শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:৪৪:৫৬

মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও রোহিঙ্গাদের স্বাধীন রাষ্ট্র দিন

মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও রোহিঙ্গাদের স্বাধীন রাষ্ট্র দিন

আন্দ্রেজ কর : আমেরিকার বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনে ২৮শে ডিসেম্বর প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শিরোনাম: ‘মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং রোহিঙ্গাদের নিজস্ব রাষ্ট্র দিন’। নিরাপত্তা বিশ্লেষক আন্দ্রেজ কর এর লেখক। মি. আন্দ্রেজ সামরিক গোয়েন্দা শাখায় কাজ করেছেন পাঁচ বছর।

পারমাণবিক, অস্ত্র, সন্ত্রাস, সাইবার, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাস দমনে বিশেষজ্ঞ। নিজের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, আমি এই কাজে এশিয়া ও ইউরোপ সফর করেছি। দেড় বছর কাজ করেছি আফগানিস্তানে। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকার বিষয়ে পিএইচডি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমি দক্ষিণ চীন সাগরে সংঘাত নিয়ে একটি ধারাবাহিক রচনা সম্পাদনা করছি। আর এ জন্য সফর করেছি আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও লাতিন আমেরিকা।

তার নিবন্ধটির অবিকল তরজমা নিচে তুলে ধরা হয়েছে: আধুনিক মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যটি অষ্টম শতাব্দীতে কিংডম অব আরাকানের অন্তর্গত ছিল। সেখানে বাস করতেন রোহিঙ্গারা। কিন্তু ১৭৮৪, ১৯৪২, ১৯৭৭, ১৯৯১, ২০১২ এবং ২০১৪ সালে বিভিন্ন বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মি সরকারগুলোর চরম নির্যাতনের কারণে মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা রাখাইন থেকে পালিয়েছে। বিশ্বে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন ১৫ লাখ। আর মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রয়েছে ১৩ লাখ। সুতরাং রোহিঙ্গারা নিজের দেশ থেকে প্রবাসী রোহিঙ্গাদের সংখ্যাধিক্য ঘটেছে।

বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা তিন থেকে পাঁচ লাখ হবে। তারা দেশটির বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে। অব্যাহত নিপীড়ন এবং প্রতিনিধিত্বহীন অবস্থায় দিনাতিপাত করতে বাধ্য হওয়ার কারণে তাদের এখন মিয়ানমার অঞ্চলে রাখাইনদের একটি নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের অধিকার জন্মেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখন নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে রোহিঙ্গাদের সমর্থন দেয়া।

এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে মিয়ানমারকে চাপ দেয়া। যদি মিয়ানমার সরকার এই ধারণা অপছন্দ করেন এবং রাখাইন রাজ্যকে নিজের সঙ্গে একীভূত রাখতে সংকল্পবদ্ধ থাকেন, তাহলে তাকে দ্রুততার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের বিষয়ে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন আনতে হবে। এবং রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে হবে।

একটি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুরা তাদের নিজস্ব সরকার দ্বারাই আক্রান্ত অবস্থায় রয়েছে। মিয়ানমারের মিলিটারি এই অবস্থাটিকে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। একজন ঊর্ধ্বতন জাতিসংঘ কর্র্মকর্তা বলেছেন, গত তিন মাসে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এথনিক ক্লিনজিং বা জাতিগত নির্মূল অভিযান পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে।

মিয়ানমার বর্তমানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী অবস্থান গ্রহণে আচ্ছন্ন রয়েছে। এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে কোনো অর্থনৈতিক সুবিধা পেয়ে থাকতে পারে। এটা তাদের পক্ষেই সম্ভব, বেশির ভাগ পেশাদার সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে এমনটা ধারণাই করা যায় না। সামরিক বাহিনী ব্যক্তিগতভাবে কৃষি সংক্রান্ত ব্যবসা-বাণিজ্য করতে কৃষকদের কাছ থেকে ভূমি কেড়ে নিয়ে তা ব্যবহার করছে।

গত কয়েক মাস ধরে এরকম ব্যাপক সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তার নিরস্ত্র সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস চালাচ্ছে। তারা যা ঘটিয়ে চলেছে তাকে আমি বলবো, ‘ক্যাম্পেইন অব টেরর’। অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত রোহিঙ্গারা যারা তাদের পূর্বপুরুষদের মৎস্য শিকারের জায়গাগুলোতে মৎস্য আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, এখন তাদেরকে সে সব পরিত্যাগ করে মিয়ানমার ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে।

হত্যা ও নারীদের সম্ভ্রমহানীর মতো বিভীষিকা তাদের জীবনে চেপে বসেছে। ২০১২ সালে রোহিঙ্গা মুসলিম এবং মিয়ানমারের বৌদ্ধদের মধ্যেকার সংঘাতে একলাখ পঁচিশ হাজার মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটেছিল। কিছু লোক অভিযোগ করছেন যে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছে, কিংবা মুসলিমবিরোধী অভিযানে অংশ নিচ্ছে।

সামরিক বাহিনী এ পর্যন্ত ১২শ’ বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, এবং দেড় লাখ রোহিঙ্গাকে একজন টাইম ম্যাগাজিনের সংবাদদাতার ভাষায়, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বাস করতে বাধ্য করেছে। গত নির্বাচনে হাজার হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ভোটদান থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করেছে। এ ধরনের পৌনঃপৌনিক এবং সাম্প্রতিক নিষ্ঠুরতা ২০১২ থেকে অতিরিক্ত ২৫ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ায় পালাতে বাধ্য করেছে।

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের নতুন কৌশল হচ্ছে তাদের ক্যাম্পে রাখা। এ ক্যাম্পগুলোর পাশেই রয়েছে সরকারের চেকপয়েন্টস। বাসিন্দাদেরকে ক্যাম্পের বাইরে যেতে হলে, সরকারের কাছ থেকে বাধ্যতামূলক অনুমতি নিতে হয়। সামরিক বাহিনী ঐ ক্যাম্পগুলোতে অধিকাংশ ত্রাণকর্মীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। সেখানে সাংবাদিকদেরও প্রবেশ অধিকার নেই। খাদ্য এবং স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল। এবং সহজে প্রতিকারযোগ্য অসুস্থতার কারণেও রোহিঙ্গারা মারা যাচ্ছে।

তারা ব্যাপকভাবে অপুষ্টির শিকার। তাদেরকে এখন যেভাবে ক্যাম্পে রাখা হয়েছে, সেটা ১৯৬০-এর দশকে ভিয়েতনাম যেভাবে কৌশলগত হ্যামলেট স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছিল, সেইরকম ব্যর্থ ও নিষ্ঠুর পদক্ষেপকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

রোহিঙ্গাদের পুনরায় পালিয়ে যাওয়ার আরেকটি পর্ব তৈরি করা হবে মিয়ানমারের জন্য অবিবেকপ্রসূত। মিয়ানমার অতীতে বিভিন্ন উপলক্ষে লিখিতভাবে সম্মতি দিয়েছে যে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বাসিন্দা। এসব চুক্তিগুলোর কারণে মিয়ানমার এখন সেইসব দেশের শ্রেণিভুক্ত হয়েছে, যারা আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি লঙ্ঘন করে থাকে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মিয়ানমারের এসব কর্মকাণ্ডকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। টাইম ম্যাগাজিনের একজন লেখকের কথায়, মিয়ানমার এখন যা ঘটাচ্ছে তা হলো ‘জেনোসাইডাল টেরর’ বা গণহত্যাজনিত সন্ত্রাস।

মিয়ানমারের সরকারকে অবশ্য অনতিবিলম্বে রাখাইন রাজ্যে তার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারা বন্ধ করতে হবে। কিংবা তাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শুভেচ্ছা এবং সব ধরনের বৈধতা হারাতে হবে। বর্মিদের অব্যাহত আক্রমণের প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নৈতিক অধিকার রয়েছে এবং হয়তো সরকার থেকে তাদের নিজের সমাজকে অহিংস পন্থায় রক্ষা করা আজ তাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমজমিন

৩০ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে