লোরে গামছা বিছিয়ে, চেয়ারে বসেই সময় পার করেছেন। খাবার ও পানির অভাবে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বয়স্ক ও নারী হাজিদের অনেকে অপেক্ষা করে লাগেজ না পেয়ে হতাশা নিয়ে গত দুই দিনে অনেকে বাড়ি ফিরে গেছেন। বর্তমানে প্রায় ৪০ জন হাজি সেখানে অবস্থান নিচ্ছেন। এছাড়া যাদের লাগেজ এসেছে তাদেরও তিন-চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে বিমানবন্দরে। বাংলাদেশ বিমানের ১ অক্টোবরের দুটি (বিজি- ৪০১৯ ও বিজি-৬০১৯) এবং ২ অক্টোবর একটি (বিজি-৬০২১) ফ্লাইটে ১৩৫০ যাত্রীদের কারও লাগেজ আসেনি। ফলে লাগেজ নিয়ে চরম ভোগান্তিতে হাজিরা।
মোহাম্মদ ফাহিম উদ্দিন নামের এক হাজি প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের বিমান ছাড়ার কথা ছিল রাত ১২টায় সেটা ছেড়েছে দুপুর ১টায়। ২ অক্টোবর রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে বিজি- ০৩৬ ফ্লাইটে দেশে ফিরেছি। বিমানবন্দরে নেমে জানতে পারি আমাদের লাগেজ আসেনি। কনভেয়ার বেল্ট এলাকায় অপেক্ষা করছি। রুটি- কলা খেয়েই থাকছি। আমারা এক সঙ্গে ৪০ জন লাগেজের জন্য এখানে আছি। রবিবার বিমানমন্ত্রী এসেছিলেন তাকেও আমারা জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। কেউ সঠিক সময় বলতে পারছে না যে কখন লাগেজ পাবো। মন্ত্রী বলার পর বিমানের লোকজন আমাদের জন্য সামান্য খাবারের ব্যবস্থা করেছে। এর আগেও কেউ খোঁজও নেয়নি কোনও হাজির।
যশোরের মো. আব্দুল্লাহ বিমানের বিজি- ৬০২৬ ফ্লাইটে সোমবার সকাল ৯টায় দেশে ফিরেন। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, সকাল ১০টায় বিমান ছাড়ার কথা ছিল সেই ফ্লাইট ছেড়েছে রাত ১১টায়। দেশে ফিরেও ভোগান্তির শেষ হয়নি। লাগেজের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে দুপুর ২টা পর্যন্ত।
একই সুরে অভিযোগ করেন যশোরের কুদরত ই কিবরিয়া। তিনি বলেন, বিমানবন্দরে এসে দেখি লাজেগ পাচ্ছি না। বিমানের কেউ জানাতে পারছে না কখন লাগেজ পাবো। টাকাও নাই তাই বাইরে কোথাও হোটেলেও থাকতে পারছি না। কষ্ট করে এখানেই ফ্লোরে থাকচ্ছি।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, গত রবিবার বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পরিদর্শনে গিয়ে হাজিদের সমস্যার কথা শুনেন। হাজিরা লাগেজ না পাওয়া মন্ত্রীর কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মন্ত্রী যাত্রীদের লাগেজ বিড়ম্বনা দ্রুত নিরসনে জন্য সংশ্লিষ্টদের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এছাড়া মন্ত্রী লাগেজের জন্য অবস্থানকালীন সময় পর্যন্ত যাত্রীদের থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থা করার জন্য সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সগুলোকে নির্দেশ প্রদান করেন। লাগেজ নিয়ে জটিলতা সমাধানে বিমানের একটি প্রতিনিধি দল সোমবার সৌদি আরব গেছেন।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে জানানো হয়, জেদ্দা হজ-টার্মিনালে হাজিদের অস্বাভাবিক চাপ এবং সৌদি কর্তৃপক্ষ আরোপিত বিশেষ নিরাপত্তাজনিত ব্যবস্থায় হাজিদের বিলম্বে বিমানবন্দরে রিপোর্টিং করার কারণে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফিরতি হজ ফ্লাইট অস্বাভাবিক বিলম্ব করেছে। এ অবস্থা আরও তিন দিনের মধ্যে সমাধান হবে।
তিনদিন পার হলেও সমাধান না হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) খান মোশাররফ হোসেন প্রতিবেদককে জানান, এ বিষয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। মন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন, সেটা আমরা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছি। জেদ্দা হজ-টার্মিনালে সৌদি কর্তৃপক্ষ আরোপিত বিশেষ নিরাপত্তাজনিত এবং তারা হাজিদের অস্বাভাবিক চাপ সামলাতে না পারায় ফিরতি হজ ফ্লাইট অস্বাভাবিক বিলম্ব করেছে। শুধু বিমান নয় অন্যান্য এয়ারলাইন্সের ক্ষেত্রেও এই ভোগান্তি হচ্ছে।
মোশাররফ হোসেন জানান, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স মাসব্যাপী পরিচালিত পোস্ট হজ ফ্লাইট কার্যক্রমের আওতায় ১০৯টি ডেডিকেটেড এবং ৩১টি শিডিউল ফ্লাইটসহ ১৪০টি ফ্লাইটের মাধ্যমে মোট ৫৪ হাজার ৮৪৫ জন হাজি দেশে ফিরিয়ে আনবে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সূত্র জানিয়েছে, জেদ্দা বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ও বিমানের অবস্থাপনার জন্য লাগেজ নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। হাজিদের পরিবহনে বিমানের প্রায় প্রতিটি উড়োজাহাজ বোয়িং-৭৭৭। এই বিমানে যাত্রীদের লাগেজ বহন করার পরও অতিরিক্ত লাগেজ বহনের সক্ষমতা রয়েছে। মূলত বিমান হাজিদের লাগেজ পরিহবনের দায়িত্বে একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছে। তারা ঠিক মতো কাজ না করায় এই সমস্যা বেশি হচ্ছে। এছাড়া সৌদি আরবে বিমানবন্দরে অব্যবস্থাপনার কারণেও লাগেজ বিমানে উঠছে না সময় মতো।
লাগেজ না আসলে করণীয় প্রসঙ্গে হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ম্যাজিস্ট্রেট ফরহাদ হোসেন বলেন, এয়ারলাইন্স অফিস কিংবা লস্ট-অ্যান্ড-ফাউন্ড ডেস্কে কমপ্লেন করে রশিদ বুঝে নিতে হবে। এয়ারলাইন্স নিজে অথবা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এজেন্ট (বাংলাদেশ বিমান) এর মাধ্যমে পিআইআর ইস্যু নিশ্চিত করতে হবে। সাত দিনের মধ্যে লাগেজ না আসলে অথবা এয়ারলাইন্স বা লস্ট-অ্যান্ড-ফাউন্ড বিভাগ থেকে যাত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা না হলে এয়ারপোর্টস্থ এয়ারলাইন্স অফিসে গিয়ে লাগেজের মালামালের ফিরিস্তি (ইনভেন্টরি) নির্দিষ্ট ফরমে স্বাক্ষর করে জমা দিতে হবে। ২১ দিনের মধ্যে লাগেজ না আসলে লাগেজ মিসিং বলে গণ্য হবে এবং এয়ারলাইন্স যাত্রীকে ক্ষতিপূরণ বুঝিয়ে দেবে।
পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে লাগেজ আসলে যাত্রী লাগেজও পাবেন, ক্ষতিপূরণও ফেরত চাওয়া যাবে না। অন্যদিকে ২১ দিনের মধ্যে লাগেজ আসলে যাত্রী শুধু লাগেজ পাবেন, ক্ষতিপূরণ পাবেন না। বুকিং এর সময় মূল্যমান ঘোষণাপূর্বক চার্জ দিয়ে বীমাকৃত লাগেজের ক্ষেত্রে ঘোষিত মূল্যমানেই ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হয়। অঘোষিত লাগেজের ক্ষেত্রে ওজন ২০ কেজির মধ্যে হলে সবটুকুর জন্য এবং ওজন ২০ কেজির উপরে হলে কমপক্ষে ২০ কেজির জন্য প্রতিকেজি ২০ ইউএস ডলার হারে ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হয়।-বাংলা ট্রিবিউন
৮ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে