শনিবার, ০৩ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০৬:১২

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাবে চিরচেনা এই ঢাকা

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাবে চিরচেনা এই ঢাকা

এম. মিজানুর রহমান সোহেল : বিশ্বের বড় বড় কংক্রিটের শহরগুলো তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সহজলভ্যতা, পরিষ্কার রাস্তাঘাট ও সবুজ পরিবেশ, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, শহর ব্যবস্থাপনা, বস্তিবাসীদের জন্য সুষ্ঠু ও উন্নত জীবনব্যবস্থা, ট্রাফিক ও গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা, নারীদের জন্য নিরাপদ জীবনধারা, সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং শিশুদের বেড়ে ওঠার জন্য সুন্দর ও নির্মল শহর গড়ে উঠছে প্রযুক্তির ব্যবহারে। এমন বদলের ছোঁয়া লাগতে যাচ্ছে ঢাকায়ও।

তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে নগরের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় গ্রামীণফোন ও হোয়াইটবোর্ডের সঙ্গে মিলে ‘স্মার্ট সিটি হ্যাকাথন’ নামে এক অ্যাপস প্রতিযোগিতার আয়োজন করে প্রেনিউরল্যাব। চার শতাধিক দলের মধ্য থেকে বাছাইকৃত ৩০টি দল মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। শহরের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধানের অ্যাপস প্রতিযোগিতায় সূক্ষ্ম বিচারের বিবেচনায় সেরা হয়েছে দূরবীনের ‘ইএম বক্স’।

টিম স্পার্ক তাদের ‘সিকিউরইউ’ এবং ‘ফ্লেক্স’ নিজেদের সামাজিক বাইক ধারণা নিয়ে সেরাদের কাতারে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। হ্যাকাথনের উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা শহরের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার প্রযুক্তিগত সমাধান। আয়োজকরা বলছেন, এই তিন সেরা উদ্ভাবন নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে নগরের অনেক সমস্যার সমাধান হবে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পরিবর্তন আসবে ঢাকার নাগরিক জীবনে।

বিপদের বন্ধু ‘ইএম বক্স’
বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির আর্তনাদ বুঝতে সক্ষম সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার সমন্বিত একটি সলিউশন ‘ইএম বক্স’ উদ্ভাবন করেছেন ‘দুরবীন’। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী শায়লা সিদ্দিক ও মায়েশা লুবাবাকে নিয়ে এই সার্ভিলেন্স সিকিউরিটি সিস্টেমটি উদ্ভাবন করেছেন বসুন্ধরা গ্রুপের সফটওয়্যার প্রকৌশলী ও দুরবীনের প্রধান নির্বাহী ওয়াহেদুজ্জামান।

উদ্ভাবকরা জানিয়েছেন, ভূমিকম্প বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভবন ধসে পড়লে অনেক মানুষ ভেতরে চাপা পড়ে। তাদের উদ্ধারে বেশিরভাগ সময় নির্দিষ্ট করে ওই ভুক্তভোগীর অবস্থান চিহ্নিত করতে না পারায় উদ্ধার কাজে ব্যাঘাত ঘটে। তাদের উদ্ভাবিত ‘ইএম বক্স’ যন্ত্রটির ২০ ফুট জায়গার মধ্যে কেউ যদি ‘বাঁচাও’ অথবা ‘হেল্প’ শব্দটি উচ্চারণ করে, তাহলে তা পৌঁছে দেবে উদ্ধার কর্মী এবং তাদের স্বজনদের কাছে। এ ছাড়া বাসায় অবস্থানরত বৃদ্ধ বাবা-মা কিংবা শারীরিক প্রতিবন্ধীদের বিপদগ্রস্ত অবস্থার খবর পাওয়া যাবে।

দুর্ঘটনায় আটকেপড়াদের শনাক্ত ও উদ্ধার করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির সঠিক অবস্থান নির্দিষ্ট করতে সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যারের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে একটি সার্ভিল্যান্স সিকিউরিটি সিস্টেম ইমার্জেন্সি বক্স বা ইএম বক্স। ওয়াফাই রাউটারের মতো নিজস্ব নেটওয়ার্কে এটি কাজ করবে। আরডুইনো ও বিভিন্ন ট্রান্সফরমারের সমন্বয়ে তৈরি অ্যামবেডেড প্রযুক্তিনির্ভর এই ডিভাইসটি বৈদ্যুতিক সংযোগ ছাড়াও সাত দিন পর্যন্ত ব্যাটারি ব্যাকআপে সচল থাকবে। আকারে ছোট এই ডিভাইস আগে থেকেই ভবনে লাগানো থাকতে হবে। অ্যাপটি ইনস্টল করা থাকলে দুর্ঘটনাকবলিত বাড়ির কাছে এলেই উদ্ধারকর্মীরা জানতে পারবেন আটকেপড়া ব্যক্তির অবস্থান।

শুধু অবস্থান জানান দেয়া নয়, এটি আরও কয়েকটি প্রক্রিয়ায় কাজ করে থাকে। জরুরি অবস্থার পাশাপাশি এটি স্মার্ট সিটির ধারণা বাস্তবায়নেও কাজ করতে পারবে। প্রযুক্তিটি কাজে লাগিয়ে বাসাবাড়ি কিংবা অফিসের দৈনন্দিন কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা যাবে।

নিরাপত্তাবিষয়ক ধারণা ‘সিকিউরইউ’
সিসিটিভির বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা দূর করতে স্মার্টসিটি হ্যাকাথনে উদ্ভাবনী নিরাপত্তা প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তরুণ উদ্যোক্তা ফাতিন হাসনাত চৌধুরী। তার সঙ্গে ছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও যন্ত্র প্রকৌশল (ইইই) অনুষদের সহপাঠী বায়েজিদ শুভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রকৌশল বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী সাদ আহমেদ আকাশ ও রাকিব আহসান। টিম স্পার্কের ধারণাটি হল নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নয়ন।

জানা গেছে, উদ্ভাবিত সিস্টেমটি কাজ করবে একটি রাডার ভিশনের মাধ্যমে। রাস্তায় বা কোনো বাসায় সিসিটিভি ক্যামেরা আছে, কিন্তু অন্ধকারে সেটি ঠিকমতো না করায় অপরাধী অপরাধ ঘটিয়ে নিরাপদেই স্থান ত্যাগ করতে পারে। কখন কতটা দূরত্বে ঘটনাটা ঘটেছে, ‘সিকিউরইউ’ তা শনাক্ত করতে পারবে। এমনকি এই রাডারের মাধ্যমে বলে দেয়া সম্ভব হবে, ওই অপরাধী কোন দিকে গেছে এবং কোন দিক দিয়ে ঘটনাস্থলে এসেছে। জিপিএস সুবিধা থাকায় ম্যাপ দেখে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার স্থান ও অপরাধীর অবস্থান শনাক্ত করা যাবে। এ ক্ষেত্রে কাজে আসবে রাডার প্রযুক্তি। ম্যাপ ও নির্দিষ্ট কিছু সিগন্যালেই শনাক্ত করা যাবে অপরাধীকে। ইন্টারনাল এবং এক্সটারনাল সিকিউরিটি সিস্টেমে রাডার প্রযুক্তিটি কাজ করবে।

সামাজিক বাইক ‘অ্যাপ ফ্লেক্স’
স্বাস্থ্য সচেতন কর্পোরেট কর্মী এবং শিক্ষার্থীদের জন্য নগরবান্ধব সমাধানের ধারণা দিয়েছে এবারের স্মার্ট সিটি হ্যাকাথনে তৃতীয় সেরা অ্যাপ ফ্লেক্স। ৫০ টাকা ঘণ্টায় বাইসাইকেল ভাড়া দেয়ার এই মোবাইল ফোন অ্যাপভিত্তিক প্রকল্পটি নগরীর যানজট কমাতে অবদান রাখবে। দৈনন্দিন ব্যস্ত জীবনে শারীরিক ব্যায়ামের অভাব, দিনভর যানজট ও সুস্থ বিনোদনের অভাব থেকেই যায় ঢাকার জীবনে। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে অলস সময়ে নিজের বাইসাইকেলটিও ভাড়া দিতে পারবেন যে কেউ।

আবার যারা চালাবেন তাদের জন্য মিটার বোর্ডে ওঠা দূরত্বের ভিত্তিতে কুপনের মাধ্যমে উপহারও রাখা হয়েছে। অ্যাপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে পুরো প্রক্রিয়াটি। অফিসের কাজের ফাঁকে উদ্ভাবনের নেশায় বাইক ফ্লেক্স নামে এই অ্যাপভিত্তিক বাইক শেয়ারিং সেবাটির উদ্ভাবক শাশ্বত সিয়াম, সিকান্দার বাদশা, ইমরান চৌধুরী ও রাব্বি হোসেন। দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন শাশ্বত।

তিনি জানান, ধানমণ্ডি থেকে বনানী ও গুলশান রুটে আগামী বছরের জানুয়ারি মাস নাগাদ এই সেবা চালু করতে যাচ্ছেন তারা। এ জন্য এই তিন পয়েন্টে ডকিং স্টেশন বা সাইকেল স্টেশন থাকবে। গন্তব্যে পৌঁছে বা কাজ শেষে তারা আবার অ্যাপ ফ্লেক্সের যে কোনো স্টেশনে সাইকেলটি জমা দিতে পারবে। এ ছাড়া টাকা পরিশোধও অ্যাপের মাধ্যমে করা যাবে। প্রাথমিকভাবে ১৫টি সাইকেল নিয়ে ৩ মাসের পাইলট প্রকল্প নিয়ে রাস্তায় নামতে যাচ্ছেন তারা।

স্মার্ট সিটি হ্যাকাথনের উল্লেখিত তিন সেরা উদ্ভাবন এখন নাগরিক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। রাজধানী ঢাকাকে স্মার্ট সিটিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে আগামী ছয় মাসের মধ্যে উদ্ভাবনী ধারণাগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করার পাশাপাশি নিরলসভাবে কাজ করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। -যুগান্তর।
০৩ ডিসেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে