হাবিবুর রহমান খান ও নজরুল ইসলাম : ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা’র দাবিতে অনড় অবস্থানে নেই মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। বর্তমান সংবিধানের আলোকেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন সরকার’ পদ্ধতির বিষয়ে নতুন করে রূপরেখা দেবে দলটি। তবে সেই সরকারের প্রধান হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকবেন না অন্য কেউ হবেন তা আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করার প্রস্তাব থাকবে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকারের ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনার দাবি থাকতে পারে তাদের রূপরেখায়।
বিএনপির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা ও দলের ‘থিংকট্যাংক’ হিসেবে পরিচিত আইনজীবী নেতারা এই রূপরেখা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছেন। দলের বাইরে থাকা কয়েকজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ, দেশী-বিদেশী শুভাকাক্সক্ষী এমনকি জোটের শরিকদেরও পরামর্শ নিচ্ছেন রূপরেখা প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। সম্ভাব্য এই রূপরেখা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। বিশেষ করে, সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে দলটির হাইকমান্ড। নির্বাচনকালীন সরকারের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনকেও গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হয়েছে। শুধু আগামী নির্বাচন নয়, ভবিষ্যতে কিভাবে একটি বিতর্কমুক্ত নির্বাচন কমিশন গঠন করা যায় সে ব্যাপারেও দলটির পক্ষ থেকে রূপরেখাও দেয়া হবে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শিগগিরই সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব প্রস্তাব তুলে ধরবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ ব্যাপারে বলেন, এ নিয়ে আমরা কাজ করছি। দল হিসেবে আমরা আমাদের অবস্থান জাতির কাছে স্পষ্ট করব।
বিএনপির ও তাদের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট গত কয়েক বছর ধরে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এতদিনের এ ধরনের অনড় দাবি থেকে কিছুটা সরে এসেছেন তা তার বক্তব্যেই ফুটে উঠেছে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তিনি বলেন, ‘আমি বলব না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হতে হবে। যে নামেই হোক, একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে হবে। সব দলও তখন নির্বাচনে অংশ নেবে।’
সম্ভাব্য এই রূপরেখায় কী থাকছে, জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট একজন জানান, সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, প্রশাসন ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরপেক্ষকরণ এবং নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আর নির্বাচনের সময় সরকারপ্রধান কে থাকবেন, সরকারে কারা থাকবেন এ নিয়ে বহুমত রয়েছে। সব মতের সমন্বয়ে একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন সরকারের ফর্মুলা বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সেক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধানের ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রস্তাব দেয়া হবে। সংসদে বর্তমানে প্রতিনিধিত্বকারী দলের পরিবর্তে বিগত সময়ে যারা সরকার বা বিরোধী দলে ছিলেন এমন সব দলকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যা রূপরেখায় উল্লেখ থাকবে। এরপর এ ইস্যুতে জনমত তৈরিতে মাঠে নামবে দলটি। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, গোলটেবিল বৈঠকে তাদের দাবি তুলে ধরা হবে। দেশের সুশীল সমাজের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে মতবিনিময় করা হতে পারে। বিভাগীয় শহরের পাশাপাশি রাজধানীতে বড় সমাবেশেরও চিন্তাভাবনা রয়েছে দলটির।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অতীতের মতো আগামীতে আর নির্বাচন বর্জন করতে চান না দলের হাইকমান্ড। একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জনগণ তাদের পক্ষে রায় দেবে এমনটাই তাদের বিশ্বাস। নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীনরা যাতে তাদের আবারও নির্বাচনের বাইরে রাখতে না পারে সেদিকেও দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। তাই আগামী নির্বাচনের দুই বছর দুই মাস আগেই তারা এই ইস্যুতে একটি কার্যকর সমাধান চাইছে।
দলটির নেতারা মনে করেন, বর্তমান বাস্তবতায় সংবিধান পরিবর্তন করে আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া কঠিন। এর চেয়ে বর্তমান সংবিধানের ভেতর থেকে কিভাবে সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা গঠন করা যায় সেদিকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তারা এ লক্ষ্যে সংবিধানের সার্বিক বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছেন। বিশেষ করে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনীতে কি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন। ওই সংশোধনীর আলোকে কিভাবে সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায় তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেন সুপ্রিমকোর্ট। উচ্চ আদালতের ওই রায়কে ভিত্তি ধরেই ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন আনে তৎকালীন মহাজোট সরকার। যাতে বিলুপ্ত হয় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ১২৩(৩) অনুচ্ছেদে (ক) উপ-অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করা হয়। এতে বলা হয়, ‘সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে- মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে।’
ওই বিধানের কারণে সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন কমিশনকে আরেকটি সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। ওই সময়ের মধ্যে সংসদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে না। সংবিধানের ৭২(১) অনুচ্ছেদে সংসদের অধিবেশন বসার ক্ষেত্রে ৬০ দিনের বেশি বিরতি থাকবে না বলে বলা হয়েছে। নির্বাচনকালীন ৯০ দিনের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে না। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ছোট আকারের মন্ত্রিসভা গঠন করবেন। তারাই নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন করবে।
সূত্র জানায়, বর্তমান সংবিধানে নির্বাচনকালীন বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যাপারে সমঝোতায় আসার পক্ষে অনেক সুযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে ছোটখাটো সংশোধনী এনে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব। সেক্ষেত্রে বর্তমান সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী দল থেকে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের কথা বলা আছে। সেই হিসেবে বর্তমানে বিএনপি সংসদের বাইরে থাকায় তাদের নির্বাচনকালীন সরকারে যাওয়া সম্ভব নয়। অনির্বাচিত ব্যক্তিদের এক-দশমাংশ মন্ত্রিসভায় রাখার বিধান রয়েছে।
এই প্রক্রিয়ায় বিএনপির প্রতিনিধিদের নির্বাচনকালীন সরকারে আনতে গেলে মন্ত্রিসভার আকার অনেক বড় হবে। তাতে কাজের ক্ষেত্রে আরও জটিলতা হতে পারে। সেক্ষেত্রে সব দলকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে সংবিধানের কিছু সংশোধনীরও সুপারিশ করবে বিএনপি। পাশাপাশি বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দেয়ার ওপর জোর দেয়া হবে। কিভাবে স্বাধীন কমিশন গঠন করা যায় সেই ব্যাপারেও একটি রূপরেখা দেয়া হবে। সবার মতামত নিয়ে সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের কমিশনার নিয়োগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের কাছে কোনো নাম চাইলে তা দেয়া হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আগামী নির্বাচন যাতে সব দলের অংশগ্রহণে হয় সেটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। এজন্য স্বাধীন কমিশনের পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়েও একটি সমাধানে আসতে হবে। এ লক্ষ্যে শিগগিরই আমাদের দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি প্রস্তাব দেয়া হতে পারে। যুগান্তর
৩১ অক্টোবর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি