এস এম মামুন হোসেন : ডেনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর গণমাধ্যমকে দেয়া প্রথম সাক্ষাৎকারেই দেশটি থেকে ৩০ লাখ অভিবাসীকে বিতাড়নের ঘোষণা দিয়েছেন। এর পরপরই দেশে অবস্থানরত প্রবাসী মার্কিনিদের স্বজনদের মাঝে চরম উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
তারা বলছেন, নির্বাচনের আগে তারা মনে করেছিলেন ট্রাম্প হয়তোবা রক্ষণশীল মার্কিনিদের মন জয়ের জন্য এসব কথা বলেছিলেন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পরও একই ঘোষণা পুনরাবৃত্তি প্রবাসীদের বিতাড়নের বিষয়টিকে মোটামুটি নিশ্চিত করেছে। নির্বাচনের পর তার বিরুদ্ধে ফুসে উঠা গণবিক্ষোভের জবাব দিতে যেয়েও গত শুক্রবার তিনি তার কঠোর অভিবাসন নীতি বাস্তবায়নের সমর্থনে জোরালো বক্তব্য রাখেন।
স্বজনরা বলছেন, তাদের আতঙ্কের প্রধান কারণ দুইটি। এক, তাদের স্বজনরা দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হলে তাদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন চিরতরে নষ্ট হবে। দুই, এর ফলে তারা বড় ধরনের আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হবে। এছাড়া যাদের স্বজনরা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন তাদের পরিবার-পরিজনরাও ভবিষ্যতে তাদের হাত ধরে সেখানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু এর ফলে সে স্বপ্নও এখন মাঠে মরতে বসেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন নির্বাচনে তার প্রতিপক্ষ হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করে জয়ী হওয়ার পর দেশজুড়ে 'ট্রাম্প আমাদের প্রেসিডেন্ট নন' লেখা প্লাকার্ড ও ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। গত শুক্রবার সে বিক্ষোভোর জবাব দেন ট্রাম্প। এ সময় তিনি তার অভিবাসন নীতি নিয়ে তার কঠোর মনোভাবের কথা নির্বাচনের পর প্রথম স্পষ্ট করে দেন।
এরপর দেশটির সিবিএস টিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়ে দেন অভিবাসন নীতি তিনি বাস্তবায়ন করবেনই। তিনি বলেন, তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় অভিবাসন বিষয়ে তিনি যে রূপরেখা দিয়েছেন তা তিনি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে বদ্ধপরিকর। তার এ বক্তব্যের পর দেশটির অভিবাসীদের মধ্যে ভয় ও সন্দেহ আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। তারই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে অবস্থানরত অভিবাসীদের স্বজনরাও নতুন করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তারা বলছেন, নির্বাচনের আগের ভাষণকে তারা জয়ের জন্য কৌশল হিসেবে দেখলেও নির্বাচনের পর তার বক্তব্যকে আর হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই।
দক্ষিণের শহর খুলনার সেলিম সরদারের বড় ছেলে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাস করেন। গত ১৩ বছর ধরে সেখানে থাকলেও এখানে পূর্ণ নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার পায়নি তার ছেলে ইউসুফ সরদার। সেলিম সরদার বলেন, তার ছেলে ২০১৪ সালে গ্রিনকার্ড বা বসবাসের সনদ পেয়েছে। এখন ট্রাম্প যাদের বের করে দেবে তার মধ্যে গ্রিনকার্ডধারীরাও রয়েছে। যারা পূর্ণ নাগরিকত্ব পেয়েছে তাদের সঙ্গেও তার কথা হয়েছে তারাও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
সেলিম সরদার বলেন, ইচ্ছা ছিল, ছোট ছেলে এবার এইচএসসি পাস করলে তাকেও পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু এখন যে অবস্থা তাতে ছোট ছেলেকে পাঠাবার চিন্তা করছেন না। বরং বড় ছেলে যেন সেখানে থাকতে পারে আল্লাহর কাছে সেই দোয়াই করছেন। তিনি আরও জানান, তার পরিবার তার বড় ছেলের পাঠানো অর্থের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। এখন যদি ছেলে দেশে ফিরে আসে তবে বড় ধরনের আর্থিক সংকটেরও আশঙ্কা করছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যে গত ২১ বছর ধরে বসবাস করেন ফরিদপুরের আফজাল হকের বড় মেয়ে জামাই ও তাদের তিন ছেলেমেয়ে। আফজাল হক জানান, মেয়েকে বিয়ে দেয়ার এক বছর পরেই জামাই-মেয়ে একসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায়। সেখানেই তাদের তিন সন্তানের জন্ম হয়েছে। মার্কিন আইন অনুসারে মেয়ে জামাইকে ফেরত পাঠাতে পারলেও তিন ছেলেমেয়ে জন্ম সূত্রে সেখানকার নাগরিক হওয়ায় তাদের বের করে দেয়া যাবে না। এ কারণে তিনি আরও বেশি আতঙ্কিত।
আফজাল হক বলেন, তার মেয়ে জামাইয়ের ভাগ্যে কি আছে জানেন না। তবে তাদের যদি সেখান থেকে বের করে দেয়া হয় তবে তিন সন্তানকে থাকতে হবে যুক্তরাষ্ট্রে। অন্যদিকে তাদের পিতামাতাকে দেশে ফিরে আসতে হবে। যা হবে আরও বেশি বেদনার।
আফজাল হক আরও বলেন, গত ২১ বছরে তার মেয়ে-জামাই কমপক্ষে ২০ জনকে তাদের গ্রাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গেছে। যাদের অনেকেই গ্রিনকার্ড পেয়েছে। আবার অনেকে এখনও পায়নি। ফলে একই সঙ্গে তাদের গ্রামের বহু মানুষকে ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে বলে জানান তিনি।
আফজাল হক সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ সরকার যদি এখন থেকেই জোর চেষ্টা করে তবে হয়তোবা তার মেয়ে জামাইয়ের মত লাখ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী এ যাত্রায় রক্ষা পেতে পারে। তার মতে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একমাত্র মুসলিম সরকার প্রধান যিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে এবং সবার আগে ট্রাম্পকে সস্ত্রীক বাংলাদেশ সফরে আসতে ও অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন। আর এ কারণে তিনি মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী জোর চেষ্টা চালালে তার মতো লাখ লাখ ব্যক্তির পরিবার রক্ষা পাবে।
অভিবাসীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে তাদের খুবই অসহায়, হতাশ ও ভিতু মনে হয়েছে। তাদের অনেকেই বিষয়টি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে কথা বলাকেও ভয়ের কারণ বলে মনে করছেন। তবে যারা কথা বলছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে তাদেরকে খুবই উৎকণ্ঠিত বলে মনে হয়েছে। তাদের অনেকেই এ বিষয়ে সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে এখনই সরকারকে বাংলাদেশি অভিবাসীদের রক্ষায় কিছু করার জন্য অনুরোধ করেছেন। যায়যায়দিন
১৫ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি