নিউজ ডেস্ক : সেনা সদর দপ্তর থেকে পাঠানো পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল খুলনা ও চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ। এ বন্দর দুটিকে বাংলাদেশে ঢোকার প্রবেশ পথ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড ভিন্ন পরিকল্পনা নেয়। আমরা উপলব্ধি করছিলাম বাংলাদেশের ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ঢাকা। তাই যেকোনো সামরিক তৎপরতা সফল করতে আগে ঢাকা দখল করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসব কথা বলেছিলেন ১৯৭১ সালে লেফটেনেন্ট জেনারেল থেকে মেজর জেনারেলে পদোন্নোতি লাভ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ জে এফ আর জ্যাকব। ল্যাফটেনেন্ট জেনারেল পদ হতে অবসরগ্রহণকারী জেনারেল জ্যাকব ১৯৭১ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি বলেন, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড নিজস্ব পরিকল্পনা অনুসারেই রণাঙ্গনে অগ্রসর হয় যদিও ভারতীয় সেনা সদরদপ্তর ভাবছিল পরিকল্পনাটি উচ্চাভিলাষী ও বাস্তবায়নযোগ্য নয়। পরে জেনারেল অরোরাকে পূর্ন সমর্থন দেই। এমনকি চীনের হামলা মোকাবেলায় প্রস্তুত রিজার্ভ বাহিনীকেও মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত করার অনুমতি দেই। ওই বাহিনীর একটি অংশকে দ্রুত রনাঙ্গনে পাঠানোর জন্য ‘প্যারাড্রপে’র কোনো বিকল্প ছিল না সেসময়।
জ্যাকবের ভাষায়, ‘আমরা বুঝতে পারছিলাম সফলতা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে আক্রমণ করা। জাতিসংঘ আমাদের ওপর চাপ দিয়ে যাচ্ছিল যুদ্ধ বিরতির জন্য, রাশিয়াও এমন ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে, তারা আর ‘ভিটো’ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চায় না।’
‘আমরা জানতে পেরেছিলাম নিয়াজী শহরগুলোতে ঘাঁটি গড়ে তুলে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছিল। তাই আমরা শহরগুলোকে পাশ কাটিয়ে মূল লক্ষ্য ঢাকার দিকে এগোতে থাকি। যুদ্ধে জিততে হলে ঢাকার দখল পেতেই হবে এটা আমরা বুঝেছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানে ভূ-কৌশলগত দিক থেকে ঢাকাই মূল কেন্দ্র। কাজেই এর দখল নেওয়া ছাড়া কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বা যুদ্ধ জয় সম্ভব না।’
উল্লেখ্য, লে. জেনারেল জ্যাকবের পূর্ব-পুরুষেরা ১৮শতকে বাগদাদ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। তারা মূলত ছিলেন ইহুদি ধর্মের অনুসারী।"জ্যাকবের পিতা ইলিয়াস ইমানুয়েল ছিলেন একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। শৈশবে যখন জ্যাকবের পিতা অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন, ৯ বছর বয়সে তাকে দার্জিলিংয়ের সন্নিকটে কাশিয়াংয়ে ভিক্টোরিয়া বোডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তখন থেকে তার পরিবারের সাথে একটি দুরত্বের সৃষ্টি হয়।
তিনি কেবল বন্ধের দিনগুলোতেই পরিবারের সাথে দেখা করতে যেতেন। জ্যাকব ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে হলোকস্ট ( দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের উপর চালানো গণহত্যা)র নির্মমতা থেকে অনুপ্রাণীত হন এবং ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনী তে যোগদান করেন। তার পিতা তাকে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ক্ষেত্রে আপত্তি জানান কিন্তু তাও তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ২০১২ সালে এক বক্তব্যে তিনি বলেন, "আমি গর্বিত আমি ইহুদি, তার থেকেও বেশি ও অনেক বেশি গর্বিত যে আমি ভারতীয়।
১৯২৩ সালে জন্ম নেওয়া লে. জেনারেল জ্যাকব নতুন দিল্লির সেনা গবেষণা ও রেফারেল হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন ২০১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের জন্য তিনি প্রশংসাসূচক অনেক সম্মান লাভ করেছেন।
৩৭ বছর সেবা দেয়ার পর ১৯৭৮ সালে সামরিকবাহিনী থেকে অবসর নেন। ভারত রক্ষক ওয়েবসাইটে জ্যাকব বারংবার উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ যুদ্ধে কেবলমাত্র তার নিজ চেষ্টার মাধ্যমে সফলতা পেয়েছেন। এতে, মানেকশ’ অথবা পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের লেঃ জেঃ জগজিৎ সিং অরোরা’র কৃতিত্ব ছিল না। ব্যবসায় জগতে প্রবেশের পর ১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দেন। দলে তিনি অনেক বছর নিরাপত্তা পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেন। গোয়া রাজ্যের গভর্নর হন ও পরবর্তীকালে পাঞ্জাবের গভর্নন হন।
১৬ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস