সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত : কে চোর? কে সাধু? কে দুর্নীতিবাজ? আর কে অসাধু? এ প্রশ্নে এখন তোলপাড় ভারতীয় রাজনীতি। সদ্য সমাপ্ত ২০ দিনের পার্লামেন্ট অধিবেশনে জনস্বার্থে কোনো কাজ হয়নি। অর্থাৎ বিরোধীরা সাদা/কালো টাকা নিয়ে সংসদের উভয় কক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বলতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু সরকার পক্ষ বাধা দেওয়ার ফলে বিনা আলোচনায় শীতকালীন অধিবেশন শেষ হয়ে গেল। এর কৈফিয়ৎ কে দেবে? ভারতে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী কোটি কোটি মানুষ? না নরেন্দ্র মোদি? দেশের সব বিরোধী দল কংগ্রেসসহ সভাপতির নেতৃত্বে একাট্টা। এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার মধ্যেই হয়তো মোদির প্রতিশ্রুতি দেওয়া ৫০ দিন শেষ হয়ে যাবে।
ইতিমধ্যে ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ২০১৩ সালের জুলাই মাস থেকে ২০১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় দফায় ভারতের বৃহত্তম চিট-কাণ্ড সাহারার কাছ থেকে নিজের নামে, নিজের হাতে দফায় দফায় মোট ৫০ কোটি টাকা নিয়েছেন। একই সময় বিড়লা গোষ্ঠীর থেকে নিয়েছেন ১২ কোটি টাকা। মোদির রাজ্যে এক বিশাল জনসভায় এ অভিযোগ জানিয়ে রাহুল গান্ধী বলেছেন, আমি এই অভিযোগ সংসদেই করতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু আপনারা আমাকে সে সুযোগ দেননি। অপরদিকে সুইস ব্যাংক ভারতের ৫০ জন ব্যবসায়ীর কালো টাকার তালিকা আপনাকে দিয়েছে। তা প্রকাশ করছেন না কেন? গরিবের টাকা ব্যাংকে জমা দিতে বলছেন। অথচ এই ৫০ জন গেরুয়া ব্যবসায়ীর ৮ হাজার কোটি টাকা কেন মওকুফ করে দিলেন। ৮ নভেম্বর নোটবন্দী করার পর জনসভাগুলোতে বলে বেড়াচ্ছেন, তিনি হতদরিদ্র। তিনি চা-ওয়ালা। প্রয়োজনে তিনি সব ছেড়ে দেবেন। তবে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়বেন কিনা তা বলেননি।
অপরদিকে বোমা ফাটিয়েছে ভারতের আয়কর অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। চিঠিতে তারা বলেছেন, নোটবন্দী হওয়ার পর অর্থ দফতর ও রিজার্ভ ব্যাংক ৫০০টি অর্ডার দিয়েছে। আপনার মুখ বাঁচাতে আমরা এ কাজ করতে পারব না। কারণ এ কাজ করার পরিকাঠামো আমাদের নেই। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সম্প্রতি বিবিসিতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মোদির এই নোটবন্দী স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং এর সঙ্গে দুর্নীতি যুক্ত আছে।
ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং একই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মোদির এই হঠকারী সিদ্ধান্তে একগুঁয়েমি কাণ্ডকারখানায় ভারতের আর্থিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। এর জের চলবে কয়েক বছর ধরে। মোদির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল বছরে দুই কোটি লোককে কাজ দেওয়া। নোটবন্দীর ফলে ক্ষেতমজুর থেকে দিনমজুর সব মিলিয়ে পাঁচ কোটি লোক বেকার হয়েছে। একটি বেসরকারি ইংরেজি চ্যানেল উত্তর প্রদেশের ১০০ কিলোমিটার এলাকা সমীক্ষা করে দেখিয়েছে, জুতো, কাঁসার থালাবাসন, কাচের চুড়ির কারখানা একের পর এক বন্ধ হওয়ায় ১০০ কিমির মধ্যে এক কোটি লোক কর্মহীন হয়েছেন। সারা দেশে বেকারের সংখ্যা যে কত তা মোদি সরকার দিতে পারছে না।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অরুণ কুমার অভিযোগ করেছেন, কালো টাকার রং উনি এখন গোলাপি করতে চাইছেন। মোদি হঠাৎই গরিবি হঠাও-এর স্লোগান দিয়েছেন। কিন্তু নোটবন্দীর পর দেশে গরিবের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। মোদির এই অপকর্মের ফলে ভারতের গণতন্ত্রের সঙ্গে অর্থনীতিও বিপন্ন হয়ে উঠেছে। মোদির এনডিএ সরকারের শরিক অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, এ অসহ্য যন্ত্রণা। যে কোনো মুহূর্তে তার দল এনডিএ থেকে বেরিয়ে আসবে।
মোদির ‘কালা-ধন’ নীতির সমর্থক বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, আর পাঁচ দিন বাকি। মোদির সময়সীমা শেষ হবে। তারপর আমি মুখ খুলব। ধীরে ধীরে যত দিন যাচ্ছে, একটার পর একটা নতুন তত্ত্ব ভারতবাসীর সামনে এসে যাচ্ছে। এরপরই দেখা দেবে খাদ্যাভাব। কারণ হাজার হাজার একর জমিতে ধান পেকে পড়ে আছে। কিন্তু ক্ষেতমজুরের অভাবে সে ফসল ঘরে তোলা যাচ্ছে না। কারণ কারও হাতেই নগদ টাকা নেই।
সারা দেশে এক-চতুর্থাংশ গ্রামে পোস্ট অফিস বা ব্যাংক নেই। ছোট ব্যবসায়ীরা মাথায় হাত দিয়ে পড়ে আছেন। ভবিষ্যৎ কী, কেউ জানে না। মোদি-অমিত শাহের তর্জন-গর্জনের অভাব নেই। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা দেশে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর নামে জমি কিনেছে বিজেপি। বিরোধীদের প্রশ্ন— এই টাকা কোথা থেকে এসেছে।
মোদির এই অপকর্মের পরামর্শদাতা কারা ছিলেন, তা কেউ জানে না। নোট বাতিল করার বুদ্ধিটা প্রথম নরেন্দ্র মোদির মাথায় ঢোকান দক্ষিণ ভারতের নামগোত্রহীন এক অর্থনীতিবিদ অনিল বোকিল। পুনের একটি অর্থনৈতিক বিঙ্কট্যাঙ্ক সংস্থা অর্থক্রান্তির সদস্য এই অর্থনীতিবিদ। নোট বাতিলের ধাক্কায় গোটা দেশ যখন কাঁপছে, তখন আহ্লাদে ডগমগ এই অর্থনীতিবিদ। তিনি আছেন নিজের আনন্দে।
সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, এই প্রথম ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী বৈপ্লবিক কোনো অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিলেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের যেমন ন্যাশনাল অ্যাডভাইজারি কাউন্সিল ছিল, তেমনই নরেন্দ্র মোদির রয়েছে বেশ কয়েকটা বিঙ্কট্যাঙ্ক। যেগুলোর নামও কেউ কখনো শোনেনি।
শুধু অর্থনীতিই নয়, প্রধানমন্ত্রীর বিজ্ঞান ভাবনাতেও হাওয়া দেয় এমন কয়েকটি সংস্থা বা কয়েকজন ব্যক্তি, যাদের কেউ চেনে না। কোনো সেমিনার বা বিজ্ঞান কর্মকাণ্ডে তাদের নাম শোনা গেছে বলেও মনে করতে পারছেন না কেউ। স্বদেশি বিজ্ঞান ধারণার পথিকৃৎ বলে দাবি করা সংস্থা বিজ্ঞান-ভারতীর সম্পাদক এ জয়কুমারকে ইদানীং প্রায়ই প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে দেখা যায়। এই সংস্থাটি আরএসএসের ঘনিষ্ঠ একটি সংস্থা।
সম্প্রতি দেরাদুনে কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের মতো গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়ে থাকে আরএসএসের এই বৈদিক বিজ্ঞান প্রচারকদের। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে তার স্লোগান ছিল— আচ্ছে দিন। এখন সাধারণ মানুষও বুঝতে পারছেন নরেন্দ্র মোদিকে ভোট দিয়ে তারা দেশের সর্বনাশ ডেকে এনেছেন।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদরা বলছেন, ভারত এখন সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়ল। গণতন্ত্র বিপন্ন। মোদি গণতন্ত্র বোঝেনও না, তার ধারও ধারেন না। বিরোধীরা আরও বলছেন, মোদি যেভাবে দিনে ১০-১৫ বার তার পোশাক বদলান, ঠিক তেমনই তার অর্থমন্ত্রক এবং রিজার্ভ ব্যাংক দু’বেলা নানারকম সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তাতে একদিকে সরকারি কর্মচারী, ব্যাংক যেমন বিপদে পড়ছে, তেমনই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
এখানেই শেষ নয়। সংসদের অধিবেশনের শেষ দিনে বিজেপি সংসদ সদস্যদের তাদের এলাকায় গিয়ে নোটবন্দীর প্রচার করতে বলেন। সে সময় অনেক সংসদ সদস্যই বলে দেন— এলাকায় এলাকায় প্রচার করতে যাওয়ার মতো টাকা তাদের হাতে নেই। সেখানে উপস্থিত বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ তাদের জোর দিয়ে বলেন, আপনাদের যেতেই হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে যে সৎ নয়, সেটা পৌনে তিন বছরের রাজত্বে একটার পর একটা ফাঁস হচ্ছে। এর পরিণাম কী দাঁড়াবে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্ররা তা বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনি গরিবিয়ানার ভাব দেখিয়ে গরিব-দরদি সাজেন।
তাই রাহুল গান্ধী দাবি করেছেন, মোদিজি, আপনি ৫০টি ধনী পরিবারের ব্যাংক থেকে নেওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা মওকুফ করতে পারেন, তাহলে কৃষকদের ঋণ কেন মওকুফ করবেন না? চিরকালের প্রথা ভেঙে পাঞ্জাব ও উত্তর প্রদেশে ভোটের আগেই ১ ফেব্রুয়ারি বাজেট পেশ করছেন। ওই বাজেট বক্তৃতায় তিনি ওই দুই রাজ্যের ভোটারদের প্রতারিত করার চেষ্টা করতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ চেয়েছে বিরোধী দলগুলো।
কারণ রাষ্ট্রপতি স্বয়ং ছয়বার বাজেট পেশ করেছেন। এদিকে বিরোধীরা যাতে ঐক্যবদ্ধভাবে মোদি-বিরোধী আন্দোলন করতে না পারে, তাই তাদের ব্ল্যাকমেইল করার জন্য দিল্লি ও তামিলনাড়ুর মুখ্যসচিবের বাড়িতে আয়কর দফতরকে দিয়ে তল্লাশি চালিয়েছেন। সিবিআই সংসদে তৃণমূল নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নোটিস দিয়েছেন। আর অন্যদিকে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি সুদীপবাবুকে পরামর্শ দিয়েছেন সিবিআইকে এড়িয়ে চলতে।
সর্বশেষে একথা বলা যায়, কালো ধন নিয়ে মোদির যে লম্ফঝম্ফ শুরু হয়েছিল, তা অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। কারণ, সাধারণ মানুষ জেনে গেছে মোদি নিজেই একজন অসৎ রাজনীতিবিদ। বিডি প্রতিদিন
লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক
৩০ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসবি