সালমান তারেক শাকিল: বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ‘আমন্ত্রণে’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন ২০ দলীয় জোটের পাঁচ শরিক দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতা। দৃশ্যত জোটনেতারা বিএনপি প্রধানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেছেন, এমন বলা হলেও জোটের শরিকরা বলছেন, পুরো বিষয়টিই ছিল রহস্যজনক। রাজধানীর গুলশানে খালেদা জিয়ার সঙ্গে যে পাঁচ নেতা বৈঠক করেছেন, তাদের মধ্যে তিন জনের সঙ্গে কথা হলে, তারা উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গাণি বলেন, ‘‘গত শুক্রবার নির্বাচন কমিশন গঠনে বিএনপি প্রধান প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা বিষয়টিকেই ইতিবাচক হিসেবেই দেখেছি। বাংলাদেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য এই প্রস্তাব শুভ। আমরা তাকে অভিনন্দন জানিয়েছি।’’
বৈঠকে যাওয়া নেতারা বিব্রত: হঠাৎ করেই ২০ দলীয় জোটের পাঁচ নেতার সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকের বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে রহস্যের জাল। কেউ কেউ খুঁজেছেন আসন বন্টনের গন্ধও। ফলে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া নেতারা হয়েছেন বিব্রত। তারা পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময়ে বিষয়টি নিয়ে বিরূপ মনোভাবে আক্রান্ত হয়েছেন।
রাত সাড়ে নয়টার কিছু পরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে জোটনেতাদের বৈঠক শুরু হয়। এতে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গাণি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে অংশ নেওয়া শরিক একটি দলের প্রবীণ নেতা জানান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই ফোন করে তাদের আসতে বলেছেন। তবে তারা জানতেন না যে, কেবল পাঁচ জনকেই খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ডাকা হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির মিডিয়া উইং কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান রাত একটার দিকে বলেন, ‘‘এ বৈঠকের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। খোঁজ নিয়ে বলতে পারবো।’’
জোটের সূত্রটি জানায়, সত্যিকার অর্থেই এই বৈঠকে আমরা পাঁচ জন গিয়ে, বাকি ১৪টি দলকে শত্রু বানিয়ে দিলাম। জাগপা প্রধান শফিউল আলম প্রধানও আপসেট বলে বাকিদের কাছে মত দিয়েছেন।
জোটের আরেক শীর্ষ নেতা জানান, আমরা তো ভয় পেয়ে গেছি যে, জোট ভাঙছে কিনা । কারণ, প্রধান ছাড়া বাকি চারটি দলই জামায়াতবিরোধী হিসেবে জোটে পরিচিত। এখন জোটের বৈঠকে এ নিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কে উত্তর দেবে।
আসনবন্টন
বৈঠকসূত্র জানায়, পুরো বৈঠকটি প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট স্থায়ী ছিল। এতে সবাই আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। শুক্রবার নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে খালেদা জিয়ার প্রস্তাব, সেনাবাহিনীকে যুক্ত করার বিতর্ক, নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, সাত নভেম্বর কর্মসূচি পালনে ব্যর্থতা, ভবিষ্যৎ কর্মসূচিসহ নানা বিষয়ে কথা হয়।
জোটের শরিক একটি দলের প্রধান বলেছেন, আমরা তো আশঙ্কা করছি, ভিকটিমাইজড হয়ে যাই কিনা। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, জাগপা প্রধান শফিউল আলমও এ শঙ্কার কথা অন্য দুজন শরিক নেতার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এরমধ্যে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না, এমন একটি দলের চেয়ারম্যান জানান, কী জানি, তারা আসন বন্টন করেছেন কিনা।
শিগগিরই বিএনপি-জোটের বৈঠক
বৈঠকসূত্র জানায়, বৈঠকে ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইসি গঠনের প্রস্তাব নিয়ে কথা বলেন। তিনি জোট নেতাদের বলেন, ‘আমরাতো সব সময়ই ইসি গঠনের বিষয়ে কথা বলে এসেছি। কিন্তু কখনোই সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি দিইনি। এবার দেওয়া হলো। প্রস্তাবের বিষয়ে ইতোমধ্যে ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয়েছে। আপনারা যদি মনে করেন, এর সঙ্গে যুক্ত করবেন, তাহলে সেটাও করা যাবে।’ এসময় ফখরুল জানান, ‘আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যেই জোটের বৈঠক ডেকে এ ব্যাপারে আলোচনা করা হবে।’
সূত্র জানায়, প্রথমে জোটের নেতারা ভেবেছিলেন, শনিবার দিবাগত রাতে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্মদিনের কেক কাটা হবে। এ উপলক্ষে গুলশানের কার্যালয়ের ভেতরে-বাইরে সাজ-সজ্জা ছিল। যদিও জোটের এই নেতারা কেক কাটার অনুষ্ঠানে ছিলেন না। তারা বৈঠক শেষে বেরিয়ে আসেন।
অর্জন বা বিসর্জন কি
বৈঠকে অংশ নেওয়া জোটের একটি শরিক দলের নেতা জানান, আলোচনা ইতিবাচক হয়েছে। বৈঠকের কারও সম্পর্কে নেতিবাচক কিছুই আলোচনায় হয়নি। কিন্তু সন্দেহ তৈরি হবে এতে। এই বৈঠক অনেকটা সাধারণত জোটের বৈঠকে যা হয়, তাই হয়েছে। হাসি, ঠাট্টা, আলোচনা, খালেদা জিয়াকে প্রশংসা শুনিয়ে দেওয়া, সবই হয়েছে। শফিউল আলম প্রধান, সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ও জেবেল রহমান গাণি খালেদা জিয়ার প্রশংসা করেছেন। প্রস্তাব অনেক সুন্দর হয়েছে বলে তারা তিনজনই মুখর ছিলেন।
ফখরুলের সন্দেহ!
খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া জোটের দুই শীর্ষনেতা জানান, আমাদের মনে হয়েছে এটি হয়তো মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উৎসাহে হয়েছে। কারণ, শুক্রবারের প্রস্তাবের পর ওয়েস্টিনে ৭-৮টি শরিক দলের নেতারা প্রস্তাব নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন এই ভেবে যে, প্রস্তাবটি জোটের পক্ষ থেকেও হতে পারতো। হয়তো এই বিষয়টি ফখরুলের কানে যাওয়ায়, তিনি আমাদের ডেকেছেন। তবে এতে জামায়াত ও বিজেপি চেয়ারম্যান পার্থ না থাকায় সন্দেহের উদ্রেক ঘটেছে বেশি। এ নিয়ে উপস্থিত পাঁচ নেতার মনেও যথেষ্ট আতঙ্ক তৈরি হয়েছে বলে সূত্রের দাবি।
প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা বাড়াতে ইবরাহিমের পরামর্শ
ইসি গঠনে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবনা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে নির্দেশনা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। খালেদা জিয়াকে তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম এই প্রস্তাব নিয়ে ঘরে বসে থাকলে চলবে না। ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। মানুষের কাছে যেতে হবে। জোটের শরিকদের ডেকে বলে দিন, সবাই যেন এটা নিয়ে কাজ করে।’ সূত্রের দাবি, বৈঠকের শুরুতেই উপস্থিত নেতাদের কাছে খালেদা জিয়া প্রস্তাব কেমন হয়েছে, জানতে চান। এরপরই নেতারা তার প্রশংসা শুরু করেন।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তারেকের পক্ষে শুভেচ্ছা জানান খালেদা
রাত বারোটার পর কেক কেটে কার্যালয়ের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তিনি তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর দলীয় নেতাকর্মীদের তিনি বলেন, ‘তারেক রহমান আপনাদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করেছেন। তিনিও আপনাদের কাছে দোয়াপ্রার্থী। সবাই তার জন্য দোয়া করবেন।’
খালেদা জিয়ার মিডিয়া উইং কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান জানান, ‘রাত ১২.০১ মিনিটে কেক কেটে তারেক রহমানের জন্মদিন পালন করা হয়েছে। বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও মহিলা দলের পক্ষ থেকে পাঁচটি কেক কাটা হয়। এসময় মির্জা ফখরুল ছাড়াও স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দলের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খানের সঞ্চালনায় দোয়া করেন উলামা দলের নেসারুল হক। উল্লেখ্য, তারেক রহমান লন্ডনে অবস্থান করছেন। তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।-বাংলাট্রিবিউন
২০ নভেম্বর,২০১৬/এমটি নিউজ২৪ ডটকম/সবুজ/এসএ