বুধবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৬, ০২:৪২:১৬

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেবেন না

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেবেন না

নূরে আলম সিদ্দিকী : মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সেখানকার সেনাবাহিনী যে বর্বরোচিত ও অমানবিক গণহত্যা চালাচ্ছে তা এতটাই পাশবিক যে, তাকে কেবল নান্সি হিটলারের ইহুদি হত্যা ও বাংলাদেশে ’৭১-এর ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও ব্যভিচারের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।

দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম এমনকি সিএনএন, বিবিসিতে সেখানে সেনাবাহিনীর বর্বরতার যে চিত্র উঠে এসেছে তা দেখে মুসলমান তো বটেই, যে কোনো মানবতাবাদী মানুষের হূদয়ে রক্তক্ষরণ হওয়ার কথা। কিন্তু ব্যথিতচিত্তে, বেদনাহত হূদয়ে অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করছি যে, জাতিসংঘ এবং বিশ্বের মানবতাবাদী সংগঠনগুলোকে এ বর্বরতা বন্ধ করার জন্য কার্যকরী কোনো উদ্যোগ বা বলিষ্ঠ কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।

বড়ই পরিতাপের বিষয়, আমাদের এ বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ও যাদের স্বজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, যাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করা হয়েছে, তারা বিপদাপন্ন, আশ্রয়হীন, নির্যাতিত হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্ষরস্রোতা নাফ নদ পেরিয়ে নৌকায় চড়ে টেকনাফ থেকে কক্সবাজারের দিকে আশ্রয় নিতে চাইলে তাদেরকে শুধু ফিরিয়েই দেওয়া হচ্ছে না, তাদের নৌকা বাংলাদেশের সীমান্তে ভিড়তে না দেওয়ার জন্য কোস্টগার্ড ও বিজিবিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাজপাখির মতো তাদের তীক্ষ নজর রাখার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সরকার (!) কি বেমালুম বিস্মৃত হয়েছে যে, ’৭১-এর ২৫ মার্চের পর ১ কোটি বাঙালি ভারতীয় শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল? বিভিন্ন স্থানে শরণার্থী ক্যাম্প করে নির্দিষ্ট এলাকায় তাদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত তো ভারতবর্ষে ছিল। অবশ্য তখন ক্ষমতায় ছিল ভারতের স্বাধীনতার আবিরমাখা কংগ্রেস। নেত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তখন নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় থাকলে বর্ডার সিল করে তো দিতেনই, বিএসএফের প্রতি নির্দেশনা আসত শরণার্থীদের দেখামাত্রই গুলি করার। সীমান্ত এলাকায় কারফিউ জারি করা হতো।

সমুদ্র পেরিয়ে জীবন রক্ষার তাগিদে যারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার জন্য আসছেন, তাদের তাড়িয়ে না দিয়ে একটা নির্দিষ্ট এলাকায় আশ্রয় প্রদান করে সরকার জাতিসংঘ এবং বিশ্বমানবতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে মিয়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের দাবিটি উচ্চকিত কণ্ঠে তুলে ধরতে পারত। তা না করায় বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর ১৭৬ কোটি মুসলমানের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ।

৯২ ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেকখানি ক্ষুণ্ন। মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়াসহ বহু মুসলিম দেশে মিয়ানমারের বর্বরতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ উঠেছে এবং সু চি’র শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারেরও দাবি উঠেছে। মিয়ানমারের শাসনতন্ত্রে বাধানিষেধের কারণে সু চি যদিও রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান হতে পারেননি; তার দলই ক্ষমতাসীন এবং তিনি পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসীন তো বটেই, দণ্ডমুণ্ডের কর্ত্রী।

শান্তির দেশ, সম্প্রীতির দেশ, ধর্মনিরপেক্ষতার বিরল দৃষ্টান্তের দেশ বাংলাদেশে সরকারের দলীয় কোন্দলের জেরে নাসিরনগরের মতো দুঃখজনক ও অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছে। আক্রমণটি মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাইবোনদের ওপরে ঘটলেও ঘটনাটি একমাত্র রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্য থেকে ঘটানো হয়েছে। এতদিনে ঘটনার মূল খলনায়কদের অন্তত গ্রেফতার করে বিচার শুরু করলে সরকারের ভাবমূর্তি প্রোজ্জ্বল হতো। সব ঘটনার প্রকৃত রহস্য আবিষ্কৃত হওয়ার পরও কেন যে শেখ হাসিনা ত্বরিত ও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন না সেটিই বোধগম্য নয়।

নাসিরনগরের ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক হামলা হিসেবে দেখানো হলেও এক ধরনের বিবেকবর্জিত বুদ্ধিজীবীরা এ রাজনৈতিক কুচক্রীদের বীভৎস চেহারা উন্মোচিত না করে রাজনৈতিক পৈশাচিক শক্তিকে বরং আড়াল করে একতরফা আক্রমণটিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসেবে প্রদর্শন করেছেন। তারা মানববন্ধন করেছেন, নির্লজ্জের মতো উচ্চকিত কণ্ঠে স্লোগান দিয়েছেন। তাদের গায়ে ছিল অসাম্প্রদায়িকতার নামাবলি; উদ্দেশ্য ছিল খলনায়কদের কুকীর্তি আড়াল করা।

বিবেক-বিবর্জিত তথাকথিত এক ধরনের বুদ্ধিজীবী যারা কথায় কথায় মানববন্ধন করেন, মানবতার সপক্ষে মেকী মানসিকতা নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য সক্রিয় হন। তারাও তো মিয়ানমারের এ বর্বরতার বিরুদ্ধে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন।

আমি শুধু মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্তই ছিলাম না, বঙ্গবন্ধুর চেতনা, বিশ্বাস, আদর্শ ও মননশীলতার উত্তরাধিকার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী ছিলাম। তাই জোট সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার কাছে আমার প্রত্যয়দৃঢ় দাবি, মিয়ানমারের সু চি সরকারের বর্বরোচিত মুসলিম নিধনের তীব্র বিরোধিতা তো করবেনই, বরং এক্ষেত্রে তার কণ্ঠই হবে সবচেয়ে উচ্চকিত, প্রত্যয়দৃপ্ত ও ফলপ্রসূ।

কোস্টগার্ড ও বিজিবি দিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের একটি নির্দিষ্ট স্থানে বিশেষ তত্ত্বাবধানে রাখুন। পরিস্থিতির উন্নতি হলে তাদের সমস্যার নিশ্চয়ই একটি সম্মানজনক সমাধান হবে। এবং মুসলিম বিশ্বে শেখ হাসিনা ভিন্নমাত্রায় অবস্থান পাবেন।  স্তাবক, মোসাহেব, চাটুকার ও ভ্রান্ত বামদের দ্বারা পরিবেষ্টিত শেখ হাসিনা মানবতার এ কান্নায় সাড়া দেবেন বলেই আমার বদ্ধমূল প্রত্যাশা।

ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে এটা সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের আবিরমাখানো বাংলাদেশ। গোলাপ, চামেলি, বকুল, রজনীগন্ধার উদ্বেলিত হূদয়ের বাংলাদেশ।  পদ্মা-মেঘনা-যমুনার কূলে কূলে, বাঁকে বাঁকে ভ্রাতৃত্বের আলিঙ্গনে আবদ্ধ আমাদের এ বাংলাদেশ মিয়ানমারের এ নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার নিশ্চুপ দর্শক হতে পারে না। বিডি প্রতিদিন

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

৩০ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে