শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৬, ০২:১৩:৪৫

প্রকৌশলী থেকে যেভাবে জঙ্গি হলেন সালাম

প্রকৌশলী থেকে যেভাবে জঙ্গি হলেন সালাম

নিউজ ডেস্ক : প্রকৌশলী থেকে জঙ্গি খাতায় নাম লেখায় গাজী কামরুস সালাম। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার বিস্ময়কর নানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বুধবার রাতে উত্তরা এবং আদাবর থেকে সালামসহ ৫ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

গতকাল কাওরান বাজারের বিসিইসি ভবনে সংবাদ সম্মেলনে তাদের নানা তথ্য জানানো হয়। র‌্যাব বলছে, গ্রেপ্তারকৃত ৫ জঙ্গি জেএমবির ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপের প্রশিক্ষক, বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ও অর্থ সমন্বয়কারী।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব-২ এর একটি দল বুধবার রাত ৮টা ১৫ মিনিটে এয়ারপোর্ট রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে কিশোরগঞ্জের মাওলানা আবদুল হাকিম ফরিদী ওরফে সুফিয়ান (৪০), মাগুরার রাজীবুল ইসলাম ওরফে রাজীব ওরফে আহমেদ (২৯)কে গ্রেপ্তার করে।

পরে তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাত সাড়ে ১২টার দিকে  আদাবরের মোহাম্মদীয়া ক্যাফে থেকে গোপালগঞ্জের গাজী কামরুস সালাম সোহান ওরফে আবু আবদুল্লাহ (২৭), ঝিনাইদহের মো. সোহেল রানা ওরফে খাদেম ওরফে মোয়াজ্জিন ওরফে সোহেল ওরফে শহীদুল্লাহ (২৩) এবং চাঁদপুরের শেখ মো. আবু সালেহ ওরফে লিটন ওরফে হুরাইয়া (৪২)কে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে র‌্যাব সদস্যরা ১টি ৯ মি.মি. পিস্তল, ২টি ম্যাগাজিন, ২০ রাউন্ড গুলি, ১০টি ককটেল, ৫টি ডেটোনেটর, ১ কয়েল তার, ১ কেজি সাদা পাউডার, ২০০ গ্রাম বারুদ, দেড় কেজি তারকাঁটা ও বল, ২টি সার্কিট বোর্ড এবং ১৫টি ক্লিপ টাইপ সার্কিট উদ্ধার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব আরো জানায়, গাজী কামরুস সালাম ওরফে সোহান ওরফে আবু আবদুল্লাহ পেশায় একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তার জন্মস্থান যশোর। সে ২০০৭ সালে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। পরে ২০০৮-২০১১ সেশনে গাজীপুরের ইসলামী ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্সে বিএসসি সম্পন্ন করে। ওই প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নের সময় একই প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত তার পূর্বের কলেজ বন্ধু সিফাতের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

সিফাত আত্‌-তামকিন নামে জঙ্গি সাইটের অ্যাডমিন ইঞ্জিনিয়ার। তার অন্য নাম মোস্তাফিজুর রহমান। সিফাত গত ৯ই আগস্ট র‌্যাব-৪ এর একটি অভিযানে আটক হয়। তার সঙ্গে আরো ৫ জন আটক হয়েছিলো। সোহান হাতেমবাগে জসীম উদ্দিন রাহমানির মসজিদে নিয়মিত যাতায়াত করতো। ওই মসজিদে একই মতাদর্শের কয়েকজনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। ২০১৩ সাল থেকে জঙ্গিবাদ তার  ভেতরে দৃঢ়ভাবে জায়গা করে নেয়। তার বন্ধু সিফাত তাকে একটি জঙ্গিবাদ মদতপুষ্ট সাইটে অন্তর্ভুক্তি করায়। ওই সাইটে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উগ্রবাদমনা সদস্যরা থাকতো।

এভাবে সিফাত তাকে জেএমবির ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করে এবং সিফাতই তাকে সারোয়ার জাহান ওরফে শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তখন সোহানকে চট্টগ্রামে ক্ষুদ্রাস্ত্র ও বোমা বানানোর প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। তবে তার মূল কাজ ছিল বিভিন্ন হামলা-নাশকতার জন্য কারিগরি সহায়তা যেমন বিস্ফোরক তৈরি ও প্রশিক্ষণ প্রদান। তার আরো একটি প্রধান দায়িত্ব ছিল বিভিন্নস্থান থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তা যোগান দেয়া।

এছাড়া, সে নিজেও জঙ্গিবাদে অর্থায়ন করতো। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে ২৮ লাখ টাকা আদান-প্রদানের তথ্য পাওয়া গেছে। মাওলানা আবদুল হাকিম ফরিদী ওরফে সুফিয়ান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদরাসা লাইনে পড়াশুনা শুরু করে। ১৯৯৭ সালে খিলগাঁওস্থ মাখাবাপুর উলুম মাদরাসায় দাওরায়ে হাদিসে (মাস্টার্স সম্মান) সম্পূর্ণ করেন। তিনি একজন ভালো বক্তা ও প্রশিক্ষক ছিলেন। তিনি জসীমউদ্দিন রাহমানিয়ার দ্বারা জঙ্গিবাদে অনুপ্রাণিত হন। তিনি একাধিক মজলিসে জসীমউদ্দিন রাহমানিয়ার সঙ্গে বক্তৃতাও করেছেন।

এক সময় তিনি আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের (এবিটি) শীর্ষ পর্যায়ে চলে যান। জসীম উদ্দিন রাহমানিয়ার অবর্তমানে সে-ই এবিটির স্থলাভিষিক্ত হয়েছিল। ওই সময় জেএমবি’র ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপে তার মতো একজন বক্তার খুব প্রয়োজন দেখা দেয়। কারণ সে সহজেই মানুষকে উগ্রবাদে আকৃষ্ট করতে পারতো। তখন শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ তাকে জেএমবি’র সারোয়ার-তামিম গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দূত পাঠায়। সেও প্রস্তাবে সাড়া দেয়। এভাবেই সে জেএমবি’র ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপের একজন আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।

তিনি কর্মীদের মটিভেট করে জিহাদের জন্য আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত করতেন। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে উপস্থিত থাকার কারণে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের ব্যক্তিদের সঙ্গে তার সখ্য ছিল। ওই পরিচয়ের সূত্রে হাবিবুর রহমান শেখ ওরফে তৌহিদ নামে এক অস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে নাশকতার কাজে ব্যবহৃত অস্ত্র ও গুলি যোগানোর ব্যবস্থা করতো। মো. সোহেল রানা ওরফে খাদেম ওরফে মোয়াজ্জিন ওরফে সোহেল ওরফে শহীদুল্লাহ জেএমবি’র ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপের মৃত আমীর সারোয়ার জাহান ওরফে শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফের বিশ্বাসী গুপ্তচর।

২০১৩ সালে জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হয়। অতঃপর সে ২০১৫ সাল থেকে সারোয়ার-তামিম জঙ্গি দলে অন্তর্ভুক্ত হয়। সে ঝিনাইদহ শহরের একটি মসজিদের মুয়াজ্জিন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তার বাসস্থান ও কর্মস্থল ছিল ধর্মীয় উগ্রবাদপন্থিদের একটি ‘সেফ হাউস’। শেখ মো. আবু সালেহ ওরফে লিটন ওরফে হুরাইরা কারাতের প্রশিক্ষক ছিল। সে জঙ্গিদের শারীরিক প্রশিক্ষণ দিতো। ২০০২ সাল থেকে মামুনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হয়। ২০০৩ সালে কারাতে শেখার জন্য কিউকুশান কলাবাগান শাখায় ভর্তি হয়। ২০০৯ সালে ব্ল্যাক বেল্ট পায়। তার সঙ্গে দলের অনেকেই কারাতে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছে। বেশ কিছুদিন সে ওই শাখার প্রশিক্ষক নিযুক্ত হয় এবং ছদ্মবেশে তার দলের অনেকেই কারাত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।

২০০৬ সালে একটি সভায় মাওলানা হাকিমের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মাওলানা হাকিম কারাতে প্রশিক্ষক হিসেবে তাকে নিয়োগ দানের সুপারিশ করে। রাজীবুল ইসলাম ওরফে রাজীব ওরফে আহমেদও একই গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। সে আধা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র চালানোর ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। সে অস্ত্র প্রশিক্ষকও। ২০০৭ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত জসীমউদ্দিন রাহমানির ঘনিষ্ঠ সহচর ছিল। ২০১৫ সালে সে মাওলানা হাকিমের মাধ্যমে জেএমবিতে যোগদান করে। র‌্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। এমজমিন
১৮ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে