মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৬, ০১:৩৫:৫০

ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে ঢাকার রোডম্যাপ

ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে ঢাকার রোডম্যাপ

মিজানুর রহমান : মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ে বাংলাদেশের জন্য ‘অস্বস্তির’ কিছু নেই বলে মনে করা হচ্ছে। চমক জাগানিয়া এ জয়ের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় করতে এখনই কাজে নামতে চায় ঢাকা।

এ নিয়ে একটি রোডম্যাপ তৈরি করা হচ্ছে। সদ্য সমাপ্ত মার্কিন নির্বাচন নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক পর্যালোচনায় এমনটাই ওঠে এসেছে। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ওই পর্যালোচনায় কিছু বিষয় অত্যন্ত খোলামেলাভাবেই আলোচনা হয়েছে। তা হলো- নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশের কিছু বিষয়ে খানিকটা রিজারভেশন ছিল।

বিশেষ করে বহুল আলোচিত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন এবং গ্রামীণ ব্যাংক প্রশ্নে। সেই তুলনায় ট্রাম্প বা তার প্রশাসনের অবস্থান হবে একেবারেই ফ্রেশ বা নতুন। ব্যবসায়ী থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়া ট্রাম্প বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ এখানকার সম্ভাবনাগুলোর বিষয়েও কমবেশি অবহিত। ঢাকা মনে করে- যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অতীতের ধারাবাহিকতা তো বটেই, ‘ফ্রেশ মাইন্ড, ফ্রেশ ডিল’ হওয়ারও একটি বাড়তি সুযোগ থাকছে।

গতকাল মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ওই পর্যালোচনা সভা হয়। সেখানে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক সভাপতিত্ব করেন। নির্বাচনের পর পরই পররাষ্ট্র সচিব যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে এসেছেন। সিনিয়র অফিসিয়াল মিটিং বা জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ওই সভায় মার্কিন নির্বাচন ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদ্য সমাপ্ত মারাকাস সফর নিয়ে আলোচনা হয়। মন্ত্রণালয়ের আমেরিকাস অনুবিভাগের মহাপরিচালক আবিদা ইসলাম ছুটিতে থাকায় ওই অনুবিভাগের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মহাপরিচালক রুহুল আলম সিদ্দিকী নির্বাচনের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন। আর প্রধানমন্ত্রীর মারাকাস সফর নিয়ে সভাকে ব্রিফ করেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক অনুবিভাগের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সকাল থেকে দুপুর অবধি চলা ওই পর্যালোচনায় মার্কিন নির্বাচনের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনকালে দেয়া বিভিন্ন বক্তৃতা ও বিতর্ক, নীতি-কৌশলের বিষয়েও কথা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বৈশ্বিক বাণিজ্য বিষয়ে ট্রাম্প কি করবেন? তার প্রচারণাকালে এর খানিক আভাস দিয়েছেন। যদিও সেই সময়ে অনেক ইস্যুতে বিতর্ক ছিল। চূড়ান্ত বিজয়ের পর ট্রাম্প তার প্রথম বক্তৃতায় বিতর্কিত অনেক ইস্যু এড়িয়ে গেছেন।

ক্যাম্পেইনকালে তিনি বলেছিলেন- জলবায়ু তহবিলে সব ধরনের মার্কিন অনুদান বন্ধ করে দেবেন! মোটা দাগে এই একটি বিষয়ে বাংলাদেশের গভীর উদ্বেগ রয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, সত্যিই যদি তিনি এটা করেন তা হলে বাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য ক্ষতির কারণ হবে। তবে ঢাকার আশা ক্যাম্পেইনে তিনি যা-ই বলেন না কেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ট্রাম্প সেই কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসবেন। ঢাকার পর্যালোচনায় ট্রাম্পের মুসলিমবিরোধী বক্তৃতার কথাও স্থান পেয়েছে। এ ইস্যুতে এখানকার কর্মকর্তারা মনে করেন ক্যাম্পেইনার ট্রাম্প আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প-এর অবস্থান এক হবে না। অভিবাসন ইস্যুতে ট্রাম্পের দেয়া বক্তৃতায় বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে তা নিয়েও সভায় কথা হয়েছে।

প্রচারণার শুরুতে অবৈধ অভিবাসীদের আমেরিকা থেকে বিতাড়িত করার কথা জোর দিয়ে বললেও পরে তিনি খানিকটা নরম সুর প্রকাশ করেছেন। ট্রাম্প অবৈধ বা অনথিভুক্ত অভিবাসীদের তাৎক্ষণিকভাবে বিতাড়িত করার পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছেন। পাশাপাশি অভিবাসন আইনকে কঠোর করার ঘোষণা দিয়েছেন। তার নিজের হিসাবে ১০ মিলিয়ন বা এক কোটি মার্কিন অভিবাসীর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই। ঢাকা মনে করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটি রাতারাতি করতে পারবেন না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সারা দুনিয়ায়। এটি হলে দেশটির অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে অস্থিরতা তৈরি হবে।

সবচেয়ে বড় কথা ভিনদেশিদের নিয়ে মার্কিনিদের ‘অসহিষ্ণু প্রবণতা’ সারা বিশ্বকে নেতিবাচক বার্তা দেবে। এই ঝুঁকি হয়তো ট্রাম্প নেবেন না। এত কিছুর পরও তিনি যদি তার অবস্থানে অনড় থাকেন, অবৈধ অভিবাসীদের সত্যিই তাড়িয়ে দেন। তাহলে সেখানে বৈধ অভিবাসীদের কর্ম সংস্থানের সুযোগ ও সম্ভাবনা বাড়বে। সেখানে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশিরা বেনিফিট নিতে পারেন। ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় বারবার বলেছেন, মেক্সিকোর সীমান্তে দেয়াল তোলার কথা। ঢাকা মনে করে দেয়াল তোলা সম্ভব না হলেও মেক্সিকো সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করতে পারেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

এতে আমেরিকার বৈধ অভিবাসীদের বেনিফিট হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ে ট্রাম্প খোলামেলা কথা বলেছেন। ডব্লিউটিও থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। টিপিপি এবং নাফটা চুক্তি নিয়েও তার রিজারভেশন রয়েছে। এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১১টি দেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ একেবারে গোড়া থেকে। ঢাকার তরফে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়াশিংটনের কাছে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশের কূটনীতিকরা মনে করে টিপিপির কারণে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ব্রুনাই, কানাডা, চিলি, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনামের মধ্যে সম্পাদিত টিপিপি চুক্তির ফলে বিশ্ববাণিজ্যের ৪০ শতাংশের নিয়ন্ত্রক এই  দেশগুলো দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিনা শুল্ক সুবিধা পাচ্ছে। এ চুক্তির ফলে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিনা শুল্কে  তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে পারছে, যেখানে বাংলাদেশকে একই পণ্যের জন্য প্রায় ১৬ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে।  

ফলে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি  পোশাকের যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি সুবিধা দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় টিপিপি বাংলাদেশের জন্য নতুন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রাম্প সেই চুক্তি থেকে সরে এলে বাংলাদেশ দেশটির বাজারে পণ্য রপ্তানিতে বাড়তি সুবিধা না পেলেও লেভেল ফিল্ডে প্রতিযোগিতা করে বেনিফিট তুলে নেয়ার সুযোগ পাবে বলে মনে করে সেগুনবাগিচা। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের কোটা ও শুল্ক মুক্ত প্রবেশাধিকারের বিষয়ে অনেক দিন ধরে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে। পরবর্তী ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গেও এ নিয়ে আলোচনা জোরদার করতে চায় ঢাকা।  

বাংলাদেশ মনে করে ট্রাম্প তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের স্লোগান ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ করার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন সেটি তিনি বাস্তবায়ন করবেন। আমেরিকাকে ‘গ্রেট’ করার দিকে তিনি মনোযোগী হলে অভ্যন্তরীণ এবং বিশ্বের জন্য নতুন কিছু কর্মসূচি নিশ্চিতভাবেই আনবেন। তিনি নতুন যা-ই আনেন না কেন তা ইতিবাচক হবে আশা করে পররাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা গতকাল বলেন, আমরা সেই কর্মসূচি থেকে সুফল পাওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবো। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প কঠোর হবেন না বলে মনে করে ঢাকা। এখানকার কর্মকর্তারা আশা করেন ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপির ওপর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করবে এবং দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের দাবি পূরণ করবে।

বাংলাদেশ যে সহনশীল, মধ্যপন্থি এবং শান্তিপ্রিয় দেশ সেটি ট্রাম্প প্রশাসন বুঝবেন এবং সেভাবেই বাংলাদেশের সঙ্গে তার আচরণ হবে। ওই কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশে সামপ্রতিক সময়ে যে জঙ্গিদের উত্থান চেষ্টা হয়েছিল তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অত্যন্ত সফলভাবে আয়ত্তে আনা সম্ভব হয়েছে। যা পৃথিবীতে বিরল ঘটনা। এটি ট্রাম্প প্রশাসনের বিবেচনায় উপস্থাপন করা হবে। এমজমিন
২২ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে