বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৬, ০২:৩৪:২৮

আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ

রফিকুল ইসলাম রনি : আগামী ২৮ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি-জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলের প্রার্থী নেই। লড়াই হবে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের মধ্যে। এই নির্বাচন নির্দলীয় হলেও আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে প্রার্থী সমর্থন দেবে। এ জন্য দলগতভাবে আবেদনপত্রও নেওয়া হয়েছে।

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ৬১ জেলায় সাতশর অধিক আবেদনপত্র আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দফতরে জমা পড়েছে। অনেকে দলের কাছে আবেদন না করলেও তারা মনোনয়নপত্র কেনার জন্য ভিড় জমাচ্ছেন জেলা শহরের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের এক হাজার নেতা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের দলীয় সমর্থন পেতে চান বিএনপি নেতারাও। এ জন্য তারা কেবল তৎপরই নন, কৌশলে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। অনেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে কেন্দ্রে আবেদনপত্রও জমা দিয়েছেন।

উড়ে এসে জুড়ে বসা সুবিধাবাদীরাও দলীয় মনোনয়ন পেতে তৎপরতা চালাচ্ছেন। এ নির্বাচনে অন্য কোনো দলের অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা কম। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতেই আওয়ামী লীগ এ অবস্থান নিয়েছে বলে জানা গেছে।

সূত্রমতে, ফরম কিনতে টাকা না লাগায় জেলা শহরে মনোনয়নপত্র উত্তোলনের হিড়িক পড়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, মনোনয়নপত্র কিনতে টাকা না লাগলেও জমা দানের সময় জামানত জমা দিতে হবে।

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার জেলা পরিষদ নির্বাচনে সাধারণ ভোটাররা ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবেন না। কেবলমাত্র স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ভোট দেবেন। আর অধিকাংশ ভোটারই ক্ষমতাসীন  দলের। এমন পরিস্থিতিতে পরাজয়ের কথা ভেবেই প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে এ ভোট অনেকটা ‘একদলীয় নির্বাচনের’ মতোই হবে। তাছাড়া দলীয় প্রতীকে ভোট না হওয়ায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি হবে।

ফলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগই। জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় সমর্থন দিতে আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় গণভবনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভা আহ্বান করা হয়েছে। আজকের বৈঠকে চূড়ান্ত হতে পারে দল সমর্থিত প্রার্থীর তালিকা। গত রবিবার জেলা পরিষদ নির্বাচনের ৬১ জেলার তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সে অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন আগামী ১ ডিসেম্বর। যাচাই-বাছাই ৩ ও ৪ ডিসেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১১ ডিসেম্বর এবং ভোট গ্রহণ হবে ২৮ ডিসেম্বর। প্রত্যেক জেলায় ১৫ জন সাধারণ ও পাঁচজন সংরক্ষিত মহিলা সদস্য থাকবেন।

ইসি জানিয়েছে, এ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। স্থানীয় সরকারের চার ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৬৭ হাজার নির্বাচিত প্রতিনিধি এ নির্বাচনে ভোট দেবেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোটার ইউনিয়ন পরিষদে। মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার সময় চেয়ারম্যান পদে ২০ হাজার, সংরক্ষিত মহিলা আসন ও সাধারণ সদস্য পদে পাঁচ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। আওয়ামী লীগ সূত্র মতে, এ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা আবেদন করেছেন।

এ ছাড়া সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাদের নামও আছে আবেদনপত্রে। এত অধিক সংখ্যক মনোনয়ন প্রার্থীর মধ্যে মনোনয়ন চূড়ান্ত করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। ফলে মনোনয়ন বঞ্চিতদের অনেকেই প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করবেন। তাছাড়া স্থানীয় রাজনীতির নানা মেরুকরণের কারণেও অনেকে প্রার্থী হবেন। এতে অধিকাংশ জেলাতেই আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হবে আওয়ামী লীগ। অনেকে এ নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কাও করছেন। ফলে প্রথমবারের মতো হতে যাওয়া এই নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করতে পারা আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

এদিকে প্রার্থী চূড়ান্ত করা নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগ। একাংশে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সামছুল আলম দুদু, সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের প্রশাসক এস এম সোলায়মান আলী। অন্যপক্ষে আছেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপিসহ জেলা কমিটির কয়েকজন সহসভাপতি ও যুগ্ম সম্পাদক। গত শুক্রবার ডাক বাংলোতে জরুরি সভায় বর্তমান জেলা পরিষদ প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম সোলায়মান আলী এবং দুই সহ-সভাপতি আকবর চৌধূরী ও অধ্যক্ষ খাজা সামছুল আলমের নাম প্রস্তাব করা হয়।

এই জরুরি সভাকে প্রত্যাখ্যান করে শনিবার সকালে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে প্রতিবাদ সভা করা হয়। সভায় বর্তমান জেলা পরিষদের প্রশাসক সোলায়মান আলীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি এবং জামায়াত-বিএনপিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়াসহ নানা স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ আনা হয়। জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, বর্তমান জেলা পরিষদ প্রশাসক দায়িত্ব পালনকালে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে অর্থ তছরুপ করেছেন। সঠিক তদন্ত করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। তিনি জামায়াত-বিএনপিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী ঠিক করতে দলীয় কার্যালয়ে না বসে ডাক বাংলোতে বৈঠক করেছেন। তার কতিপয় অনুসারীদের নিয়ে মনগড়া করা প্রার্থী ঠিক করেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের ১৪ জন সদস্য রয়েছে সোলায়মান আলীর পক্ষে। তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন ৪৮ জন। অন্যদিকে উপজেলার সভাপতি ও দলীয় মেয়র-চেয়ারম্যানরাও সোলায়মান আলীর অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

সোলায়মান আলী বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু করেছেন একজন কেন্দ্রীয় নেতা। জেলা পরিষদে নয়, যে কোনো সরকারি কাজে কাজ না করে বিল উঠানো যায় না। চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, ন্যূনতম দুর্নীতির প্রমাণ দিতে পারবে না। তিনি বলেন, ডাক বাংলোয় নয়, দলীয় অফিসে বৈঠক করতে না দেওয়ায় টাউন হলে সভা করেছি। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটা স্থানীয় রাজনীতি। জেলা পরিষদের প্রশাসকের সঙ্গে স্থানীয় নেতাদের দ্বন্দ্ব। আমি জেলার রাজনীতি নিয়ে হস্তক্ষেপ করি না। তার সঙ্গে জেলার নেতা ও ভোটাররা নেই জেনে আমার নামে অভিযোগ করছেন। এসব অভিযোগ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক।

সিরাজগঞ্জে বর্তমান প্রশাসক আবদুল লতিফ বিশ্বাস নির্বাচন করবেন না বলে জানিয়েছেন। এখানে দলের সমর্থন প্রত্যাশা করছেন জেলা সহসভাপতি অ্যাডভোকেট কে এম হোসেন আলী হাসান, আবু ইউসুফ সূর্য ও কার্যনির্বাহী সদস্য জান্নাত আরা হেনরী। এই জেলায় কোনো একজন দলীয় সমর্থন না পেলে অন্যদেরও মাঠে দেখা যেতে পারে। নাটোর জেলায় চেয়ারম্যান পদে সমর্থন লাভের আশায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের অন্তত ১৭ জন প্রার্থী কেন্দ্রে দৌড়ঝাঁপ করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন— সাজেদুর রহমান খান, সিরাজুল ইসলাম, শামসুল ইসলাম, শাহ্জাহান কবীর, আজিজুল ইসলাম শেখ আরজু, নাসিমা বানু লেখা, কামরুল ইসলাম, মাজেদুর রহমান চাঁদ, সৈয়দ মুর্তজা আলী বাবলু, মালেক শেখ, চিত্তরঞ্জন সাহা, ইউনুছ আলী, রত্না আহমেদ, সুশান্ত কুমার ঘোষ, আতাউর রহমান, আলেক শেখ ও আরজু শেখ। তবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে সাড়া নেই বিএনপি ও জাতীয় পার্টিতে। মাদারীপুরে নৌকার সমর্থন পেতে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা শুরু করেছেন লবিং। তারা প্রচারণাও চালিয়ে যাচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন— মিয়াজ উদ্দিন খান, সাহাবুদ্দিন মোল্লা, কাজল কৃষ্ণ দে, মুনির চৌধুরী, জাহাঙ্গীর কবির, এ বি এম বজলুর রহমান মন্টু খান, সিরাজ ফরাজী ও আকবর হোসেন হাওলাদার। তবে সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে বিএনপি। তাদের প্রার্থীদের নির্বাচন নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই। মাঠে নেই বাকি দলগুলোর কোনো প্রার্থী। মেহেরপুরে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেতে ১৮ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন কেন্দ্রে। তবে পাঁচজন এগিয়ে আছেন মনোনয়ন দৌড়ে।

এরা হলেন— মিয়াজান আলী, এম এ খালেক, ইব্রাহিম শাহিন, ইয়ারুল ইসলাম ও আবদুস সালাম। ১৮ জনের তালিকায় অন্যরা হলেন, এম এ এস ইমন, আশরাফুল ইসলাম, আবদুল হালিম, আবদুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস, আহমেদ আলী, গোলাম রসুল, জিয়া উদ্দিন বিশ্বাস, আমাম হোসেন মিলু, সহিদুজ্জামান খোকন, অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম, আবদুল মান্নান, শামীম আরা হীরা ও কামরুল হাসান চাঁদু। লালমনিরহাটে দুই প্রভাবশালী নেতা দলের উচ্চপর্যায়ে জোর লবিং করছেন। এরা হলেন— মতিয়ার রহমান এবং সিরাজুল হক।

জেলা আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে স্থানীয় চার এমপি একটি যৌথ ডিও লেটার দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠিয়েছেন। তারা মতিয়ার রহমানকে মনোনয়ন দিতে অনুরোধ করছেন। তবে অপর সম্ভাব্য প্রার্থী সিরাজুল হকও ফেসবুকে প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি কেন্দ্রে তদবির চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। গোপালগঞ্জে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হিসেবে বেশি আলোচনা হচ্ছে— মুক্তিযোদ্ধা চৌধুরী এমদাদুল হক, হাসমত আলী সিকদার চুন্নু, শেখ মো. ইউসুফ আলী, সোলায়মান বিশ্বাস, এম বদরুল আলম বদর, বিমল বিশ্বাস, মুক্তিযোদ্ধা ইসমত কাদির গামা প্রমুখকে নিয়ে।

তবে এদের কেউই এখনো মুখ খুলছেন না। কারণ সবাই দলীয় সমর্থন আদায়ে কেন্দ্রে লবিং চালাচ্ছেন। গোপালগঞ্জে বিএনপি-জামায়াত বা আওয়ামী লীগের শরিক দলের কোনো প্রার্থীর নাম এখনো শোনা যায়নি। মানিকগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর তালিকায় আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী রয়েছেন। নৌকার সমর্থন লাভের আশায় আছেন গোলাম মহীউদ্দীন, দেওয়ান সফিউল আরেফিন টুটুল, মো. রমজান আলী। এ ছাড়া গণফোরামের কেন্দ্রীয় নেতা মুক্তিযোদ্ধা মফিজুল ইসলাম খান কামাল, জেলা কমিউনিটি পুলিশের সাবেক সভাপতি লিয়াকত আলী খান লাবনও গণসংযোগ করে চলেছেন।

চুয়াডাঙ্গায় আওয়ামী লীগের ছয় নেতা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রে আবেদন করেছেন। তারা হলেন— মাহফুজুর রহমান মঞ্জু, আজাদুল ইসলাম আজাদ, হাবিল হোসেন জোয়ার্দার, ডা. মাহবুব হোসেন মেহেদী, শামসুল আবেদীন খোকন ও শহিদুল ইসলাম। ময়মনসিংহের ভালুকায় রাজাকারপুত্র আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত আবুল কালাম আজাদকে ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী করায় সংবাদ সম্মেলন করে তাকে সমর্থন না দিতে আবেদন জানিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগ। বিডি প্রতিদিন
২৪ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে