শুক্রবার, ০৯ অক্টোবর, ২০১৫, ০১:৪৬:৩১

সবাই এখন লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিতে ব্যস্ত

সবাই এখন লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিতে ব্যস্ত

মাহমুদ আজহার : গণতন্ত্রকে সঠিক পথে চলতে দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, 'গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা টেকসই করতে প্রয়োজন মন খুলে আলাপ-আলোচনা। দেশে এখন সেই পরিবেশ নেই। সব পেশার মানুষ লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিতে ব্যস্ত।'

ড. কামাল বলেন, 'এ মুহূর্তে জরুরি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। কোনোভাবেই বিগত তিন সিটি নির্বাচনের মতো নয়। এটা হওয়ার চেয়ে না হওয়াই ভালো। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনেও নিরপেক্ষ লোক নিয়োগ দিতে হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে করতে হবে শক্তিশালী। শুধু কাগজে-কলমে নয়, সংবিধানকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। গণতন্ত্রকে সঠিক পথে চলতে দিতে হবে। নইলে বাংলাদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।'

গতকাল দুপুরে মতিঝিলের মেট্রোপলিটন চেম্বারের নিজ কার্যালয়ে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন প্রবীণ এই আইনজীবী। তিনি বলেন, '৭৯, '৮৬, '৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারি কিংবা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন দেশবাসী দেখতে চায় না। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীনরা বলেছিলেন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নির্বাচন হচ্ছে। এরপর আলাপ-আলোচনা করে সবাইকে নিয়ে আরেকটি নির্বাচন দেওয়া হবে। এ কথাগুলো আজ কোথায় হারিয়ে গেল?

এখন গুম, হত্যা, অপহরণসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত কিংবা ন্যায়বিচারও হচ্ছে না। এটা দেশবাসীকে আরও আতঙ্কিত করে তোলে। দুই বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করে ড. কামাল বলেন, এ ঘটনায় দেশের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। বিদেশিদের মধ্যেও আতঙ্ক রয়েছে। বিষয়টি এখন জাতীয় একটি ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য জরুরি।

দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধির মতামত নিয়ে একটি কাছাকাছি পর্যায়ে আসতে হবে। কীভাবে কেন ঘটল, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা কী ছিল- সব নিয়েই মন খুলে আলোচনা হতে পারে। কোনোভাবেই আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে 'দলীয় বাহিনী' বানানো উচিত হবে না। এটা হলে দেশের সর্বনাশ হবে।

বাংলাদেশের সংবিধানপ্রণেতা বলেন, 'আমরা দেশে একদলীয় শাসন দেখতে চাই না। বহু দল থাকবে। মতের ভিন্নতাও থাকবে। প্রচার মাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। নিরপেক্ষ থাকবে বিচার বিভাগ। মানুষের বিকল্প মতকেও শ্রদ্ধা করতে হবে। গণতন্ত্রের জন্য এটা খুবই জরুরি। সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠানকেও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। দেশে সংবিধান আছে। এটা শুধু কাগজে-কলমে থাকলেই হবে না, বাস্তবে কার্যকর থাকতে হবে। সংবিধানের বাইরে কাজ করলে আজ হোক কাল হোক, জবাবদিহিতা করতেই হবে। দেশ পরিচালনা করতে হবে সংবিধানের আলোকেই। মৌলিক ইস্যুতে কোনোভাবেই বিভাজন তৈরি করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্য জরুরি।'

তিনি বলেন, 'দেশে দলমত নির্বিশেষে সবাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। দেশি-বিদেশি সবাই বলছে, বিগত ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। রাজনীতিও এখন সুষ্ঠু ধারায় নেই। শাসন ব্যবস্থাও চলছে না সঠিকভাবে। এগুলো ভালো কোনো লক্ষণ নয়। কিছু লোক সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে, আবার কেউ কিছুই পাবে না- এটা হতে পারে না। আইন সবার জন্যই সমান। সামাজিক বৈষম্য দূর করতে হবে।'

গণফোরাম সভাপতি বলেন, যে কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তার সুফল আমরা পাচ্ছি না। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সামাজিক বৈষম্য এখনো দূর হয়নি। মানুষের মৌলিক মানবাধিকার পদে পদে লংঘিত হচ্ছে। অনেক মানুষ আজ হতাশ হয়ে পড়ছে। সবাই পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করছে। স্বাধীন দেশে এটা খুবই দুঃখজনক। ব্যক্তি স্বার্থে সব পেশার মানুষ আজ দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিতে ব্যস্ত। সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষকদের বড় অংশই আজ দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।'

এরপরও নিজেকে আশাবাদী মানুষ মনে করে ড. কামাল বলেন, আমি আশাবাদী তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে। সব পেশায় এখন বিপুলসংখ্যক তরুণরা কাজ করছে। তাদের উচিত হবে, দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কাজ করা। দলীয় সংকীর্ণতার ঊধের্্ব উঠে তাদের কাজ করতে হবে। '৫২, '৬৯ কিংবা '৭১-এ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি কাজ করেছে, আজও তা সম্ভব। ১৬ কোটি মানুষকে একই প্লাটফর্মে দাঁড় করাতে পারে এই তরুণ প্রজন্ম।

তার মতে, দেশ কোনো ব্যক্তি বা দলের নয়, সবারই। আমরা সবাই দেশের মঙ্গল চাই। আইন সবার জন্যই সমান হতে হবে। বিচার বিভাগকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দিতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যেকেরই নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ থাকতে হবে। ৫৫ বছর ধরে আমি আইন পেশায় আছি। একই সঙ্গে অন্তত ৪৫ বছর ধরে রাজনীতি করছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কম দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। তারপরও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো আপস করিনি। আওয়ামী লীগকেও বলব- বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করুন। এটা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। নইলে দেশের জন্য বড় বিপদ অপেক্ষা করছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি উক্তির কথা স্মরণ করে ড. কামাল বলেন, বঙ্গবন্ধু বলতেন- 'গরু-ছাগলের মাথা কেনা যায়, মানুষের মাথা কেনা যাবে না।' কিন্তু আজ আদর্শিক রাজনীতি না থাকায় সবকিছুই কেনা সম্ভব। তারপরও আমি নিরাশ নই। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি। তবে বাধাও অনেক। আজকের তরুণরাই এসব বাধা দূর করতে পারে।'

তার ভাষায়, আওয়ামী লীগের পুরনো কর্মীরা এখনো কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধার আশা করে না। তারা সরকারের সাহায্যের জন্য হাত পাতে না। বঙ্গবন্ধুকে তারা এখনো লালন করছে। অবশ্য তাদের খোঁজখবরও এখন কেউ রাখে না। এমন একজন হলেন নূরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধুর সময় তিনি আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। আগে যোগাযোগ থাকলেও ছয় মাস ধরে তার সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ নেই।

 ড. কামাল বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তেও আমরা দলমত নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়েছিলাম। এর সুফলও আমরা পেয়েছি। সেটাই আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। নীতি আদর্শ যার যাই থাকুক, জাতীয় ইস্যুতে আমাদের ঐকমত্য হতে হবে, যেভাবে লড়েছি মুক্তিযুদ্ধে। এখনো আমাদের দলীয় সংকীর্ণ রাজনীতির ঊর্ধে উঠে কাজ করতে হবে। দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে হবে।

সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে 'সাসটেন্যাবল ডেভেলপম্যান্ট গোল'-এ ১৭টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর মধ্যে স্থান পায় ড. কামাল হোসেনের একটি প্রস্তাব। এর উল্লেখযোগ্য অংশ হলো- 'সহিংসতায় মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। সব ধরনের সহিংসতা, শিশু নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিশু নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। সবারই আইনের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে অবৈধ অর্থ ও অবৈধ অস্ত্র সরবরাহের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে।

যে কোনো অপরাধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সবাইকে একসঙ্গে লড়তে হবে। রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। সব ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবাধ তথ্যের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষা করতে হবে।' বাংলাদেশ প্রতিদিন

৯ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে